03 June, 2014

একটি বাস্তব ঘটনা।

শুরুর কথাঃ 
এ লেখা উৎসর্গ করলাম শ্রদ্ধেয়া গীতা আচার্যকে এবং "সুনামি" তে গৃহহারা - স্বজন হারা মানুষদের। এই লেখাটি একটি বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে লেখা। ২০০৪ সালের ২৬ সে ডিসেম্বরের সেই সুনামি পর আমাদের গীতাদি - শ্রদ্ধেয়া গীতা আচার্য নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কয়েকটি দ্বীপে যান। সেখানে এই আরও অনেকের সাথে এই পরিবারটির সন্ধান পেয়েছিলেন এবং জানতে পারেন যে উদ্ধারকারী দল ওই লাল বেনারসীর সঙ্কেত দেখেই ওই দ্বীপে প্রথম পৌঁছায়। ফিরে এসে গীতাদি আমাদের এই ঘটনাটির কথা বলেন তার সাথে এটাও বলেন যে এই ঘটনাটি নিয়ে ওনার কিছু লেখার ইচ্ছা আছে। আমি গীতাদির কাছে অণুরোধ করাতে দিদি তা মেনে নিয়ে আমাকে এই ঘটনাটির উপর কাজ করার অনুমতি দিয়ে আমাকে চির কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন। নিজের কল্পনা মিশিয়ে লেখাটি শেষ করি ১০/০৮/২০০৫ তারিখে কিন্ত কোথাও প্রকাশ করিনি। আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রাক্কালে আপনাদের কাছে নিবেদন করলাম।

মেয়ের বয়স ষোল
বাবা বললে বিয়ে দেব।
দূর সমুদ্র পারে
জঙ্গল পাহাড় ঘেরা
এক দ্বীপের মধ্য থেকে
খুঁজে আনল
স্বপ্ন দেখা এক তরুণকে।
কাজুবাদামের বাগান আছে
নিজেদের বাড়ি
শক্ত সবল পুরুষ
চোখে স্বপ্ন অনাগত ভবিষ্যতের
আর কি চাই ?

সাধ করে মেয়ের হাতে তুলে দিল
লাল বেনারসী।
সাগর সৈকতে বিকাল বেলা
শেষ সূর্যের আলো যখন রাঙিয়ে দিচ্ছিল পৃথিবীকে
আগুন রঙা বেনারসীতে কি অপূর্ব লাগছিল মেয়েকে
তার চোখে জল – মুখে হাসি।

দিন কেটে যায়, বছর ঘোরে
মেয়ের কোলে এল সন্তান
দুই ছেলে আর এক মেয়ে,
মেয়ে হল মা।
স্বামী – সন্তান নিয়ে সুখের সংসার।

আস্তে আস্তে চুলে ধরে পাক
ছেলে মেয়েদের বিয়ের সময় হয়,
মেয়ে – মায়ের বড় আদরের
গলা জড়িয়ে ধরে মাকে বলে,
“মা তোমার ওই বেনারসীটা কিন্ত আমি নেব”।
বড় ছলে বলে – “না বোনটি
মা ওটা দেবে আমার বউকে”।
ছোট ছেলে কিছু বলে না
চুপচাপ চেয়ে থাকে।
মা হাসে – “কিরে তুই কিছু বলবি না”
“তোমার যা ইচ্ছা” – বলে সে।
মা অথবা মেয়ের বড় প্রিয় ওই
আগুন রঙা বেনারসী।

সেদিন সকাল –
প্রতিদিনের মত শুরু হচ্ছে
এক নতুন দিন।
হঠাৎ করে কেঁপে উঠল পায়ের তলার মাটি
সেকি ভীষণ কাঁপন !
চড় চড় করে দেখা দিল এক বিশাল ফাটল
একদিকের দেওয়াল ভেঙ্গে পড়ল
মড় মড়িয়ে !
চারিদিকে চিৎকার
মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না
মনে হল আজই বুঝি শেষের সে দিন।

থামল কাঁপন – শান্ত হল পৃথিবী
হঠাৎ করে মেয়ে দেখল
সামনের নীল সমুদ্র সরে যাচ্ছে পিছনের দিকে তীরবেগে !
অবাক হল মেয়ে – এখন মা
রোদ আড়াল  করে
সাগরের দিকে চেয়ে বুঝতে চেষ্টা করল কি ঘটছে।
দেখল দূরে উঠছে দেওয়াল
শোনা যাচ্ছে গর্জন
শত সহস্র বাহু মেলে
তাদের চেনা সেই শান্ত সমুদ্র
এগিয়ে আসছে – এগিয়ে আসছে
সব কিছুকে গ্রাস করবে বলে।
পালাও ! পালাও সবাই !
স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে
পাগলের মত ছুটল মেয়ে
কোন এক উঁচু জায়গার দিকে
কাঁটার খোঁচায়, পাথরের আঘাতে
রক্তাক্ত হল তার আলতা পরা পা
ছিঁড়ল কাপড়।
বাঁচাতে হবে – হবে বাঁচতে
হঠাৎ এক বিশাল ঢেউ
ছুঁড়ে দিল তাকে – তারপর
তারপর সব অন্ধকার।

জ্ঞান ফিরতে দেখলে
পাথুরে রুক্ষ মাটির উপর শুয়ে আছে
মুখের উপর ঝুঁকে আছে
স্বামী আর ছেলে – মেয়েরা।
আঃ
সবাই আছে তাহলে।
সমুদ্র রাক্ষস মুছে দিতে পারেনি সিঁদুর
কেড়ে নিতে পারে নই সন্তানদের।
আস্তে আস্তে উঠে বসে চাইল সামনে –
কিছু দূর থেকে শুরু হয়েছে জল
তার ঘর কোথায় গেল ?
কোথায় গেল সেই কাজুবাদামের গাছগুলো ?
তার যৌবন কালের প্রণয় মুহূর্তের সাক্ষী,
সাক্ষী বাচ্চা গুলোর বেড়ে ওঠার
তাদের শৈশবের অবুঝ দুরন্তপনার।
কিছু নেই – শুধু জল আর জল!

বড় ছেলে এগিয়ে এল
“মা সবই গেছে – বাঁচেনি কিছুই
শুধু এইটা ছাড়া”
বলে মার হাতে তুলে দিল সেই
আগুন রঙা বেনারসী।

হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে রইল মেয়ে
এখন মা –
“ছেঁড় এটাকে দু টুকরো করে,
একটা টুকরো চাঁদোয়া করে বেঁধে দাও –
সবাই ছায়া পাবে।
অন্যটা পতাকা করে বেঁধে দাও ওই গাছের মগডালে।
যদি কেউ দেখতে পায় বাঁচাবে আমাদের”।
বলল মেয়ে – এখন মা

তার বড় প্রিয় ওই আগুন রঙা বেনারসী। 

No comments:

Post a Comment