22 July, 2020

বেচারা বেচু দা।

পাড়ার চায়ের দোকানের সামনে হঠাৎ ভিড় - উত্তেজিত গলার আওয়াজ। বাঙালীর স্বভাব জাত কৌতূহল বসে উঁকি মারলাম। দেখি একদিকে উত্তেজিত বেচু দা - এই মারব সেই মারব ভাব কয়েকজন বেচু দা কে শান্ত করার চেষ্টা করছে কিন্তু বেচুদার শান্ত হওয়ার নাম নেই। একসময় বেচু দা ভেউ ভেউ করে কাঁদতে আরম্ভ করে দিল। অন্যদিকে একটু দূরে বসে ভ্যাবলা মিচকে মিচকে হাসছে।

কি ব্যাপার প্রশ্ন করতে যা জানা গেল তা বলার আগে বেচু দা সম্পর্কে একটু জানতে হবে।

বেচু দা আদতে এই রাজ্যের বাসিন্দা নয় এমনকি বাঙালী ও নয়। কোন সুদূর অতীতে বেচু দার ঠাকুরদার চাচা নাকি পিসে হরিয়ানা না হিসার থেকে (টেনিদা থাকলে বলত "হনুমানপুর বা কচ্ছ হলেই বা ক্ষতি কি") এ রাজ্যে এসে প্রচুর সম্পত্তি করেছিলেন। তারপর যা হয়, বেচু দার ঠাকুরদার নাকি একটা কিসের দোকান ছিল, সেটা ভালো চলছিল না, তাই তাকেও নিয়ে আসেন কারণ নিজের কোন ছেলে - পুলে ছিল না। বেচু দার ঠাকুরদার খুব মজা, পরের পয়সায় ভালোই চলছিল। তা গজেন্দ্র সিং এর (মানে ঠাকুর দার) আরও সুবিধা হল, ওই চাচা না পিসে অগাধ সম্পত্তি রেখে একদিন গেল মরে। তা গজেন্দ্র জির কিছু বুদ্ধি ছিল, সেটাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে তো রাখলই কিছু বাড়াল। বেচু দার বাবা রমেন্দ্র সিং বাড়াতে পারে নি কিন্তু যা ছিল তা বজায় রেখেছিল। বেচু দার আসল নাম ওই নরেন্দ্র না সুরেন্দ্র কি যেন একটা। লেখা পড়া করেনি বলেই পাড়ার সকলে জানে কিন্তু বাইরের লোকের কাছে নিজেকে বিশাল বিদ্বান বলে পরিচয় দেয়। আবার তাকে বিদেশী বললে খুব ক্ষেপে যায়। ভুল ভাল বাংলায় ভুল ভাল কথা কোট করে প্রমাণ করতে চায় সে আমাদের থেকেও বেশী বাঙালী। বাঙাল (মানে পূর্ব বঙ্গের লোকেরাই হল আসল বিদেশী - ওরা সব হাড় বজ্জাত) দের উপরে বেচুদার ভীষণ রাগ।
যাই হোক, বেচু দা কে মোটামুটি চেনা গেল - এই রে আসল কথাই তো লিখতে ভুলে গেলাম, "বেচুদা"র নাম বেচু হল কেন?
একটু আগেই লিখেছিলাম বেচু দা লেখা পড়া বিশেষ করে নি। বাবা জোর করে বিয়ে দিয়েছিল, তা সে বউ এখন কোথায় আছে কেউ জানে না (বেচু দা তো স্বীকার করতেই চায় না তার বউ আছে)। তা বউ না থাকলেও খেয়ে - পরে তো বাঁচতে হবে। একবার বাড়ি থেকে পালিয়েছিল, সন্ন্যাসী হবে বলে। ভেবেছিল বোধ হয় সন্ন্যাসী হলে পরের ঘাড় ভেঙে খাওয়া - থাকা র কোন সমস্যা হবে না, তা সেটাও হল না, ফিরে এল বাড়িতে। বাপের এক ছেলে, তা বেচু দা দেখল বাপ যতদিন আছে ততদিন বাপের সম্পত্তি র রোজগার থেকে ভালো ভাবেই চলবে। খাটছে তো বাপ - বেচুদার তো কোন ঝামেলা নেই, বসে বসে রাজা - উজির মারত। বাবা ব্যবসা চালাতেই পারছে না, বেচুদা কে দায়িত্ব দিলেই বেচু দা এই ব্যবসা আরও বড় করে ফেলত - এই সব। পাড়ার লোকে বলত, হ্যাঁ বেচু (তখনও বেচু হয় নি - ওই সুরেন্দ্র / নরেন্দ্র) যা ছেলে বাবার ব্যবসা ও ঠিক রাখতে পারবে। আমরা বেশীর ভাগ যারা ওকে চিনতাম - হাসতাম। ও করবে ব্যবসা!! যাই হোক, বেচুদার বাবা একদিন বেচু দাকে ব্যবসার দায়িত্ব দিল। ব্যস্‌!! বেচুদাকে আর পায় কে? সকলকে ডেকে ডেকে বলতে লাগল, এইবার দেখ এই ভারত লক্ষ্মী ব্র্যান্ড কে আমি কত বড় করে তুলি। শুধু একবার নয় বেচুদার কাজই হল সারদিনে অন্তত শ খানেক বার এই কথা বলা। চায়ের দোকানে, সেলুনে, বাজারে সব জায়গায় বেচুদার এই এক কথা। লোকে শুনতে না চাইলেও ডেকে ডেকে বলা - বার বার বলা। এই করে তো বেশ কিছুদিন গেল। তারপর হঠাৎ করে একদিন দেখি বেচুদার ভারত লক্ষ্মী মুদির দোকানের নাম বদলে গেছে - হয়েছে আমার লক্ষ্মী। পুরানো কর্মী দের অনেকেই ছাঁটাই। আবার কিছু দিন গেল দেখি বাজারের বড় কাপড়ের দোকানের নাম বদলে হয়েছে মন লক্ষ্মী লিমিটেড - মালিকের নাম ও বদলে গিয়ে হয়েছে দানীরাম (না ওই জাতীয় কিছু)। এইভাবে দিন যায়, বেচুদাদের সব ব্যবসারই নাম বদলায় (ততদিনে পাড়ার অনেকেই বুঝে গেছে বেচুদার কারবার (এবং নাম বদলে বেচু রাখা হয়ে গেছে)। নিজেদের অত বড় ব্যবসা বেচেই বেচুদা খাচ্ছে।

এবার হয়েছে কি, চায়ের দোকানে বসে রাজা - উজির মারতে মারতে বেচু দা বলেছে ভাবছি "বাড়িটা বেচে দেব"। শুনেই ভ্যাবলা বলেছে

"শোন বেচু, এর আগে যা বেচেছিস, তার বাজারে দাম আছে। তোর ওই বাড়ির দাম কত রে? ওই তো বাড়ি, তার উপর বেচতে বেচতে যা হাল করেছিস তোর ওই বাড়ি বিনা পয়সায় বেচলেও কেউ কিনবে না। লোকে জিনিস কেনে কাজে লাগানোর জন্য, তোর ওই বাড়ি কার কোন কাজে লাগবে? আর বাড়ি কিনলে তোকেও তো কিনতে হবে নাকি বাড়ি বিক্রি করে পালাবি ভাবছিস - আর তো কিছু বেচার থাকবে না"। শুনেই বেচু দা ফায়ার! কখনও চেঁচায় - কখন ও কাঁদে।

বেচারা বেচু দা।