25 June, 2020

ভালো আছি

আমি বেশ ভালো আছি
ফেসবুকে মজে আছি,
ট্যুইটারে ট্রোলে আছি
ছবিতে - লেখায় আছি,
লাইভেতে জমে আছি।।

ট্রেনে – ট্রাকে চাপা পড়ে
কত লোকে গেল মরে,
ভুখা পেটে পথ হেঁটে
জামলোটা গেল চলে।
আরও কত গেছে মরে
খিদে সইতে না পেরে।
(গুণিনি যে ভালো করে!)

(তবু) আমি খুব ভালো আছি
ধরমের ব্যারামে আছি,
দ্বেষ প্রেম মদেতে আছি
খাঁটি জাতীয়তাবাদে আছি

(বুঝলেন নেতা - নেত্রী মন্ত্রী - সান্ত্রীরা)
আমি এক ভারতীয় নাগরিক
আমি বড় ভালো আছি!!!!!

শ্রীতোষ ২৪/০৬/২০২০

23 June, 2020

চিন"তা

কথা কোয়ো না
কেউ "চিন"তা কোরো না
দ্বেষ প্রেমিক গণ ক্ষিপ্ত হইবেন
"চিন"তা সইতে পারেন না
শ্রীতোষ ২৩/০৬/২০২০

14 June, 2020

মূলখাড়কা - যেখানে প্রকৃতি কথা বলে

আজ কলম ধরেছি














মূলখাড়কার কথা লিখব বলে। মূলখাড়কা হল পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিম সীমান্তে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম। এই গ্রামের নামেই আছে একটি হ্রদ – নাম মূলখাড়কা হ্রদ। গ্রামের নাম মূলখাড়কা হওয়ার পিছনে একটি কাহিনী আছে। এখানে এক সময় কোন গ্রাম ছিল না। এটা ছিল জঙ্গলের মাঝে কিছুটা খালি জায়গা। এই জায়গায় দূর দূর গ্রামের মানুষরা তাঁদের গবাদি পশু ছেড়ে দিয়ে যেতেন (মূলত গরু) তারা এই জঙ্গলেই চরে বেড়াত যখন গরু গাভীন হত তখন তাঁরা এসে গরু গুলিকে নিয়ে যেতেন। সেই সময় দু – তিন দিন তাঁরা এই জায়গাটিতেই থাকতেন। স্থানীয় ভাষায় “মূল” অর্থে “আদি” (যথা আদিবাসী / মূল বাসী ইত্যাদি)। সময়ের দাবীতে একসময় তাঁরা এই স্থানে বসতি স্থাপন করলেন – নাম দিলেন মূলখাড়কা। দার্জিলিং জেলার কালিংম্পং মহকুমার লিংসে গ্রাম পঞ্চায়েতের এই গ্রামে আজও দশ – বারো ঘর মানুষের বসতি।

ইন্টারনেট ঘেঁটেই এ গ্রামের এবং লেকের খবর পেয়েছিলাম কিছুদিন আগে। লেকের জলে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছায়া পড়েছে – এই ছবি দেখেই ঠিক করলাম যেতেই হবে এখানে। ১৭ই জানুয়ারি আমাদের বিবাহবার্ষিকী – এই বছর দিনটা ছিল শুক্রবার। পরের দুদিন শনি ও রবি। ফলে এক দিন ছুটি নিলে চমৎকার একটা উইক এন্ড ট্রিপ হয়ে যাবে। ইন্টারনেটেই মূলখাড়কা হোম স্টের পূর্ণিমা ছেত্রীর ফোন নাম্বার পেয়েছিলাম।
দিন টা ছিল ১১ই জানুয়ারি, প্রথম ফোন করলাম। ফোন লাগে না – লাগে না। দু তিন বার চেষ্টা করার পর মনে হল লিংসে থেকে মূল খাড়কা বেশী দূর নয়, লিংসে তে আছে ঝুসিং হো,ম স্টে, সেখানে যদি থাকা যায়। ফোন নাম্বার ছিল অতএব – ফোন ধরলেন বাদু ভাই (বাদাল ভাই)। জিজ্ঞাসা করলাম “১৭ই জানুয়ারি থেকে ১৮ই জানুয়ারি থাকতে পারি আপনার ঘরে? আমি মূলখাড়কা লেক দেখব।“ উনি বললেন “স্যার ১৭ থেকে ১৯ আমার ঘর তো বুক, আপনি পূর্ণিমা দিদি কে ফোন করছেন না কেন?”
আমি বললাম
স্যার জী অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পূর্ণিমা ম্যাডাম কে ফোনে ধরতে পারি নি
উনি বললেন “ঠিক আছে আমি কথা বলে নিচ্ছি”
তার পরেই আমি আবার ফোন করলাম
ফোন ব্যস্ত
আবার
এবার ফোন বাজছে
এক মহিলা কণ্ঠ
আমি নিশ্চিত উনিই পূর্ণিমা ছেত্রি
সেই মুহুর্তে আমার কাছে পূর্ণিমা ম্যাডাম
নিজের পরিচয় দিলাম
উনি বললেন হ্যাঁ বাদু ভাই ফোন করেছিলেন
আরও দু একটা কথা
তারপর থেকে উনি পূর্ণিমা দিদি
ঘর বুক হয়ে গেল অ্যাডভানস কোন টাকাও দিতে হবে না।

অন্যদিকে শুরু হয়েছিল আর এক কাহিনী
গ্যাংটক থেকে তো পায়ে হেঁটে মূল খাড়কা যাওয়া যায় না গাড়ি লাগে
ঐ ১১ জানুয়ারি থেকেই গাড়ির খোঁজ শুরু করেছিলাম
আমাদের অফিসের ড্রাইভার – আরিটারে বাড়ি তার
জানে না নাম মূল খাড়কার।
শরণ নিলাম প্রলয় বাবুর – তিনিও প্রথম শুনলেন
নির্মল প্রধান – উনিও জানেন না
সেই অভিজ্ঞতা থেকেই পূর্ণিমা দিদিকে বললাম
“একজন ড্রাইভারের সন্ধান দিতে পারেন যে গ্যাংটক থেকে আমাদের নিয়ে যাবে”
দিদি সরাসরি স্বীকার করলেন
“গ্যাংটক থেকে ওনার কাছে কোন গেস্ট আসে নি”
বাধ্য হয়ে সাঙ্গে শেরপার শরণ নিলাম। ও ম্যাথুর ফোন নাম্বার দিল। ম্যাথুও জানত না ফলে গুগুল ম্যাপ পাঠালাম হোয়াটস্‌ অ্যাপ করে।

১৭ই জানুয়ারি সকালে নির্দিষ্ট সময়ে গাড়ি এসে গেল – যাত্রা হল শুরু। প্রথম বাধা রংপোর একটু আগে। অনেক দিন পরে সুরিতা হ ঠা ৎ করেই অসুস্থ! বমি । সঙ্গে লেবু বা লজেন্সও নেই। যাই হোক, একটু সামলে উঠে ২য় বাধা। গাড়ি চেক হচ্ছে। আধ ঘণ্টা নষ্ট সেখানে। এরপর আরিটারের পথে গাড়ি চলছে আবার বাধা, রাস্তা বন্ধ কাজ চলছে। অন্য এক পাহাড়ি পথে গাড়ি চলে, চলে আর চলে। একসময় আরিটার। সুরিতার দিকে তাকানো যায় না, পিছনের সীটে শুয়ে। আমার মোবাইলে গুগুল ম্যাপ, ড্রাইভারের কানে ফোন। এক সময়, পিচ রাস্তা ছেড়ে ধরা হল অন্য রাস্তা – যে রাস্তায় স্পীডোমিটার ঘুমিয়ে পড়ে, মেঘ ঢাকা পথে পথ চলা।

সব পথের শেষ হয় – দেখার হয় না শেষ (ফেরার সময় সুরিতা বুঝেছিল সে কথা), তাই এক সময় পথ শেষ হয় – তখন বৃষ্টি নেমেছে। ফোনে ধরি পূর্ণিমা দিদি কে, তিনি তার ছোট ভাইকে পাঠিয়ে দিলেন। রাস্তা থেকে নিবাস নিচে – প্রায় ৬ তলা বাড়ির মত। সিঁড়ি ভেঙে নামতে হবে। একসময় দেখি, সিঁড়ি নেই, কিছু পাথর, চার পাশে ধরার মত কিছু নেই। ভারটিগো রুগী – অসহায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজি। একটু বাদেই পূর্ণিমা দিদিকে দেখতে পাই, অনেক সময় পরেও ঘরে ঢুকছি না দেখে দেখতে চাইছেন কি হল? আমাদের ইশারা বুঝে উঠে আসেন, দিদির হাত ধরে ঐ কয়েক টা পাথর পার হয়ে আসি।

ঘরে ঢোকার সাথে সাথে চলে এল গরম চা। তারপরেই এল দুপুরের খাওয়ার ডাক। গরম ভাত, ডাল, লংকার আচার আর ডিমের ঝোল দিয়ে সমাপ্ত হোল দুপুরের খাওয়া – তখন অঝোর ধারে বৃষ্টি। সুরিতা অনেকটা সুস্থ। ঘরে মন থাকে না, বার বার ক্যামেরা হাতে বাইরে। বিকেলে আকাশ অনেক পরিষ্কার, কিছু ছবি তুললাম।
সন্ধ্যা বেলা চলে এল চিকেন পকোড়া সাথে কফি। রাত ৯ টায় এল খাওয়ার ডাক। পরদিন লেক দেখতে যাব, সেই জন্য দেরী করলাম না। তখনও বৃষ্টি পড়ছে।
৪ টে অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম, সূর্য ওঠার আগে পৌঁছাতে হবে লেকে। পৌনে ৫ টায় ঘরের বাইরে দুজনে, যে পথ দিয়ে কিভাবে নামব ভেবেছিলাম সে পথ পার হয়ে মূল রাস্তায়। একে অন্যকে দেখছি অবয়বে – রাস্তা মানে সামনে কিছু খোলা জায়গা। মোবাইলের আলোতে শুরু পথ চলা। দেড় কিমি পথ পাড়ি দিতে হবে।
পাড়ি দিলাম, এক সময় এসে পৌঁছালাম এক বাংলোর সামনে। তাকে ঘিরে গোল হয়ে গেছে পথ। একবার ঘুরপাক খেলাম – তারপর দেখলাম ঐ পথের পাশেই আছে এক বসার জায়গা, তার পাশ দিয়ে চলে গেছে এক পায়ে চলা পথ।
ইন্টারনেটে দেখেছিলাম এক ফুটপাথ আছে ঐ লেকের চারপাশ ঘিরে, তখন সে সময়ে সে ফুটপাথ আর খুঁজে বার করার সময় নেই, ঘড়ি বলছে ৫ টা ২৫।
সুরিতা আমার আগেই এগিয়ে গেছে হঠাৎ ওর চিৎকার শুনতে পেলাম
“মন্দিরের আগের ঐ ফ্ল্যাগ গুলো দেখতে পেয়েছি”
পাগলের মত ছুটলাম এসে গেলাম মন্দিরের সামনে
এবার যেতে হবে বিপরীতে না হলে তো দেখতে পাব না
ফুটপাথ ধরে যত জোরে পারি এগিয়ে গেলাম – পৌঁছে গেলাম হ্রদের অন্যপ্রান্তে।
ঝকঝক করছে আকাশ কিন্তু আকাশের সে সীমানায় মেঘ। ফলে মনের আসল ইচ্ছা থেকে গেল অপূর্ণ।
দেখা হল না সেই অপরূপ দৃশ্য। অদ্ভুত একটি বিষয় নজরে এল আর তা হল হ্রদের চার পাশে প্রচুর গাছ কিন্তু জলে একটি পাতাও পড়ে নেই। সিকিমের অন্য সব প্রাকৃতিক হ্রদের মতই এ হ্রদের জল অত্যন্ত পবিত্র, এতে পা দেওয়া যায় না। তবে হাত দিয়ে জল স্পর্শ করায় কোন বাধা নেই। এমনকি এই হ্রদের জল লোকে খাওয়ার জন্য ব্যবহার করে থাকেন। হ্রদের একটু উপরে যে ক্যাম্প সাইট আছে, সেখানে রান্নার জল হিসাবে এই হ্রদের জলই ব্যবহার করা হয়। যে সব জায়গা দিয়ে পারে পৌঁছানো যায়, সেই সব জায়গায় হ্রদের পারে একটির উপর আরেকটি পাথর দিয়ে প্রচুর স্তম্ভ তৈরি করা আছে। এই হ্রদের সামনে দাঁড়িয়ে মনের কোন ইচ্ছা জাগলে (মানত করলে) তা নাকি সফল হয়। মানুষ ঐ ভাবে পাথর সাজিয়েই মানত করেন। ছিলাম সেখানে তিন থেকে চার ঘণ্টা তারপর ফিরে এলাম! মাঝখানে একটু উপরে উঠে দেখে এলাম ক্যাম্প সাইট। আলাপ হল সোনমের সাথে।

সেদিন ভেবেছিলাম গ্রাম ঘুরব, শরীর দিল না। পরদিন সূর্যের (আসলে সুরয নাম তার) সাথে গ্রাম ঘুরলাম, মানুষ দেখলাম। সূর্য নিয়ে গেল সোনমের বাড়ি। সেখানে গরম গরম চা খেয়ে শরীর চাঙ্গা করে আবার গ্রাম ঘোরা। মূল খাড়কা কেমন করে ধ্বংস হবে দেখলাম তাও। রাস্তার ধারে একটু উপরে এক বিশাল এলাকা জুড়ে কেটে ফেলা হয়েছে অজস্র গাছ। শুধু তাই নয়, তারপর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে জঙ্গল। শুনলাম ওখানে একটি রিসরট হবে। সিকিমের কোন এক ব্যবসায়ী ঐ জমি কিনে নিয়েছেন। আসলে, আমরা মানুষ তো, সভ্য মানুষ তাই সব কিছু ধ্বংস করায় আমাদের বড় আনন্দ। যাই হোক, সূর্য বলল পরের দিন সকালে পরিষ্কার আকাশ পাওয়া যাবে।

সূর্যের কথা শুনে ইচ্ছা করল থেকে যাব আর এক দিন – পূর্ণিমা দিদি রাজী
ফলে পরের দিন সকালে মূল খাড়কা হোম স্টের লন থেকে দেখলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা! সে দেখার বর্ণনা দেওয়ার সাধ্য এ কলমে নেই। ছবি গুলো প্রমাণ।

শুধু তাই নয় ফেরার পথে পথের প্রতি বাঁকে দেখলাম তাকে
আর দেখলাম রমিতো ভিউ পয়েন্ট থেকে

(প্রসঙ্গত পরে জেনেছিলাম ১৭ই জানুয়ারি নাকি ওখানে বুনো কুকুরের এক দল এসেছিল, ১৮ই জানুয়ারি আমরা যখন বার হই লেক দেখতে, আমাদের হাতে একটা লাঠিও ছিল না)
মূল খাড়কা যেতে হলে কলকাতা থেকে ট্রেনে / বাসে / ফ্লাইটে নিউজলপাইগুড়ি/ শিলিগুড়ি। সেখান থেকে গাড়িতে মূলখাড়কা।
থাকার জন্যঃ মূল খাড়কা হোম স্টে – পূর্ণিমা ছেত্রিঃ ৯৭৪৯০৬০৫৯৩

10 June, 2020

নাটক কেন করি

শুরুর কথাঃ এ লেখা লিখতে গিয়ে আমাকে অজস্র ওয়েব সাইট, ফেসবুক পেজ, ব্লগ ও আরও কিছুর সাহায্য নিতে হয়েছে। সকলের নাম নিতে পারব না কারণ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তথ্য কপি – পেস্ট করেছি কখনো নিজের ডেস্ক টপে কখনো বা মোবাইলে। ফলে ভুলেই গেছি। তাই লেখার শুরুতেই সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে নিলাম। আপনাদের সবার অবদানের কারণে এ লেখা সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। আপনাদের সবাইকে প্রণাম জানাই। মাননীয় পাঠক বন্ধুরা কোথাও কোন তথ্যের ভুল পেলে সে দায়িত্ব আমার নিজের – অনুগ্রহ করে ক্ষমা পূর্বক সংশোধন করে দেবেন।

 

রামকৃষ্ণ বলেছিলেন “নাটক লোক শিক্ষা দেয়”।

নাটক সম্পর্কে বলা হয়  “নাটক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার”

সংস্কৃত আলঙ্কারিকগণ নাট্যসাহিত্যকে কাব্য সাহিত্যের মধ্যে স্থান দিয়েছেন। তাঁদের মতে কাব্য দুই প্রকার - দৃশ্য কাব্য ও শ্রব্য কাব্যনাটক প্রধানত দৃশ্য কাব্য এবং এটি সকল প্রকার কাব্য সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ -



কাব্যেষু

নাটকম্‌

রম্যম্‌

তাহলে আমরা একটু নাটকের ইতিহাস ও তার বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করি।

নাটক নিয়ে আলোচনা শুরু করতে গেলে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে “নাটক” শব্দটি এল কোথা থেকে?

“নাটক” শব্দের উৎপত্তি হয়েছে “নট্‌” ধাতু থেকে যার অর্থ নড়াচড়া করা। নাট্য’ ‘নট’, ‘নটী শব্দের উদ্ভব ও এই একই ধাতু থেকে। ইংরেজি “DRAMA” শব্দের উদ্ভব হয় গ্রীক ভাষা থেকে। “DRAMA” শব্দের সংজ্ঞা হল “The term comes from a Greek word meaning "action" (Classical Greek: δρᾶμα, drama), which is derived from "to do" (Classical Greek: δράω, drao).” তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি “নাটক” বা “DRAMA” দুটি শব্দের মধ্যেই মুভমেন্ট বিষয়টি আছে। খুব সরল ভাবে বলতে গেলে শরীর সঞ্চালনার মাধ্যমে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করা – কোন বক্তব্য উপস্থাপিত করার নাম “নাটক” ।

 

ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা দেখতে পাব ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিশরে একটি ধর্মীয় নাটক অনুষ্ঠিত হয়। নাটকটির কাহিনী নেয়া হয়েছিল বিখ্যাত মিশরীয় মিথলজি "মিথ অফ ওসিরিস অ্যান্ড আইসিস" থেকে। আর এটাই ছিলো নাট্য-সম্পর্কিত প্রথম কোনো ঘটনা যার তথ্য নথিপত্রে পাওয়া যায়।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় গ্রীস, ভারতবর্ষ ও রোমের নাট্য- ঐতিহ্য সবচেয়ে প্রাচীন । এদের মধ্যে গ্রীস ও ভারতবর্ষের নাট্য মঞ্চের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ধর্মের প্রয়োজনে নাটকের সৃষ্টি ।

 

ভারতঃ        ভারতের নাট্য ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই শিব বা মহাদেবই হলেন এ দেশের নাট্যকলার জন্মদাতাবিশ্বের স্রষ্টা ব্রহ্মা নাট্যকলা শেখেন মহাদেবের কাছ থেকে এবং তারপর তিনি  গন্ধর্ববেদ বা নাট্যবেদ রচনা করেন । এটিই বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন নাট্যশাস্ত্র । দেবতারা যখন অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করলেন তখন ব্রহ্মা দেবরাজ ইন্দ্রের সন্ত্রষ্টি বিধানের জন্য প্রথম ভারতীয়  নাটক সমুদ্র মন্থনরচনা করেন । ভারতবর্ষে প্রাক-বিভক্ত সমাজের অবসান ঘটিয়ে যখন দাস সমাজ পক্ষ বিস্তার করেছিল তখনই এই নাটকের সূত্রপাত । আবার আমরা দেখতে পাই, মহাদেবের সঙ্গে পাবর্তীর বিবাহ উপলক্ষে দ্বিতীয় নাটক ত্রিপুরাধাযখন মঞ্চস্থ হয় তখন মহাদেব নিজেও সেই নাটকের একজন দর্শক ছিলেন । কিন্তু নাটকটিতে কোন নৃত্য সংযোজিত হয়নি বলে তিনি সন্তষ্ট হতে পারেননি এবং তাঁর আদেশে তাঁরই শিষ্য তান্ডু সেই নাটকে একটি নৃত্য পরিবেশন করেন । তান্ডুর নামানুসারে সেই নৃত্য তান্ডব নৃত্য নামে পরিচিত হয় । এদিকে ভারতীয় নাটকে লাস্য-নৃত্যের প্রবর্তন করেন স্বয়ং পাবর্তী এবং তাঁর কাছ থেকে সবর্প্রথম উক্ত নাচ শেখেন রাজা বানের কন্যা উষা । তারপর এই নৃত্য গোপীবালাদের মাধ্যমে সৌরাষ্ট্রের মহিলাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় নাটকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময় হল সামন্ত যুগ । এই যুগের উজ্জলতম নক্ষত্র হলেন মহাকবি কালিদাস । কালিদাসের বহু অগ্রবর্তী হলেন দাক্ষিণাত্যের অধিবাসী সংস্কৃত নাট্যকার ভান । ইনি দশটি নাটক লিখেছিলশক কিন্তু খ্যাতি ও সাফল্য লাভ করেছিলেন কালিদাস । সংস্কৃত নাটকের এই যুগটি খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে তৃতীয় শতকের মধ্যেই হওয়া সম্ভব । কালিদাসেরশকুন্তলানাটক বিশ্ববিশ্রুত । তাঁর অপর দুটি নাটক বিক্রমোর্বশীমালবিকাগ্নিমিত্রকালিদাসের পরবর্তী লেখকদের মধ্যে রাজা শুদ্রকেরমৃচ্ছকটিকনাটকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । পরের মহান ভারতীয় নাট্যকার ছিলেন ভবভূতি (৭ম শতক)। ধারণা করা হয় তিনি এই তিনটি নাটক লিখেছেন- মালতী-মাধব, মহাবীরচরিত, উত্তর রামচরিত। এই তিনটির মধ্যে শেষের দুটি রামায়ণের সমগ্র মহাকাব্যকে তুলে ধরেছে।শক্তিশালী ভারতীয় সম্রাট হর্ষ বর্ধন কে (606-648) তিনটি নাটক লেখার কৃতিত্ব দিতে হয়: (হাস্যরসাত্মক) রত্নাবলী, প্রিয়দর্শিকা এবং বৌদ্ধ নাটক নাগানন্দ। ভরত মুনির বিষয়ে পরে আলাদা করে কিছু বলার ইচ্ছা রইল।

 

গ্রীসঃ        গ্রীক নাটকের সূত্রপাত সরাসরি কোন দেবতার হাতে ঘটেছে এমন কথা সেই দেশের নাট্য ইতিহাসে নেই । প্রথম গ্রীক নাটকের রচয়িতা একজন মানুষ নাট্যকার এসকাইলাস বা আসকাইলাস  (Aeschylus) পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম মানুষ নাট্যকার (অবশ্য যদি আমরা ভারতীয় দেবতা দের বা যে কোন দেবতা কেই দেবতা বলে মেনে নিই। আমার মতে শিব, ইন্দ্র, ব্রহ্মা থেকে শুরু করে জিউস, অ্যাপোলো ডাইওনিসাস এঁরা সবাই ছিলেন তৎকালীন প্রভাব শালী গোষ্ঠীপতি) ।  গ্রীকদের একজন নাট্য দেবতা হলেন এপোলোর সন্তান ডাইওনিসাস (Dionysus) তৎকালে ডাইওনিসাসের সন্মানার্থে বা সন্তুষ্টির জন্য সমবেত সংগীতের মধ্যে দেবতাদের গুণগান করা হত । কালক্রমে তাতে বর্ণীত কোন বিশষ চরিত্রের রূপ দেয়ার প্রয়োজন অনুভূত হয় এবং খ্রীস্ট পূর্ব ছয় শতকে থেসপিস (Thespis) সেই উপাসনা সংগীতে একটি অভিনেতার চরিত্র জুড়ে দেন ; তবে এই চরিত্রটিতে মূক অভিনয় করতে হত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চরিত্রের মুখোশ পরে । এই ঐতিহ্য অনুসরন করেই এসকাইলাস (আসকাইলাস) তাঁর প্রথম ‘The Suppliants’ রচনা করেন খ্রীস্টপূব ৪৯০ শতকে এবং এই নিয়মের মধ্যে কিছু পরিবর্তন ঘটান । এই নাটকে তিনি দুটি অভিনেতার ব্যবস্থা করেন এবং তাদের মুখে কিছু ভাষা জুড়ে দেন । এমনিভাবে এক কালের উপাসনা সংগীত ধীরে ধীরে নাটকে পরিনত হয় । গোড়াতে আজকের অর্থে মঞ্চ বলে কিছুই ছিল না । এসকাইলাস (আসকাইলাস) নাটক করতেন পাহাড়ের উঁচু জায়গায় কোন রকমে একটু ব্যবস্থা করে নিয়ে । দর্শকবৃন্দ নিচে বসে উন্মুক্ত মাঠে বসে সে অভিনয় দেখত । নাট্যকার নাটক লিখে নিজেদের দলবল নিয়ে তা তৈরী করতেন এবং সেটা মঞ্চস্থ করবার ব্যায়ভার বহন করতেন সমাজের ধনী সম্প্রদায় । তখনকার দিনে নাট্যকারই ছিলেন মূল ব্যক্তি এবং তাকে ঘিরেই নাট্যসম্প্রদায় গড়ে উঠতো । নাট্য সম্প্রদায়ের এই উৎসাহের দরুনই উন্মুক্ত পাকা মঞ্চ গড়ে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে । এসকাইলাস(আসকাইলাস)এর পর যিনি গ্রীক নাটকে আবির্ভূত হন তিনি হলেন নাট্য ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব সোফোক্লেস (Sophocles) তাঁর হাতেই নাট্যকলার বিভিন্নমুখী অগ্রগতি ঘটে । তিনি প্রথম Trilogy প্রথা তুলে দিয়ে সেটার পরিবর্তে পৃথক পৃথক বিষয়ের ওপর তিনটি নাটক মঞ্চস্থ করেন । ধীরে ধীরে নাটকে সংলাপের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় । থেসপিস থেকে আরম্ভ করে সোফোক্লেস পযর্ন্ত নাটকগুলোতে একটানাভাবেই রূপকথার গল্প , রাজ-রাজড়ার কাহিনী এবং তদুপরি দেবতার প্রার্দুভাব লক্ষ্য করা যায় । সাধারন মানুষের জীবন আচার এই নাটকগুলোতে প্রবেশাধিকার পায়নি । কিন্তু সোফোক্লেসের চাইতে দশ বছরের কনিষ্ঠ ইউরিপিডেস জীবনকে দেখতে আরম্ভ করেছিলেন অন্য দৃষ্টিতে । নাটককে তিনি বাস্তব ও সাধারণ মানুষের মধ্যে নিয়ে এসে সেটার মাধ্যমে জীবনদর্শন তুলে ধরবার জন্যে আগ্রহান্বিত হয়ে ওঠেন । গল্পের সন্ধানে তিনিও রূপকথার দ্বারস্থ হয়েছেন কিন্তু রূপকথার রাজা-রানী আর ভগবানকে বাদ দিয়ে সব চরিত্রকে সাধারনণ মাটির মানুষে পরিনত করলেন । তিনিই প্রথম রূপকথা উপকথার অবাস্তব দেশ থেকে নাটককে মাটির ধরণীতে সাধারণ মানুষের কাছে হাজির করে দেন । এজন্যেই নাট্যজগতে বাস্তববাদের পথপ্রদর্শক হলেন ইউরিপিডেস । তাঁর পথ ধরেই খ্রীস্ট পূর্ব ৪২৫ শতকে এরিস্টোফ্যানিস রচনা করেন ‘The Acharnians’ যেটি একটি যুদ্ধ বিরোধী নাটক । এতে নাট্যকার রাজনীতির প্রতি কটাক্ষ করেছেন । তাছাড়া তাঁর নাটকের মধ্যে ধনী- দরিদ্রের সমস্যাও দেখা দেয় প্রবল করে । তাঁর প্রতিটি নাটকই প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে । এরিস্টোফ্যানিস এর মৃত্যুর পর এথেন্সের রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটে এবং বুর্জোয়া সভ্যতার সূচনা হতে থাকে । মানুষের চিন্তার মধ্য থেকে সকল দেবতাই বিদায় নিতে বাধ্য হয় একমাত্র প্লুটাস (Plutus) টিকে থাকে । বণিক মনোভাব প্রবল হয়ে ওঠে এবং অর্থোপাজর্নটা বড় হয়ে দেখা দেয় । এই সময় সারা গ্রীস জুড়ে ব্যাপক মঞ্চ-তৎপরতা দেখা দেয় । পুরানো নাট্যশালার সংস্কার করা হয়, অর্ধবৃত্তাকারে নতুন মঞ্চশালা তৈরী হয়, মঞ্চসজ্জায় বিস্তর পরিবর্তন ঘটে এবং মঞ্চ দ্রুতগতিতে বাস্তবতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে । এই যুগের উল্লেখযোগ্য নাট্যকার মেনানডার (Menander) তাঁর কোন কোন নাটক আজকের দিনের নাটকের তুলনায়ও বেশী আধুনিক । খ্রীস্টপূব দুই শতাব্দী পযর্ন্ত গ্রীক নাটকের এই বিস্তৃতি এবং এখানেই গ্রীক মঞ্চের প্রাচীন ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে ।

রোমানঃ       গ্রীক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গড়ে উঠে রোমান সাহিত্য ও মঞ্চকিন্তু রোমান নাটকের মধ্যে বহির্মুখীন দৃষ্টিভঙ্গিটাই প্রবল । গ্রীকদের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই রোমের নাট্যশালা গড়ে ওঠে এবং সৃষ্টি হয় ল্যাটিন নাটকের । কর্ডোভার অধিবাসী সেনেকা হলেন রোমান মঞ্চের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাট্যকার । তিনিই প্রথম নাট্যকার যিনি নাটককে পাঁচ অংকে ভাগ করেন । তাছাড়া সমবেত সংগীত কমিয়ে তা একেবারে নামে মাত্র রাখেন এবং প্রস্তাবনা অংশকে নাটকীয় ঘটনায় পরিনত করেন । গ্রীক আমলে নাট্যশালাগুলো তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল – Auditorium, Orchestra এবং Stage কিন্তু রোমানগণ চতুর্দিকে দেয়ালবেষ্টিত একটি পেক্ষাগৃহের মধ্যে উপরোক্ত তিনটি ভাগকে একত্রে সন্নিবেশ করেন । মঞ্চসজ্জার জাঁকজমক বৃব্ধি পায় এবং মঞ্চের সম্মুক্ষভাগে একটি পর্দা প্রথা চালু হয় । রোমান যুগে উপরোক্ত অগ্রগতি ব্যাতীত মঞ্চের ক্ষেত্রে আর বিশেষ কোন অগ্রগতি ঘটেনি ।

প্যালেস্টাইনঃ প্যালেস্টাইনের অধিবাসী হিব্রুগন একটি অত্যন্ত প্রাচীন জাতি । সমস্ত প্রাচ্য ভূমিতে হিব্রু জাতির বাসভূমি প্যালেস্টাইনই হলো দ্বিতীয় জায়গা যেখানে প্রাচীন যুগেও নাট্য-সাহ্যিতের অস্তিত্ব আমরা খুঁজে পাই । তবে প্যালেস্টাইনে কোথাও নাট্যাভিনয় হত কিংবা নাট্যমঞ্চের অস্তিত্ব ছিল এমন প্রমান পাওয়া যায় না“The book of Job” হিব্রুজাতির একমাত্র নাট্যগ্রন্থ  । জব (খ্রীঃ পূঃ ৩৫০) গ্রীক ট্র্যাজেডির আঙ্গিকে এই নাটকটি রচনা করেছিলেন ।

চৈনিকঃ      খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বিশেষ বিশেষ ধর্মানুষ্ঠানে সমবেত নাচ গান এবং নীরব অঙ্গভঙ্গি জুড়ে দেয়া হতো । এই ধর্মানুষ্ঠানই কালক্রমে পরিবর্তন পরিমার্জিত হয়ে অবশেষে ধর্মীয় নাটকে রূপান্তরিত হয় । এর পর প্রায় একাদশ শতক পযন্ত চৈনিক নাট্য ইতিহাসের পাতা প্রায় শূন্যএকাদশ শতকে তাতারদের মধ্যে মঞ্চাভিনয়ের প্রমান পাওয়া যায় । অবশেষে ত্রয়োদশ শতকে মোঘল (মোঙ্গোল শাসনকালে চীনে একটি নাটক মঞ্চস্থ হয় । সেই সময় কয়েকটি ব্যবসায় প্রতিষ্টান নাট্য প্রযোজনা শুরু করে । যদিও মঞ্চায়নের আয়োজন ও উপকরণ খুবই সামান্য ছিল  কিন্তু নাটকের পাত্র-পাত্রীগন খুবই ব্যয়বহুল ও জাঁকজমক পোষাক ব্যবহার করতেন  । মঞ্চসজ্জার অভাবে বাস্তবতার পরিবেশে যে ঘাটতি হত তা পূরণ করতে হত অভিনেতাদের অভিনয়ের মাধ্যমে । তৎকালে চীনে নাটককেমিলিটারীসিভিলদুটি শ্রেনীতে ভাগ করা হত । মিলিটারী শ্রেণী বিভাগের মধ্যে ঐতিহাসিক ঘটনা বা চরিত্র সংযোজিত হত এবং যুদ্ধ , মারামারি, খুনোখুনির দৃশ্য সংযোজিত হত স্বাভাবিকভাবেই । সিভিল নাটকের বিষয়বস্তু ছিল সাধারন মানুষের জীবনকথা, বিশেষ করে পারিবারিক জীবন । মধ্যযুগের চৈনিক নাট্যকারদের মধ্যে ওয়াং শিহক বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য । তাঁর তেরোটি নাটক আজও টিকে আছে ।

 

 

নাটকের ভাগঃ নাটক কে সামাজিক; ধর্মীয়; ট্র্যাজেডি; কমেডি; ট্র্যাজিকমেডি; রোমান্স ; স্যাটায়ার; পলিটিক্যাল; মহাকাব্য;  গীতিকবিতা ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে এবং তাদের পরিবেশনার উপর ভিত্তি করে প্রাথমিক ভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। ১) শ্রুতি নাটক; ২) মূকাভিনয় এবং ৩) মঞ্চনাটক। নামকরণ থেকেই এদের পরিবেশনার আঙ্গিক বুঝে নেওয়া যায়। এদিকে  ভরতের নাট্যশাস্ত্র বিচারে রস ৮ প্রকার। এগুলো হলোশৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস ও অদ্ভুত  নাট্যশাস্ত্রের শান্তরসকে করুণ রসের অন্তর্গত বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে রস কি ? রস হলো এমন একটি বার্তা, যা তথ্যগ্রাহকের কাছে বিশেষ অর্থবহ হয়ে উপস্থাপিত হয়। ভারতীয় নাট্য, কাব্য ও অলঙ্কার শাস্ত্রে এই অর্থবহ বিশেষ বার্তাকে রস বলা হয়।

রসের আক্ষরিক অর্থ হলো আস্বাদনীয় বা রসনাগ্রাহ্য গুণবিশেষ। এই বিচারে রস ছয় প্রকার। এগুলো হলো মধুর, অম্ল, লবণ, কটু, কষায়, তিক্ত। কিন্তু ভারতীয় নাট্য, কাব্য ও অলঙ্কার শাস্ত্রে রসের রূপ ভিন্নতর। এই রস সৌন্দর্যবোধের একটি ভিন্নতর দশায় উপস্থাপন করা হয়। প্রত্যক্ষ স্বস্তি-অস্বস্তিবোধের সূত্রে যে আনন্দের সৃষ্টি হয়, তার প্রত্যক্ষভাবে ইন্দ্রিয়ের অধীন। মানুষ একে বাস্তব সত্য দিয়ে অনুভব করে। ভারতীয় নাট্য শাস্ত্র বলছে “কল্পলোকের ভাবনার সাথে বাস্তবজগতের সাযুজ্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টার ভিতরে সামঞ্জস্য রক্ষা করাটা জরুরি। সততা এবং সামঞ্জস্যের ভিতর দিয়ে অভিনেতারা ছোটো ছোটো আনন্দ তৈরি করেন। এই সব আনন্দের সমন্বয়ে গড়ে উঠে সুন্দর উপস্থাপন। আর ভিতর দিয়ে মনের গভীরে যে নানারূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি এবং মনকে দ্রবীভূত করে, তাই হলো রস”।

আগেই লিখেছি ভরত মুনির সম্পর্কে আলাদা করে কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল। তাঁর সম্পর্কে কিছু শব্দ লিখে পাড়ি দেব মধ্যযুগ হয়ে আধুনিক যুগে – প্রবেশ করব বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে। ভরত মুনি সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমে এটাই বলতে হয় ভরত মুনি (খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দীর) একজন প্রাচীন ভারতীয় লেখক যাঁর "ভরতের নাট্যশাস্ত্র" নামের গ্রন্থটি আজও নাট্য গবেষকদের কাছে নতুন চিন্তার আবেদন রাখে। এতে এমন একটি থিয়েটারের রূপ তুলে ধরা হয়েছে যা ব্যাখ্যা করেছে নাচ, অভিনয়, এবং সঙ্গীত সহ নাটকের এক সম্পূর্ণ রূপ। এটি এমন একটি তাত্ত্বিক গ্রন্থ হিসাবে পরিচিত যাকে অ্যারিস্টটলের "পোয়েটিকের" সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ভরত ভারতীয় থিয়েটারি শিল্পকলার জনক হিসেবে পরিচিত। তাঁর "নাট্যশাস্ত্র" নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এবং কৌশলে শিল্প, নাটক এর বিকাশের প্রথম প্রয়াস বলে মনে হয়। নাট্যশাস্ত্র আমাদেরকে একটি নাটকে কি চিত্রিত করা হয় তাই শুধু বলে না, বরং কিভাবে চিত্রাঙ্কন করতে হবে তাও বলে। ভরত মুনি বলেন, নাটক মানুষ ও তাদের কাজকে (লোকা-বৃতি) অনুকরণ করে। মানুষ এবং তাদের কৃতকর্মকে মঞ্চে সম্মান করতে হবে, শুধু  তাই নয় সংস্কৃত নাটকে এছাড়াও রূপক রয়েছে, যার মানে চিত্রাঙ্কন করা।

নাটকে মধ্যযুগঃ ইউরোপীয় নবজাগরণের সময় নাটক নিয়ে নানা পরীক্ষা শুরু হয়ে। ইতালিতে মঞ্চের দ্বিবিধ উন্নতি সাধিত হয় । ক্লাসিকাল মঞ্চের রীতিতেই অভ্যন্তরে মঞ্চ গড়া হয় এবং Three dimensional effect বা ত্রিমাত্রিক দৃশ্যসজ্জার মাধ্যমে ব্যাপ্তি ও গভীরতা আনার চেষ্টা করা হয় । তাছাড়া দর্শকবৃন্দের বসবার জায়গা থেকে পাঁচ ফুট উঁচুতে মঞ্চ স্থাপন করা হয় । মঞ্চ পুনর্গঠন ও সাজসজ্জার ব্যাপারে প্রায় অর্ধ শতাব্দী কাল ধরে ইতালীয় মঞ্চাধ্যক্ষগন নানা প্রকার পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান এবং সেটার সাফল্যজনক পরিসমাপ্তি ঘটে ১৫৮৪ খ্রীস্টাব্দে Teatro Olimpico নাট্যমঞ্চে এই একই সময়ে ফ্রান্সে কিছু পেশাদার মঞ্চ গড়ে ওঠে । জনসাধারনের মধ্যে নাট্য তৎপরতা বেড়ে যায় । এই যুগে বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য নাট্যকার আলেকজেন্ডার হার্ডি(Alexander Hardy)। তিনই প্রায় ছয়শত নাটক রচনা করেন । রোমান্টিসিজম এই সময়ের নাটকের মূল চরিত্র । স্পেনীয় মঞ্চ যখন প্রায় প্রাগৈতিহাসিক পযায়ে বিরাজমান তখন সে দেশে মঞ্চ আন্দোলনের গোড়াপত্তন ঘটে । তারপর মাত্র অর্ধশতাব্দীর মধ্যে এক অত্যন্ত গৌরবময় ঐতিহ্য গড়ে তোলে স্পেনের মঞ্চ । এই ঐতিহ্যের সবশেষ স্থপতি লোপ দ্য ভেগা (Lope De Vega) তিনি প্রায় সতেরশ নাটক রচনা করেন যার চারশ নাটকের আজো অস্তিত্ব আছে । দর্শক যা আশা করবে এবং তাদের জন্য যা পরিবেশন করা প্রয়োজন সেটাই ছিল নাট্য রচনাকালে তার বিবেচ্য বিষয় । এই সময়ে পিছিয়ে থাকে নি ইংল্যান্ডও। রানী এলিজাবেথ মঞ্চাভিনয় খুব পছন্দ করতেন । রানীর এই নাট্যপ্রিয়তা একধিকে যেমন নাট্যকার ও শিল্পীদের উৎসাহিত করেছে অন্যদিকে নাট্য আন্দোলনকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করেছে । এলিজাবেথের সময় নাট্যকারের সংখ্যা ছিল অনেক । এদের মধ্যে বিস্ময়কর ক্ষমতার অধিকারী ক্রিস্টোফার মার্লো সবার্গ্রে স্মরনীয় । ইংল্যান্ডে বিপ্লবাত্মক নাট্য দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ছিলেন মার্লো । মার্লো ১৫৮৮ সালে Dr. Faustus নামে একটি নাটক রচনা করেন যা পরবর্তীতে শেক্সপীয়রের সমস্ত ট্রাজেডি নাটকের মূল উৎস ও অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে । তাঁর অন্যান্য লেখার মধ্যে The Jew of Malta বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এর পরে শুরু হয় SHAKESPEARE যুগ। শেক্সপীয়রের অতুলনীয় নাট্যপ্রতিভা নিয়ে গত দুই শতাব্দীকাল সমগ্র পৃথিবীতে এতো বেশী আলোচনা হয়েছে যে অন্য কোন নাট্যকারের রচনা নিয়ে তা হয়নি । শেক্সপীয়রের যাত্রা শুরু হয় মার্লোর আদর্শে । তাছাড়া গ্রীন ও টমাস কীডের প্রভাবও ছিল তাঁর মধ্যে । দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বনাট্যমঞ্চে যে বিবর্তন সংঘটিত হচ্ছিল সেটার এক বড় অধ্যায়ের সাফল্যজনক পরিণতি ঘটেছে শেক্সপীয়রে । তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে কিং লিয়ার, লেডী ম্যাকবেথ, অ্যান্টনিও এবং ক্লিয়োপেট্টা, রোমিও জুলিয়েট, জুলিয়া সিজার অন্যতম ।

নাটক রচনা থেকে আরম্ভ করে প্রযোজনা, পরিচালনা, অভিনয়, মঞ্চসজ্জা, আলোকসম্পাত প্রভৃতি নিয়ে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নানা রকম পরীক্ষা চলে ১৮৩০ থেকে ১৮৭০ খ্রীস্টাব্দ পযর্ন্ত। ফলে নাট্যজগতে এক নতুন যুগের সূচনা হয় । এই সময়ের মধ্যে এবং নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয় । ১৮২০ খ্রীস্টাব্দে মঞ্চে গ্যাসলাইটের ব্যবহার শুরু  হয় । এতোকাল অবধি মোমবাতি বা ল্যাম্প জাতীয় কিছু জ্বালিয়ে মঞ্চ আলোকিত করা হত । গ্যাস লাইট চালু হওয়ার পর থেকে আলোক নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে সহজ হয়ে আসে । এর ফলে আলো আঁধারির এবং পর্দা প্রথার প্রবর্তন কৌশলে দর্শকদের মধ্য থেকে অভিনেতাগনকে আলাদা করে নেয়া সম্ভব হয়। এরপরে আসে ইবসেন যুগ। নবনাট্য পর্ব। এই সময়ে ইবসেন ছাড়াও নুট হামসন(The Game of life, 1894), জোনাস লী (The Merry Wives, 1894), আলেকজান্দার কিল্যাগু (The Couples, 1886; The Professor, 1888), গানার হিবার্গ (The Balcony, 1894; The Love’s Tragedy, 1904) এঁরা সকলই বাস্তববাদী নাট্য-আন্দোলনের প্রবক্তা ও কর্মী । এছাড়া আরেকজন উল্লেখযোগ্য ও সাথে সাথে বিতর্কীত চরিত্র হলেন স্ট্রীন্ডবার্গ । দীর্ঘ চল্লিশ বছরে তিনি ষাটটি নাটক, ত্রিশটির অধিক উপন্যাস রচনা করেন । তাছাড়া আন্তচরিত্র, রাজনীতি এবং ইতিহাসও তাঁর রচনার অন্তরভুক্ত । এর পরে নাট্য ইতিহাসে  নতুন আরেকটি নাট্যরীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যা নিও-রোমান্টিসিজম বলে পরিচিত । ১৮৭৬ সালে মার্লামের ‘Lapres-mindi due faune’ নামক নাটকের মাধ্যমে নিও-রোমান্টিসিজমের সূচনা ঘটে । সূচনা নিয়ে মতভেদ থাকলেও এই নাটকের মধ্য দিয়েই যে প্রতীকধর্মী কাব্যনাট্যের যাত্রা শুরু হয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই । এর পরে এলেন বিশ্বখ্যাত মনীষী জর্জ বার্নার্ড শ তাকেই নাটকের আধুনিক যুগের  পুরোধা বলা যেতে পারে। ১৮৯২ সালে তিনি নাট্যকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন বার্নার্ড শএর নাটকে মূল লক্ষ্য হল Creative Evolution বা সৃষ্টিমূলক বিবর্তন । এই লক্ষ্য সমনে রেখেই ১৯০১ সালে রূপকথার গল্প ডন জুয়ানঅবলম্বনে নাটক রচনা আরম্ভ করেন এবং এর বিশ বছর পর আবার ঐ একই উদ্দেশ্যে "গার্ডেন অফ ইডেনঅবলম্বনে অবিস্মরনীয় নাটক ‘Back to Methuselah’ রচনা করেন ‘Would Drama’ গ্রন্থে এলারডাইস নিকল এক জায়গায় বার্নার্ড শসম্পর্কে মন্তব্য করেছেন- এই যুগটা খুব সম্ভবত, নাট্য-ইতিহাসের শুধু একজনের যুগ- তিনি জর্জ বার্নার্ড শ ।

নাটক নিয়ে যে কোন আলোচনায় যাঁদের নাম বার বার উঠে আসে তাঁদের নাম হল স্তানিস্লাভস্কি ও ব্রেখট্‌। স্তানিস্লাভস্কি (প্রকৃত নাম আলেকসেয়েভ) কনস্তান্‌তিন সেরগেয়েভিচ (১৮৬৩-১৯৩৮), রুশ পরিচালক, অভিনেতা, নাট্যতাত্ত্বিক , সোভিয়েত ইউনিয়নের এ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের অনারারি এ্যাকাডেমিশীয়ান (১৯২৫), রাশান এ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের অনারারি এ্যাকাডেমিশীয়ান (১৯১৭) সন। তাঁর শিল্পকর্ম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে রুশ এবং বিশ্ব নাট্য শিল্পে। ১৮৭৭ সালে শৌখিন অপেশাদার নাট্যশিল্পী গোষ্ঠী যেমন আলেকসেয়েভস্কি সারকল, সোসাইটি অব আর্ট এ্যান্ড লিটারেচার সংগঠিত হয়েছে। ১৮৯৮ সালে ভ. ই. নেমিরোভিচের সাথে একত্রে প্রতিষ্ঠা করলেন মস্কো আর্ট থিয়েটার। প্রথমবারের মত তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন মঞ্চনাটক পরিচালনার মূলতত্ত্ব, নাটকের সবগুলো আবশ্যিক উপাদান মেনে নিয়ে শিল্প পরিকল্পনার ঐক্য, অভিনেতাদের অখন্ডতা, মঞ্চ সাজানোর মনস্তাত্ত্বিক শর্তাধীনতা। প্রযত্ন করেছেন নাটকে কাব্যিক আবহাওয়া সৃষ্টিতে, প্রতিটি উপাখ্যানে সঠিক মেজাজটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে , প্রতিটি চিত্রকল্পকে নির্ভরযোগ্য প্রাণ দিতে, অভিনেতার উদ্বেগকে প্রামাণিকতা দিতে। তিনি তৈরী করেছেন অভিনয়কলার পদ্ধতি সমূহ, অভিনয়ের শারিরীক অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ব্যবহারকে মানস কল্পচিত্রে রূপান্তরণ (সিস্টেম অব স্তানিস্লাভস্কি )।

এরপর এলেন ব্রেখট্‌। বের্টোল্ট ব্রেখট(জন্ম : ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৮, আউসবুর্গ, বাভারিয়া, জার্মানিমৃত্যু : ১৪ আগস্ট, ১৯৫৬, পূর্ব বার্লিন, জার্মানি)।একজন বিখ্যাত জার্মান কবি, নাট্যকার ও মঞ্চ পরিচালক। বিশ্বের প্রচলিত নাট্য ধারার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের নাম ব্রেখট। বেভারিয়ান বিপ্লব চলাকালে লিখলেন প্রথম নাটক বাল। ১৯২১ সালে পড়ালেখার পাট চুকিয়ে শুরু করেন নাট্য সমালোচনা। ১৯২৮ সালে এসে তিনি রচনা করেন তাঁর বিশ্ববিখ্যাত নাটক দ্য থ্রিপেনি অপেরা। ১৯৩০ সালে ব্রেখট মঞ্চায়ন করেন তাঁর সমাজতান্ত্রিক ধারার প্রথম কমিউনিস্ট নাটক দ্য মেজার্স টেকেন। ১৯৩২ সালে তিনি হান্স ইসরায়েলের সঙ্গে নির্মাণ করেন প্রথম চলচ্চিত্র কুলে ওয়াম্পে। ছবিটি জার্মানিতে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ৪০টিরও বেশি নাটক ও অপেরা লিখেছেন। তাঁর রচনায় মানবতা আর বিশ্বভ্রাতৃত্বের পাশাপাশি যুদ্ধ আর শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে। ইউরোপীয় মঞ্চ নাট্যের আলোচনা বাধ্য হয়ে এখানে অসমাপ্ত রাখলাম। শুধু বলে যাই, আধুনিক পথ নাটকের সূত্রপাত ও কিন্তু ইউরোপ এবং সঠিক ভাবে বলতে গেলে সোভিয়েত রাশিয়া থেকেই।

শুধু মাত্র বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে সেখানে ভারতের নাটকের ইতিহাস বা পৃথিবীর নাটক নিয়ে বলতে গেলে অন্ধের হস্তিদর্শন করাও হয় না ফলে সে চেষ্টায় এখানেই ইতি।

বাংলা নাটকের ইতিহাসঃ বাংলা নাটক নিয়ে লিখতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় যদিও অষ্টাদশ শতকে প্রথম বাংলা নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠা হয় তবু বাংলা নাটকের ইতিহাস অনেক পুরানো। এক অর্থে যাত্রা কে বাংলা নাটকের জনক বলা যেতে পারে। এমনকি এও বলা যেতে পারে বর্তমান পথ নাটক যাত্রার দেখানো পথ অনুসরণ করে চলেছে। যাত্রা বলতে বর্তমানে যা হয় তা আসল যাত্রা নয়। দেবপূজা উপলক্ষে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গার উদ্দেশ্যে যাত্রা অর্থাৎ যাওয়ার সময় নৃত্য-গীতের প্রয়োজন হত । নৃত্যগীত সম্বলিত এই যে যাওয়া অর্থাৎ যাত্রা সেটাকে তখন বলা হতো নাটগীত বা গীতনাট । দেবপূজা সংক্রান্ত উপরোক্ত যাত্রার মুহূর্ত থেকেই সমস্ত চলার পথে এ নৃত্য-গীত চলতো এবং গন্তব্যস্থলে উপস্থিত হওয়ার পরও নৃত্যগীত ও অভিনয় জাতীয় কিছু অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে দেবলীলার মহিমাকীর্তন করা হতো সমবেত উৎসুক জনতার সামনে । আমাদের লোকনাট্য যাত্রাভিনয়ের আদি-পর্ব এটাই ।

আধুনিক বাংলা নাটকের শুভারম্ভ কোন বাঙালির হাত ধরে হয় নি। এ কাজের কর্তা ছিলেন এক রাশিয়ান – নাম হেরাসিন লেবেডেফ অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে পৃথিবীর অনেক দেশ পরিভ্রমণ করে অবশেষে কলকাতায় এসে ব্যবসায়ভিত্তিক নাট্যশালা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৭৯৫ সালে ২৫ নং তৎকালীন ডোমতলীতে (বর্তমানে এজরা স্ট্রীট) বেঙ্গলী থিয়েটার নামে একটি নাট্যশালা স্থাপন করেন লেবেডেফ । পশ্চিমা রীতিতে সজ্জিত তাঁর এই নাট্যশালায় তিনি বাংলা ভাষায় লেখা নাটক বাংলা ভাষাভাষী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দিয়েই অভিনয় করানোর সিব্ধান্ত নেন । এদুটি নাটকই ছিল অনুবাদ বা বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত নাটক। এই নাটক দুটি ছিল- The Disguise এবং Love is the best doctorদুটি নাটকই ছিল প্রহসন মূলক - হাস্য রসাত্মক। আরও উল্লেখযোগ্য- এ নাটক দুটিতে মহিলা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মহিলা শিল্পীরাই।  অবশ্য তার আগেও মঞ্চাভিনয় হয়েছিল তবে সেটা সাহেব পাড়াতে । সেই নাটক দেখবার সুযোগ সাধারন বাঙালীর ভাগ্যে জোটেনি । বাংলা নাট্যমঞ্চে শেক্সপীয়রীয় নাটকের আবির্ভাব ঘটে ১৭৫৫ সালে কলকাতায় এলিজাবেথীয় ঢং-এ নাট্যশালা দি প্লে হাউসস্থাপনের মাধ্যমে । তখন যবনিকা ব্যবহৃত হতো এবং মঞ্চের দুপাশে শিল্পীদের আগমন নির্গমনের জন্যে উইংস ব্যবহার হত । কিন্তু তখন দৃশ্যপট অঙ্কন বা দৃশ্য-পরিবর্তনের সাথে সাথে মঞ্চ-সজ্জা পরিবর্তনের কোন ব্যবস্থা ছিল না । একই পরিবেশ ও অপরিবর্তনীয় দৃশ্যসজ্জার মধ্যেই গোটা নাটক অভিনীত হত । এই প্রতিবন্ধকতার পরও ইনডোর স্টেজ শোবা কাভার্ড স্টেজ শোএর সূচনা হয় এদেশে দি প্লে হাউসপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই  (যা আগেই বলেছি)। এটিই শেক্সপীয়রীয় আদর্শে প্রতিষ্ঠিত বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের আধুনিক নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠার প্রথম পথপ্রদর্শক । এই নাট্যমঞ্চ বছর চারেক টিকে ছিল । এরপর ১৭৭৫ সালে দ্বিতীয় নাট্যমঞ্চ দি ক্যালকাটা থিয়েটারএবং এর কিছুদিন পর দি নিউ প্লে হাউসহোয়েলার প্লেস থিয়েটারস্থাপিত হয় । এই নাট্যশালাগুলোতে হ্যামলেট’, ‘দি মার্চেন্ট অব ভেনিস’, ‘তৃতীয় রিচার্ড’, ‘চতুর্থ হেনরীপ্রভৃতি নাটকগুলো অভিনীত হত । সে আমলের প্রখ্যাত অভিনেত্রী মিস ব্রিস্টো ১৭৮৯ সালে আরও একটি নাট্যমঞ্চ পত্তন করেছিলেন । বাংলাদেশের মাটিতে শেক্সপীয়রীয় নাটকের আদি-পর্ব বলে চিহ্নিত করা হয় এই সময়টাকে । অবশেষে শিক্ষিত বাঙালীর মনোজগতে শেক্সপীয়রীয় চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটে উনবিংশ শতকের প্রথম দশকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর । উক্ত কলেজের এক বিদেশী ছাত্র মি. মংকটন দি টেম্পেস্টনাটকের বঙ্গানুবাদ করেন ১৮০৯ সালে । শেক্সপীয়রীর নাটকের বাংলাভাষায় রূপান্তর এই প্রথম । এর পর ১৮১৩ সালে স্থাপিত হয়চৌরাঙ্গি থিয়েটারএই সময় থেকেই বাঙ্গালী-মানসে শেক্সপীয়রীয় ভাবধারা সংক্রমিত হতে আরম্ভ করে । এই সংক্রমন আরও জোরদার হয় ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে । ১৮৩০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী টাউন হলে অনুষ্ঠির পুরষ্কার বিতরণী সভায় হরিহর মুখোপাধ্যায় এবং আর কিছু ছাত্র শেক্সপীয়রের বিভিন্ন লেখা থেকে আবৃত্তি করেছিলেন । পরের বছর ১৯ ফেব্রুয়ারী সেই টাউন হলেই মার্চেন্ট অব ভেনিসএর প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্য অভিনীত হয় এবং তাতে অংশগ্রহন করেন কৈলাশচন্দ্র দত্ত, রামগোপাল ঘোষ, তারকনাথ ঘোষ, ভুবনমোহন মিত্র, তারিনীচরণ মুখোপাধ্যায় ও হরিহর মুখোপাধ্যায় শেক্সপীয়রীয় নাটকে বাঙালীর অংশগ্রহন এটাই প্রথম ।

এতখানি দীর্ঘ সময়ের পরেও কিন্তু প্রকৃত  অর্থে  বাংলা নাট্যমঞ্চ গড়ে উঠেনি । এর পরের যুগটাই বাবু কালচারনামে পরিচিত । এই সময় বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুর ১৮৩১ সালে বেলেঘাটার অন্তর্গত শুঁড়োর বাগানবাড়ীতে হিন্দু থিয়েটারের গোড়াপত্তন করেন । হিন্দু থিয়েটারের প্রথম নাটকের ভাষা ছিল ইংরেজী যদিও বিষয়বস্তু ছিল ভারতীয় উত্তর রামচরিত । কিন্তু এই নাট্যমঞ্চও দুবছরের বেশী টিকে থাকেনি । কারন সেই সময় গোটা কলকাতায় ইংরেজী জানা লোকের সংখ্যা ছিল খুবই কম । এর ঠিক পরপরই ১৮৩৩ সালে আবির্ভূত হন নবীনচন্দ্র বসু তাঁর নিজ বাড়ীতে নাট্যশালা স্থাপনের মাধ্যমে । ১৮৩৫ সালের ৬ অক্টোবর এই নাট্যশালায় বিদ্যাসুন্দরঅভিনীত হয় অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে । এই নাটকের পাত্র-পাত্রী সবাই ছিলেন বাঙ্গালী । অর্কেস্ট্রায় ব্যবহৃত হয়েছিল দেশী বাদ্যযন্ত্র । কয়েক বছর নাট্য-প্রযোজনা করে নবীনচন্দ্র বসু লাখ লাখ টাকা গচ্চা দিয়েছিলেন । ফলে এই নাট্যশালাও বেশী দিন টিকে থাকেনি । এভাবে ১৭৯৫ থেকে উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ প্রযর্ন্ত প্রচুর সখের নাট্যভিনয় হত । পেশাদারী নাট্যমঞ্চ তখন গড়ে উঠেনি ।

১৮৫৮-এ বাংলার নাট্যক্ষেত্রে প্রবল আবির্ভাব হল মধুসূদন দত্তর, ‘শর্মিষ্ঠানাট্য রচনার মধ্য দিয়ে। মহারাজা যতীন্দ্রমোহন সিংহর বেলগাছিয়া নাট্যশালায় অভিনীত হল ১৮৫৯-এ। এলেন দীনবন্ধু মিত্র, ১৮৬০-এ লিখলেন নীলদর্পণ ১৮৬৮-তে প্রতিষ্ঠিত হল বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার। এই সংগঠনের মধ্যেই নিহিত ছিল বাঙালির সাধারণ নাট্যশালা গঠনের বীজ। বাগবাজারের কিছু উৎসাহী যুবকঅর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি, রাধামাধব কর, নগেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ নাট্যদল গঠন করে অভিনয় করলেন দীনবন্ধু মিত্রর সধবার একাদশী১৮৭২-এর ১১ই মে তাদের দ্বিতীয় নাটক লীলাবতীঅভিনীত হয় এবং আশাতীত সাফল্য লাভ করে। লীলাবতীর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে নিয়মিত নাট্যাভিনয়ের লক্ষ্যে একটি সাধারণ নাট্যশালাপ্রতিষ্ঠার কল্পনা করেন তাঁরা, যেখানে বিত্তশালীদের কৃপাপ্রার্থী না হয়ে টিকিট বিক্রয় করে সর্বসাধারণকে নাট্যাভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ করা যাবে।

অর্ধেন্দুশেখর, অমৃতলাল বসুদের কল্পনা বাস্তবায়িত হল - প্রতিষ্ঠিত হল বাঙালীর সাধারণ রঙ্গালয়। চিৎপুরে মধুসূদন সান্যালের গৃহপ্রাঙ্গণ ৩০ টাকায় ভাড়া নিয়ে মঞ্চ নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠিত হল ন্যাশানাল থিয়েটার১৮৭২ সনের ৭ই ডিসেম্বর দ্বারোদ্ঘাটন হল বাংলার সাধারণ নাট্যালয়ের -  দীনবন্ধু মিত্রর নাটক নীলদর্পণঅভিনয়ের মধ্য দিয়ে।

সেই শুরু  বাঙালীর পেশাদারী মঞ্চ ও মঞ্চাভিনয়ের। নানা ভাঙা-গড়া,উথ্বান-পতন, শাসকের রক্তচক্ষু, বিরোধ-মিলনের সাক্ষী হয়ে, অর্ধেন্দুশেখর- অমৃতলাল - গিরিশচন্দ্র অমরেন্দ্রনাথ দত্ত- বিনোদিনী- তারাসুন্দরী-প্রভা দেবী - শিশির ভাদুড়ি হয়ে যে ধারাবাহিকতা আজও বহমান। মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, মন্মথ রায়, বিধায়ক ভট্টাচার্য প্রমুখ কত নাট্যকার বাঙালীর নাট্য ইতিহাসকে  গত দেড়শো বছর ধরে সমৃদ্ধ  করে গেছেন এবং আজও কত নবীন নাট্যকার - নাট্য পরিচালক - নাট্য কর্মী সেই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন।

 ন্যাশনাল থিয়েটারের সঙ্গে গোড়া থেকেই যাঁরা সম্পৃক্ত ছিলেন তাঁরা হলেন পরবর্তীকালের বাংলা নাট্যমঞ্চের দিকপাল গিরিশচন্দ্র ঘোষ, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী, রামমাধব কর, নন্দলাল ঘোষ, বেলবাবু, অমৃতলাল বসু, মতিলাল সুর, তিনকড়ি মুখোপাধ্যায় প্রমুখ । তাঁদের মধ্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষকে আধুনিক বাংলা নাটকের জনক বলা হয় । নাট্যজগতে তাঁর আগমন অভিনেতা হিসেবে । তারপর কখনো বা নাট্যশিক্ষক, কখনো নাট্যশালার ম্যানেজার, আবার কখনো নাট্য পরিচালক । সব শেষে তিনি নাট্যকার । তাঁর প্রথম জীবনের নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম রাবণ বধ’, ‘সীতার বনবাস’, ‘পান্ডবের অজ্ঞাতবাসএবং আর ও কিছু পৌরাণিক নাটক শুধু ব্যবসায়িক সাফল্য নয়, যথেষ্ট গৌরবও বয়ে আনে । মূলত এই সময় থেকেই শুরু হয় গিরিশ যুগ তথা বাংলা নাটকের স্বর্ণযুগ ।প্রায় আশিটি নাটক রচনা, অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা এবং পরিচালনায় মুনশিয়ানার জন্যে তিনি নাট্যসম্রাট হওয়ার গৌরব অর্জন করেন । গিরিশচন্দ্রের পরই যাঁদের নাম শ্রব্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় তাঁদের মধ্যে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সবিশেষ উল্লেখযোগ্য । বাংলা নাটকের আরেকজন প্রাণপুরুষ হলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । তিনি একাধারে ছিলেন নাট্যকার, প্রযোজক, পরিচালক, সুরকার এবং অভিনেতা । তাঁর নাটকগুলো বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ সম্পদ ।

 

প্রাক-স্বাধীনতা কালে বাংলার নাট্য ঐতিহ্যে আর একটি যুগান্তকারী বাঁক এসেছিল ১৯৪৪-এ। দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ শুরু হয়েছে ১৯৩৯-এ। বাঙালি তার প্রতিদিনের জীবনে যা কোনদিনও দেখেনি সে, সেই রকম বহু ঘটনার সাক্ষী হতে আরম্ভ করল। একদিকে কিছু শয়তানের মজুতদারি, কালবাজারিতে কৃত্রিম উপায়ে দুর্ভিক্ষ তৈরি করা ফলে খাদ্যের হাহাকার, বেকারি, নারীর সম্মান হানি – সে এক অন্ধকার সময়। সেই সময়েও কিন্ত চলছিল আলোর আরাধনা। কিছু মুক্তি পাগল মানুষ প্রতিবাদী মানুষ নামলেন পথে। ফ্যাসিবিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফসল হিসেবে তো বটেই, পাশাপাশি সাম্যবাদী রাজনৈতিক মতবাদকে ভারতের নিপীড়িত, শোষিত জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অভিপ্রায়ে , বঞ্চিত জনগণকে শোষণ প্রতিরোধে সংগঠিত করার লক্ষ্যে ১৯৪৪ সালে মু্ম্বাইয়ে একটি কনফারেন্সের মধ্যে দিয়ে জন্ম হয় ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার এসোসিয়েসান(আই পি টি এ) বা ভারতীয় গণনাট্য সংঘের । লক্ষ্য হিসেব ঘোষণা করা হলো--- পিপলস থিয়েটার স্টারস দ্য পিপলঅর্থাৎ জনগণের থিয়েটারে জনগণই হলো নায়ক ।

লক্ষ লক্ষ মৃত্যু আর সামাজিক অবক্ষয়ের যন্ত্রণার গভীর থেকে জন্ম নিল এক সৃজনশীল সাংস্কৃতিক সংগ্রাম আর সেই সংগ্রামের অভিঘাতে জন্ম নিল এক নতুনতর নাট্যধারা,বলা ভালো নাট্য আন্দোলন গণনাট্য আন্দোলন, ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের নেতৃত্বে। এই নতুনতর নাট্যধারার প্রথম পুরোহিত বিজন ভট্টাচার্য এলেন তাঁর নবান্ননাটকের মধ্য দিয়ে। বাংলা থিয়েটারে সে এক ক্রান্তিলগ্ন। গণনাট্য সঙ্ঘের প্রযোজনায় বিজন ভট্টাচার্য ও শম্ভু মিত্রর যৌথ পরিচালনায় নাটকটি শ্রীরঙ্গম মঞ্চে অভিনীত হয় ১৯৪৪এর ২৪শে সেপ্টেম্বর। পূর্ববর্তী একশবছরের সনাতনী নাট্য ও মঞ্চের প্রয়োগভাবনার ওলট পালট ঘটিয়ে নবান্নহয়ে গেল বাংলা নাটক ও মঞ্চের এক মাইলফলক।

মানুষ যখন হাহাকার করছে একটু ফ্যানের জন্য তখন পেশাদারী থিয়েটারে অভিনীত হচ্ছে সীতা’, ‘আলমগীর’, ‘মিশরকুমারীর মত নাটক। এই নাট্যভাবনাকে চুরমার করে বিজন ভট্টাচার্য মঞ্চে নিয়ে এলেন শ্রমজীবি মানুষদের। সনাতনী শিল্পের জন্য শিল্প’-অনুগত সাহিত্যভাবনা পরিবর্তিত হয়ে গেল নতুনতর স্লোগানে – ‘শিল্প হবে মানুষের জন্য বিজন ভট্টাচার্যর কথায় যে মানুষেরা রাস্তায় দুর্ভিক্ষের মড়া দেখে মুখ ফিরিয়ে গেছে, ‘নবান্ননাটক দেখিয়ে সেই মানুষদের চোখে আমরা জল ঝরাতে পেরেছি - এটা ছিল আমাদের কৃতিত্ব আজকের প্রবহমান বাংলা থিয়েটার মূলত এই নাট্যধারাকেই বহন করে চলেছে।

স্বাধীনতা-উত্তর সময়কালে এলেন শম্ভূ মিত্র। নতুন করে আমরা চিনলাম রবীন্দ্রনাথকে - নাটকের রবীন্দ্রনাথকে। রক্তকরবী বাঙালির চিন্তা জগতে এক নতুন দোলা দিয়ে গেল। এরপর উৎপল দত্ত ! কি বলা যেতে পারে তাঁকে ? কি বলব তাঁর লিটল থিয়েটার গ্রুপের অঙ্গারনাটকটিকে ? আর কল্লোল ! মঞ্চ সুরেশ দত্ত, আলো তাপস সেন ও আবহ হেমাঙ্গ বিশ্বাস। মিনার্ভা থিয়েটারে প্রথম অভিনয় ২৯শে মার্চ, ১৯৬৫। অভিনয়ে উৎপল দত্ত, শোভা সেন, শেখর চট্টোপাধ্যায়, শম্ভু ভট্টাচার্য, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। শুধুই কি নাটক রচনা – মঞ্চ সজ্জা, আলোক প্রক্ষেপণ, আবহ কাকে ছেড়ে কার কথা বলা যেতে পারে ? একটি নাটক বন্ধ করে দেওয়ার সরকারী আদেশের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে এক স্লোগানের জন্ম হল। একদম হিংস্র হয়ে এক পত্রিকা বলল, সব পত্রিকা সব নাটকের বিজ্ঞাপন নেয় না। পাল্টা এল তাপস সেন-এর মাথায়। এল টি জি জানাল,

"সব নাটক সব পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয় না।"

আর তাপস সেন রাতারাতি পোস্টারের বয়ান বানালেন,

'কল্লোল চলছে, চলবে।'

এরই মধ্য দিয়ে ষাটে এলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর মনোজ মিত্র, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে আরম্ভ করে আরও কত মুখ – কত নাটকের দল। কিছু নাম তুলে দিলাম যথাঃ রবি ঘোষ, বাদল সরকার, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, তৃপ্তি মিত্র, ঊষা গাঙ্গুলি, কৌশিক সেন, দেবাশিষ দত্ত, অরুণ মুখোপাধ্যায়, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, ব্রাত্য বসু আরও কত বাকি থেকে গেল। নাটকের দলের মধ্যে নান্দীকার, চারণিক, চেতনা, সায়ক, স্বপ্ন সন্ধানী, রঙ্গকর্মী, পূর্ব – পশ্চিম, ব্রাত্যজন, পদাতিক, কসবা উত্তরণ, কাঁচড়া পাড়া ফিনিক, গোবরডাঙ্গা নকসা, বহরমপুর ঋত্বিক, বারাসত কাল্পিক, নাট্যার্ঘ্য চন্দননগর, বিভাব নাট্য অ্যাকাডেমি আরও কত কত শত নাম।

অনেক কথাই তো লিখলাম। বাংলা নাটকের ইতিহাস লিখতে গেলে বাংলা নাটকের সবচেয়ে অবহেলিত মানুষ গুলোর কথা না লিখলে তো আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না – নিজের বুকে কত জ্বালা নিয়ে কত অপমান সয়ে তাঁরা চলে গেছেন আজকের আমরা তা ভাবতেও পারিনা।

তয়ফাআলি, খেমটাআলি, ঢপআলি, মেয়ে পাঁচালি / যাত্রা আলি গলি গলি তর বেতর / খেয়ালি, টপ্পাআলি, মনমাতালি ঘর ঘর ।

যাদের ছাড়া নাটকে স্ত্রী চরিত্র হত না । আগে আগে তো সীতা থেকে রাধা পর্যন্ত সব চরিত্রই পুরুষেরাই অভিনয় করত । ক্রমশ রুচির তারতম্য হতে খোঁজ পড়ল অভিনেত্রীর । তখন তো তথাকথিত ভদ্রঘর থেকে মহিলারা অভিনয় করতে বের হত না ! অতএব আশেপাশে গরানহাটা সোনাগাছি থেকে সঙ-স্ট্রেসঅর্থাৎ আঁধার-কিন্নরি আনা হতে থাকল । যাদের জীবন-গাথা হারিয়ে গেছে ঘোর অমানিশায় । উপেক্ষিত থেকেছে ইতিহাসে !

লেবেদফের নাটকে মহিলা চরিত্রে প্রথম অভিনয় করলেন মহিলারা কিন্ত তাঁদের কারো নাম খুঁজে পাই নি কোথাও। তারপর – তারপর আরও অনেক! এর পর থিয়েটারে আবার নারীদের আগমন হল ৪০ বছর পরে ১৮৩৫ খ্রীষ্টাব্দে - যখন নবীনচন্দ্র বসুর থিয়েটারে বিদ্যাসুন্দর নাটকটি দেখানো হল। এই নাটকেই  প্রথম অভিনেত্রীদের নাম জানা গেল - রাধারাণী, জয়দুর্গা, রাজকুমারী ও বৌহরো ম্যাথরানী। আরও জানা গেল যে, এঁদের সবাইকে পতিতালয় থেকেই অভিনয়ের জন্য আনা হয়েছিল। পতিতা মেয়েদের নিয়ে থিয়েটার করানোর ব্যাপারে বহু সমাজপতি বিরূপ মন্তব্য করলেও তার সপক্ষেও কয়েকজন সোচ্চার ছিলেন।

সাধারন রঙ্গালয়ে ১৮৭৩ সালে প্রথম অভিনয় করেন চার অভিনেত্রী । জগত্তারিনী, এলোকেশী, শ্যামাসুন্দরী ও গোলাপসুন্দরী বা সুকুমারি দত্ত । এইভাবেই ক্রমশ মঞ্চে আসেন বিনোদিনী দাসী, সুশীলাবালা, তিনকড়ি, প্রভা, আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা   প্রমুখ । এই অভিনেত্রীরা পঙ্কিল সমাজ থেকে এলেও এদের গুনগরিমা বিদ্বৎ-সমাজে বরেণ্য। ললিতকলা মন্দিরে এদের আসন অনেক উঁচুতে !

১৮৭৩ সালে বেঙ্গল থিয়েটারে এলেন গোলাপসুন্দরী মুলত মধুসুদন দত্তের আগ্রহে । ১৬ই আগস্ট তাঁর শর্মিষ্ঠাদিয়ে বেঙ্গল থিয়েটারের উদ্বোধন। ১৮৭৫ সালে চলে আসেন গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটারে । নাট্যকার উপেন্দ্রনাথ দাসের শরত সরোজিনীনাটকে সুকুমারী চরিত্রে অভিনয় করেন । সেই অভিনয় এত জনপ্রিয় হয়  যে তাঁর নামই হয়ে যায় সুকুমারী। এই নাটক চলাকালীন উপেন দাস মহাশয়ের মধ্যস্থতায় সুবর্ণ বনিক সমাজের গোষ্ঠবিহারী দত্তের সঙ্গে সুকুমারীর বিয়ে হয় । ফলত তার নাম হয় সুকুমারী দত্ত ! পতিতার বিয়ে ! ১৮৭৬ সালে ২৩শে ফেব্রুয়ারি - এই বিয়েকে কেন্দ্র করে তুমুল ঝড় উঠল সমাজে । বারবনিতার কি সংসার হয় ! স্বামী-স্ত্রীর অভিনয় জীবনকে নিয়ে মুখরোচক ছড়া বাঁধা হল

আমি সখের পরী সুকুমারী/ আমরা স্ত্রী-পুরুষে অ্যাক্টো করি/ দুনিয়ার লোক দেখে যারে ।

আবার নাট্যমঞ্চ ! সুকুমারী হন নাট্যকার, দল পরিচালক ও অভিনেত্রী । নিজের জীবন কাহিনী নিয়ে লেখেন অপূর্ব সতী১৮৮৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন হিন্দু ফিমেল থিয়েটার। সেখানে এই নাটকটি প্রযোজনা করে দেখালেন পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর সামাজিক উত্তরণের বাধা কতটা কঠিন । স্বাস্থ্যের অবনতির জন্যে শেষে থিয়েটার ত্যাগ করলেন প্রথম মহিলা নাট্যকার-অভিনেত্রী সুকুমারী দত্ত !

বিনোদিনী দাসী । বাংলা নাটকে সবচেয়ে প্রতিভাময়ী এবং সবচেয়ে বেশী ছলনার শিকার। জীবনে নাটক থেকে অনেক পেয়েছেন – পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা কিন্ত যে জিনিস তাঁর প্রাপ্য ছিল সেদিনকার সমাজ তাকে তা পেতে দেয় নি। মঞ্চে আসেন ১৮৭৪ সালের ১২ই ডিসেম্বর মাত্র ৯ বছর (মতান্তরে ১২ বছর) বয়সে। শত্রুসংহারনাটকে দ্রৌপদীর সঙ্গী । মাত্র কয়েকটা লাইন পার্ট তাতেই বাজিমাত ! ১৮৭৬ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সরোজিনীঅভিনয় নামভুমিকায় বিনোদিনী । নাটক ইতিহাস তৈরি করলো । সবারই মুখে বিনোদিনীর নাম । পৌরানিক, সামাজিক বা ঐতিহাসিক যেকোন রকমের চরিত্র রূপায়নেই তিনি প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন । একই নাটকে তিনি বিভিন্ন চরিত্রে সফলতার সাথে অভিনয় করেন । যেমন মেঘনাদবধের সাতটি চরিত্রে বা দুর্গেশনন্দিনীর দুটি ভিন্নমুখী চরিত্রে (আয়েষা ও তিলোত্তমা) । একই অভিনয় রজনীতে তিনি একাধিক নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করতে পারতেন । যেমন বিষবৃক্ষের কুন্দনন্দিনী এবং সধবার একাদশীর কাঞ্চন, চৈতন্যলীলার চৈতন্য এবং বিবাহ বিভ্রাটে বিলাসিনী কারফরমা, বিল্বমঙ্গলে চিন্তামনি এবং বেল্লিক বাজার এ রঙ্গিনী। শুধু তাই নয় পুরুষ চরিত্রের অভিনয়েও তিনি প্রতিভার পরিচয় দেন । তার অভিনীত পুরুষ চরিত্রগুলির মধ্যে রয়েছে চৈতন্য প্রহ্লাদ প্রভৃতি।  গিরিশচন্দ্র মনোরমানাটক দেখতে এসে থিয়েটারের বিনোদিনীকে দেখে মুগ্ধ হলেন । - তার ডাকে বিনোদিনী বেঙ্গল থিয়েটার ছেড়ে ন্যাশানাল থিয়েটারে শুরু করলেন গিরিশচন্দ্রের নাটক করা ! পরে  গুর্মুখ রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে কিনে নিলেন বিনোদিনীকে । শুধুমাত্র থিয়েটারকে বাঁচাতে নিজেকে বেচে দিলেন বিনোদিনী । কার কথায় – গিরিশ চন্দ্রের। বিনিময়ে কি চেয়েছিলেন – থিয়েটার হলটির নাম যেন “বি” থিয়েটার হয়। কথা দিয়েছিলেন গিরিশ চন্দ্র কিন্ত এক সমাজ পরিত্যক্তা নারীকে দেওয়া কথার কিই বা দাম, যতই তাঁকে বিক্রি করে দেওয়া টাকাতেই থিয়েটার হল গড়ে উঠুক না কেন। তাই "বি" থিয়েটারের বদলে  সেই থিয়েটার হলের নাম হল "স্টার" থিয়েটার। এই বঞ্চনা বিনোদিনী মেনে নিতে পারেন নি । তাই বেল্লিক বাজারনাটকের পর তিনি আর মঞ্চে ফেরেন নি ! থিয়েটার ভালবাসতাম, তাই কার্য করিতাম, কিন্তু ছলনার আঘাত ভুলিতে পারি নাই । তাই অবসর বুঝিয়া অবসর লইলাম ‘! জানি না স্টার যেদিন আগুনে পুড়ছিল বিনোদিনীর বুকের আগুন কি তার সাথী হয়েছিল? এর পর মিস প্রভা । সুর আর অভিনয় নিয়ে ছোটবেলা থেকে অপূর্ব অভিনয় করে এলেন প্রভাবতী । তার মতো অভিনেত্রী ও গায়িকা বাংলার মঞ্চে আর আসেন নি ।

এরপর ইন্দুবালা। জন্ম ১৮৯৯ সালের নভেম্বর মাসে অমৃতসরে । ইন্দুবালা গান ও নাচ  শিখলেন গৌরীশঙ্কর মিশ্র, জমিরুদ্দিন খান, এলাহি বক্স ও গওহর খানের কাছে । প্রথম দিকে শুধু গানের জন্যেই তাকে অভিনয়ে নেওয়া হত । গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে তাঁর অনেক গানই রেকর্ড করা হয়েছিল । মঞ্চের প্রয়োজনে ইন্দুবালাকে কাজী নজরুল ইসলাম নিয়ে আসেন নাটকের নাম রক্তকমল। গীতিকার ও সুরকার স্বয়ং নজরুল । দ্বিতীয় যুদ্ধকালীন শহর কলকাতায় কারফিউ, সাইরেন ও পুলিশ-মার্চে ভরা আঁধার-ঘেরা সমাজ । সেই সময়ে রক্তকমল" এগানে মুগ্ধ হল নাট্যমোদী মানুষ । ১৯২৫ সালে মঞ্চস্থ হল নসীরাম’ – নাম ভুমিকায় দানীবাবু । তারপর স্টার থিয়েটারেবিল্বমঙ্গল। তারপর গেলেন মনোমোহন থিয়েটার সেখানে বিষবৃক্ষ ।- গান ভালবাসিবে বলে ভালবাসিবে ! ১৯২৯ সালে ৩১শে ডিসেম্বর মঞ্চস্থ হল মহুয়া । কাজী নজরুল আর শিষ্যা ইন্দুবালা গানে মাতিয়ে দিলেন ।   সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী ইন্দুবালা দীর্ঘদিন রোগভোগের পর ১৯৮৪ সালের নভেম্বর মাসে মারা যান !

বাংলা নাটকের ইতিহাসে বাংলা থিয়েটার হল থাকবে না তা কি কখনো হয়। প্রথম থিয়েটার হলের কথা আগেই জেনেছি যখন  ১৮৭২ সনের ৭ই ডিসেম্বর দ্বারোদ্ঘাটন হয়েছিল ন্যাশানাল থিয়েটার এর দীনবন্ধু মিত্রের লেখা “নীলদর্পণ” নাটকের মাধ্যমে। বাংলার নাট্য ইতিহাসে এই নাটকটিকে প্রথম রাজনৈতিক নাটক বলে অভিহিত করা যেতেই পারে। মিনার্ভা থিয়েটার ১৮৯৩ সালে কলকাতার ৬ নং বিডন স্ট্রিটস্থ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বছরেরই ২৮ জানুয়ারি নগেন্দ্রভূষণ মুখার্জীর অর্থানুকূল্যে গিরিশচন্দ্র অনূদিত শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত গিরিশচন্দ্র, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, ক্ষীরোদপ্রসাদ, অমৃতলাল, অমরেন্দ্রনাথসহ অন্যান্য নাট্যকার রচিত প্রায় ৬০খানা নাটক এখানে মঞ্চস্থ হয়।

রঙমহল থিয়েটারঃ

  ১৯৩১ সালে কলকাতার কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে (বর্তমান বিধান সরণী) রবীন্দ্রনাথ রায় (রবি রায়) ও সতু সেনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। কৃষ্ণচন্দ্র দে (অন্ধ গায়ক) ও রবি রায় পরিচালকের এবং অমর ঘোষ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও ষষ্টী গাঙ্গুলী, নির্মলচন্দ্র, এস আহমেদ, ডি.এন ধরহরচন্দ্র ঘোষ, হেমচন্দ্র দে প্রমুখ মিলে রঙমহল থিয়েটারকে একটি যৌথ কোম্পানির চরিত্র দান করেন। প্রতিষ্ঠা বছরের ৮ আগস্ট যোগেশ চৌধুরীর লেখা শ্রীশ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া নাটকটি অভিনয়ের মাধ্যমে রঙমহল থিয়েটারের যাত্রা শুরু হয়।

স্টার থিয়েটার ১ঃ

১৮৮৩ সালে কলকাতার ৬৮ নং বিডন স্ট্রিটে (বর্তমান বিডন স্ট্রিট ও সেন্ট্রাল এভিন্যুর সংযোগস্থল) প্রতিষ্ঠিত হয়। গিরিশ ঘোষ, বিনোদিনী, অমৃতলাল বসু প্রমুখ নাট্যব্যক্তিত্ব এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা ছিলেন। গুর্মুখ রায় নামে জনৈক অবাঙালি যুবক থিয়েটারে অর্থলগ্নী করেন। তিনি সুন্দরী নটী বিনোদিনীর নামানুসারে বিথিয়েটার নামকরণের শর্ত আরোপ করেন; কিন্তু শেষপর্যন্ত স্টারথিয়েটার নাম হয়। প্রতিষ্ঠা বছর ২১ জুলাই গিরিশচন্দ্রের দক্ষযজ্ঞ নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে স্টার থিয়েটারের যাত্রা শুরু হয়।

স্টার থিয়েটার ২ঃ

১৮৮৮ সালে কলকাতার হাতিবাগানে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটার ভেঙ্গে যাওয়ার পর মূলত তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাট্যকর্মীদের উদ্যোগেই এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মদাস সুর এবং ইঞ্জিনিয়ার যোগেন গুপ্তের নকশা অনুযায়ী থিয়েটার হাউস ও তার মঞ্চ নির্মিত হয়। এক সময় গিরিশচন্দ্র ঘোষও এর সঙ্গে যুক্ত হন। প্রতিষ্ঠা বছরের ২৫ মেসেবকছদ্মনামে গিরিশ ঘোষ রচিত নসীরাম নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে নবনির্মিত হাতিবাগান স্টার থিয়েটারের উদ্বোধন হয়। ১৯৮৮ সালে স্টার থিয়েটার তার গৌরবের একশ বছর পূর্ণ করে। এই প্রতিটি রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস বহু হাসি – কান্নার সাক্ষী, যদি কোনদিন সুযোগ হয় তাহলে না হয় লিখব কারণ এদের প্রতিজনকে নিয়ে আস্ত একটি বই লেখা যায়।

বর্তমানে রবীন্দ্র সদন, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস, শিশির মঞ্চ, গিরিশ মঞ্চ, মধুসূদন মঞ্চ, নজরুল মঞ্চ, নিরঞ্জন সদনের মত সরকারী পরিচালনায় চলা হল এবং তপন থিয়েটার, সুজাতা সদনের মত বেসরকারি মঞ্চ গুলি বাঙালির নাট্য পিপাসাকে পরিপূর্ণ করতে সহায়তা করে চলেছে।

ইচ্ছা ছিল পথনাটক, বিশ্ব নাট্য দিবস, সফদার হাসমি (জাতীয় নাট্য দিবস), গণ নাট্য দিবস নিয়ে আলোচনা করার তা আর সম্ভব হল না। শেষে বলি, একজন সামান্য মানুষ যে নাটক ভালোবাসে তার কাছে সবচেয়ে কষ্টের জায়গা হল বাংলার এই সব বিখ্যাত নাট্য শিল্পীদের কোন কাজ ভাবী কালের নাট্য কর্মীরা দেখতে পাবেন না কারণ এই কাজ কোন ভাবেই রেকর্ড করে রাখা যায় নি। যারা এ লেখা পড়বেন তাঁদের কাছে একটি শেষ অনুরোধ রাখছি যদি কোনদিন কোন থিয়েটার হলে নাটক দেখতে যান অনুগ্রহ করে নিজের মোবাইলটি সাইলেন্ট মুডে অথবা বন্ধ করে নিজের পকেটে রাখলে আমার এ লেখা সার্থক হয়েছে বলে মনে করব।