29 December, 2015

জননী জন্মভুমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী

জননী জন্মভুমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী
মা - কি অসাধারণ সন্তানের জন্মদাত্রী তুমি
তাই না –

এবার আমি তোমাকে করি প্রশ্ন
কেন জন্ম হয়েছিল মা তোমার
তোমার ধর্ষণকারীদের জন্ম দেওয়ার জন্য ?
এবার আমি তোমাকে করি প্রশ্ন
তোমার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারার জন্য
তুমি জন্ম দাও পুরুষের !
তুমি কি জন্ম দাও পণের দাবীতে তোমায়
অগ্নিস্নান করানোর জন্য ?
বল মা -
উত্তর দাও
আমার বিবেক আজ তোমার জবাব চায় !

কেন তোমার মাথা নত মা
কেন তুমি মূক ?
কেন তোমার কণ্ঠ তীব্র প্রতিবাদে
আগুন ঝরায় না
বলে ওঠে না
ওরে শয়তান নিজেকে জিজ্ঞাসা কর তুই
কেন আমি তোকে জন্ম দিয়েছিলাম !
আমার শরীরটাকে খুবলে খুবলে খাওয়ার সময়
কেন তোর মনে পড়ে না
এই শরীরটার মত কোন এক শরীর থেকে
মানুষের জন্ম হয় ?
আমার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে যখন তুই
নাচিস উল্লাসে -
পণের দহন জ্বালায় আমাকে জ্বলতে দেখে
তোর পরিবারের সাথে তুই যখন
আর একটা টাঁকশাল ঘরে আনার চিন্তা করিস -
তখন তোর মনে পড়ে না কেন
তোর মাকে এইভাবে জ্বলতে হলে
তোর জন্ম হত কি করে ?

এ লজ্জা আমার নয় রে
এ লজ্জা তোদের
যখন আমার মত কাউকে বেশ্যা বলিস তোরা
আমি হেসে উঠি প্রচণ্ড উল্লাসে।
আমাকে বেশ্যা বানাল কে রে
কেন বলতে পার না মা
তুই যখন আমাকে বেশ্যা বলিস তখন
একবার ভাব তোর বাবার মত কোন পুরুষ
আমাকে বানিয়েছে বেশ্যা।

আর মাথা নিচু করে থেক না মা
মাথা নিচু করে থাকার দিন
হয়ে গেছে শেষ ।
নগরে – প্রান্তরে আকাশ – বাতাস কাঁপুক
কেঁপে উঠুক সাগর – পাহাড়
তোমার হুংকার প্রলয় আনুক মা
বলে ওঠ তুমি -

শোন তোরা
শপথ নিলাম আমি
আজ থেকে
মানুষ জন্ম নেবে না পৃথিবীতে। ২৯/১২/২০১৫

24 December, 2015

কি করে

আমি একসময়ে ভাবতাম লিখব কি করে
মানুষের মনের কথা কলমে আমার
আনব কি করে ?
কারণ
যা ভাবি
ভাবার জন্য তো পড়তে হয় একটু
দেখি সব কথা লিখে গেছেন ওঁরা
হরপ্পা – মহেঞ্জোদরো হয়ে
আরাকু গুহা গহ্বর থেকে জব্বল পুর বেয়ে
ভারতের ইতিহাস বয়ে
গুহাচিত্রে অথবা প্রস্তর কাজে
অজন্তা - ইলোরা আর খাজুরাহো ছুঁয়ে
সব কিছু বলে গেছেন মানুষের শিল্পী !
মহাভারতের এক সন্তান আমি
যে ভারত বলেছে আমার মধ্যে সে
“সোহং” – কত বিশাল ধারণা
যে দিয়েছে “আত্মন” এর ধারণা
কে তোমার আত্মা বা ওই আত্মন
ধর্মের সুজন্মা সন্তান
একটু বলুন না কে আত্মা
অথবা আত্মন
আমি এক মানুষ বলি –
ধর্মের সুজন্মা সন্তান আত্মা
কাজ আপনার
গীতা বলে
“আমি আত্মা আমাকে পারে না
মৃত্যু বিনাশ করতে,
অস্ত্র ছেদন করতে ব্যর্থ হয়
অগ্নি দগ্ধ করতে পারে না,
জল পারে না সিক্ত করতে
এবং শুষ্ক করতে পারে না বায়ু” |
আমি বিশ্বাসী আত্মায় !
আমায় গাল দিন আমার বামপন্থী বন্ধুরা
আমি হাসব আর তারপর
প্রশ্ন করি বন্ধু
তবে আত্মা কি
আত্মা মানুষের চিন্তন
সুকান্ত ছাই হয়ে গেছে চিতায়
তাঁর আত্মা জাগে এই শব্দ গুচ্ছে
“এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আজ
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার”
নজরুলের হাড় আজ কবরেও নেই
গুঁড়ো হয়ে মিশে গেছে মাটিতে
তবু নজরুলের আত্মা বলে
“জাতের নামে বজ্জাতি আজ
জাত জালিয়াত (@Suman Pahari) রা খেলছে জুয়া”
রবি কবি তাঁর আত্মায় –
তাঁর চেতনায় আসা শব্দ লিখেছেন
প্রশ্ন করছেন
খোলা কাগজে
“আমার কবিতা জানি আমি
গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সর্বত্র গামী”
তারপর কবি উত্তর দেন
যে আছে মাটির কাছাকাছি
সে কবির বানী লাগি কান পেতে আছি
লিখিত হয় ট্রামের চাকায় লেগে থাকা দেহাংশ নিয়ে
এক অসহায় কবির প্রশ্ন
“অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই - প্রীতি নেই - করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া”।
তাহলে আমি লিখব কোন শব্দ দিয়ে
মনের কোন অনুরণন তোমাকে চিন্তা করাবে
তোমাকে ভাবাবে –
সব শব্দ তো বলা হয়ে গেছে
সব কথা হয়ে গেছে শেষ
সব অক্ষর আঁচড় কেটে গেছে চিন্তায়
নতুন করে কি লিখব ?!
নতুন করে কি লিখব – তাই তো
দেখলাম চোখের সামনে
আজও মানুষ ভাবে দুটো রাতের মাঝে একটি দিন
আমি তো তা বিশ্বাস করি না
আমি জানি রবীন্দ্রনাথ – নজরুল – সুকান্ত
জীবনানন্দ হয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পাশ থেকে
শঙ্খ ঘোষ আমায় বাস্তব দেখান
বিভুতি ভূষণ দেখান স্বপ্ন এবং
ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় আর দীপক চন্দ স্যার
আপনারা আমাকে সবসময় মনে করিয়ে দেন
দুটি দিনের মাঝে থাকে একটি রাত !
জীবন বাঁচে অন্ধকারে নয় আলোতে
আমি তাই আলোর কথা লিখি
লিখি আর বলি মনে মনে
"থোড়াসা রুমানি হো যায়ে"
আর লিখে চলি
বদজাতদের খিস্তি পাওয়ার
কিংবা খিস্তি খাওয়ার আনন্দে। শ্রীতোষ ২৪/১২/২০১৫

19 December, 2015

ওরা কাদের লোক ?

রাতের অন্ধকার থেকে সকাল
হয়ে সন্ধ্যা পার হয়
৫ থেকে ৮৫
মানুষের ফেলে
দেওয়া নোংরা কুড়িয়ে যায়।

ওরা "DAS CAPITAL" জানে না -
জানে না "স্বচ্ছ ভারত"
তাই ওরা
ময়লার বিরুদ্ধে সংগ্রামে
নিজেদের শরীরকে ধ্বংস করে
ভারতকে "স্বচ্ছ" করে -
ওরা ওরাই !

ওদের নিয়ে কোন "মহামিছিল" হয় না -
ওরা শ্রমিক
তবু নেই কোন অধিকার শ্রমিকের
মানুষের চেহারায় বাঁচে
আর মানুষের চেহারা ধারী
দানবের হাতে মার খায়
ওরা আমাদের ফেলে যাওয়া বর্জ্য পদার্থ কে
নিজের শরীরে নিয়ে আমাদের বাঁচায় -

তাই তো
ওদের নিয়ে কোন "মহামিছিল" হয় না।

ওরা ওদের মত বাঁচে
আর আমরা
তথাকথিত সভ্য মানুষ গুলো
যারা স্বপ্ন দেখাই "শ্রেণীহীন সমাজের"
অথবা বলি "জয় দেশপ্রেমিক হিন্দু ভারত"
কিংবা অমুক শ্রী - রতন - ভূষণ বিলিয়ে চলি
ওদের দেওয়া করের আনন্দে
ওদের ধর্ষণ করি -

ওরা দেখে আর হাসে
ওদের হাসি কান্না হয়ে ঝরে
অধিকার হীন মানুষের কান্না। শ্রীতোষ ১৮/১২/২০১৫

12 December, 2015

রাজনৈতিক বেশ্যা

পয়সার বিনিময়ে যারা শরীর বিক্রি করে
তাদের বেশ্যা বলে ডাকি
লক্ষণ শেঠ - উদয়ন গুহ - রেজ্জাক মোল্লা
এবং
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী !
যে আপনাকে "বেদের মেয়ে জোছনা" বলেছিল
আজ আপনি তার হাত ধরে আছেন
মাত্র একটি উদাহরণ -
তাই প্রশ্ন করি
ক্ষমতার লোভে যারা আদর্শ বিক্রি করে
তারা কি ?
কি বলে ডাকব তাদের ? শ্রীতোষ ১২/১২/২০১৫

সুজেট তোমাকে

একটু তো নাটক করি -
প্রতিদিন কাঁদি মনে
নারী পেল বেশ্যা হওয়ার অধিকার !
যে মঞ্চে ছিল তার অধিকার সবচেয়ে বেশী
তাকে ক'জন চেনে-
মঞ্চের ইতিহাস জানে ক'জন
তার অর্থে - তার অভিনয়ে জাগে
বঙ্গ নাট্ট মঞ্চ - তবু তো বেশ্যা সে
নটী এক।

তার নামে মঞ্চের নাম হবে
সমাজ মেনে নেবে !
হয় না তো -
বেশ্যা কে বেশ্যার মত থাকতে হবে
তার শরীরে তার অর্থে
নাগরের অধিকার
তাই ব্যবহৃত হল সে
আজকের সুজেটের মত
স্বপ্ন দেখানো হল তাকে
বাড়ি পৌঁছে দেব
তোমার নামে মঞ্চ করে দেব
সে উঠে পড়ল অথবা আপন করে নিল
চলন্ত গাড়ি তে কিংবা মঞ্চে
দেওয়া প্রতিশ্রুতি
ওদের প্রয়োজন হয়ে যখন হয়ে গেল শেষ
ছুঁড়ে ফেলে দিল বিনোদিনী অথবা সুজেটকে
চলন্ত গাড়ি হতে অথবা মঞ্চ হতে
ওদের জন্য আছে ওদের মত অনেক নেকড়ে
যারা বলে চলে
বিনোদিনীরা বহু ভোগ্যা - প্রকাশ্যে ওদের ধর্ষণ
করতে হবে না তোমায় -
তুমি ওদের শরীরের দিকে চেয়ে
জিভ চাট লালসায় -
ওদের মনকে কর ধর্ষণ
তোমার কথায় - তোমার সুন্দর(!) মানসিক চিন্তায়
বিনোদিনী ধন্য হবে - গহর জান ধন্য হবে -
ধন্য হবে
আঙুর বালা আর আম্রপালী অথবা সেই "সুতনুকা"
যারা কারো সন্তান ছিল - ছিল কারো বোন অথবা
হতে পারত কারো মা
ঠিক সুজেটের মত - শ্রীতোষ ১২/১২/২০১৫

26 November, 2015

বিশ্রী মেয়ে

স্কুলে যাওয়ার সময় ওরা আসে
বাড়ি ফেরার সময় ওদের দেখতে পাই
দেখতে পাই বাড়ির বাইরে বার হলেই
ওরাও আমায় দেখে
দেখবে বলেই তো থাকে অপেক্ষায়।

ওদের কেউ থাকে আমার পাশের বাড়িতে কিংবা পাড়ায়
কোন সময় কাউকে আমি হয়তো দাদা বা কাকা বলে ডেকেছি
অথবা চিনিনা কাউকেই
আমি জানি ওরা ওদের মাকে ভালোবাসে
ভালোবাসে বোনকে
কিন্ত দুর্ভাগ্য আমার
কামদুনি থেকে রানাঘাট হয়ে
কাকদ্বীপ ছুঁয়ে পৌঁছে গেলাম মরিচবাড়ি
আমি ওদের বোন হতে পারলাম না
মা হতে পারলাম না
এক শরীর হয়ে থেকে গেলাম।

ওরা আমায় বেচে দেয়
আমি বিকৃতের হাতে বিক্রি হই
তারপর - প্রতিদিন
তোমরা আমায় নিয়ে কত লেখা লেখ
কত কথা বল

তোমরা যারা মোমবাতি নিয়ে হাঁটো
তাদের বলছি - শুনতে পাচ্ছ আমার কথা
যদি তোমাদের বিবেক থাকে
মানুষের চেহারায় হুঁশ থাকে
(মান বড় বেশী তোমাদের)
তোমাদের মত চেয়ার মুছতে চাই না
মোমবাতির বিক্রি বাড়াতে চাই না
আমি একটাও সাইকেল চাই না,
আমি আমার ইজ্জতের দাম চাইনা
আমি "শ্রী" হতে চাই না।

আমি চাই বাঁচতে
এক সাধারণ মেয়ে হয়ে বাঁচতে
এক "বিশ্রী" মেয়ে হয়ে
নিজের সম্মান নিয়ে পথ চলতে
যা তোরা হতে পারিস নি। শ্রীতোষ ২৫/১১/২০১৫

নাকিসো সিকেন্দে

নাকিসো সিকেন্দে ধীরেন লেট
নাকিসো সিকেন্দে বাংলা মা
মা আমার – বাংলা আমার
একমাত্র তুমিই তো পার
সহ্য করতে এ অত্যাচার !

তুমি তো ধারণ করেছ বীজ
আজ তুমি আসন্ন প্রসবা
সহ্য কর – ধাক্কা দাও !

আমরা ভুল করেছিলাম মা গো
ছেড়ে চলে গেছিলাম তোমায়
আর - আজ
আমরা তোমার পাশাপাশি জেগে আছি
অপরাজিতার রক্ত মাখা শরীর ছুঁয়ে
রানাঘাটের মায়ের কবরের পাশে বসে
মধ্যমগ্রামের আগুনে নিজের বিবেক করে ধংস
আমরা তো জেগে আছি
কাকদ্বীপ আর মরিচ বাড়ির পথে

আজ তুমি আসন্ন প্রসবা
সহ্য কর – ধাক্কা দাও !
নাকিসো সিকেন্দে বাংলা
মা আমার – বাংলা আমার
একমাত্র তুমিই তো পার
সহ্য করতে এ অত্যাচার !

জলপাইগুড়ি থেকে কাকদ্বীপ হয়ে
মরিচ বাড়ির পথে
সহ্য কর – সহ্য কর
শিলার ভারে নতজানু মা তুমি
সুজেট হয়ে তুমি মা পারো জন্ম দিতে
মুক্তি আর স্বাধীনতার
আমরা তোমার পাশাপাশি জেগে আছি
রক্ত তিলক মেখে
সহ্য কর ধাক্কা দাও

নাকিসো সিকেন্দে ধীরেন লেট
নাকিসো সিকেন্দে বিধান দা
একমাত্র তোমরাই পার
ছড়িয়ে দিতে এ প্রতিবাদ
মিছিলে - মিছিলে
গানে আর কবিতায় ___
আমরা তোমাদের পাশে জেগে আছি কমরেড
আমাদের মত সামান্য মানুষরা
মা আমার – স্বদেশ আমার
আমরা তোমার পাশে জেগে আছি – শ্রীতোষ ২৪/১১/২০১৫

10 November, 2015

ভ্রমণ কাহিনী ৩য় তথা শেষ পর্ব।



ভ্রমণ কাহিনী ৩য় তথা শেষ পর্ব।
এদিন ঠিক করেছিলাম একদম নিজেদের মত করে ঘুরব। তাই সকালে চা খেয়ে তৈরি হয়ে বার হয়ে পড়লাম দুজনে। হোটেলে জিজ্ঞাসা করল লাঞ্চ নেব কিনা – আমরা বললাম জানি না – ১ ঘণ্টায় ফিরে আসতে পারি – ফিরতে পারি সন্ধ্যা পার করে। পায়ে হেঁটে মূল রাস্তায় এসে বাঁধের লক গেট বা মূল নদী পার হয়ে এলাম এক তে মাথায়। সামনে অনেকগুলো খাওয়ার দোকান। একটি দোকানে জিজ্ঞাসা করলাম “কি পাওয়া যাবে” ? বলল গরম পুরি – তরকারী। ঠিক আছে আজ না হয় সাহেব থেকে বাঙালী হই। লাগাও দাদা – দু জায়গায়। এখানকার মানুষরা মানুষের সাথে মিশতে চায়, তাই অল্প সময়েই তার জানা হয়ে গেল আমি থাকি গড়িয়ায় আর সে কাজ করে রুবিতে – বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হচ্ছে সেখানে। এই সময় দিয়ে এসেছে, জানুয়ারি পার হলে আবার চলে যাবে, না হলে খাবে কি ? সত্যিই তো এলাকায় যেখানে উন্নয়নের জোয়ার বইছে সেখানকার মানুষই তো যাবে রুবিতে জন খাটতে ! যাই হোক, খাওয়া – দাওয়া মিটল, এবার ঘুরে দেখব এলাকা। প্রথমেই বাঁধ দেখতে হবে – কংসাবতী ও কুমারি নদীর উপর নির্মিত এ বাঁধ   বিশ্বের ২য় দীর্ঘতম মাটির বাঁধ। মোট দৈর্ঘ্য ৬ কিমি ৪০০ মিটার। কংসাবতীর দিকে উচ্চতা সর্বোচ্চ ৩৮.১০ মিটার এবং কুমারী নদীর দিকে ৪১.১৫ মিটার। এই দুটি অংশ একটি টিলার মাধ্যমে যুক্ত হয়েছে। এই বাঁধের দুদিকে রয়েছে দুটি ফিডার ক্যানাল। এ তো গেল ব্যবহারিক বর্ণনা। এবার বলি, ঘুরলাম কিভাবে ? তে মা






থার মোড় থেকে একটি অটো ভাড়া করে নিলাম – আশেপাশে যা আছে ঘুরিয়ে দেখাবে। অটো নিলাম এই কারণেই যে তীব্র রোদের হাত থেকে একটু ছায়া তো দরকার ! বাঁধের উপর দিয়ে যাত্রা শুরু। আমি মাইথন, পাঞ্চেত, ফারাক্কা (ফারাক্কার সৌন্দর্য অন্যরকম), দেখেছি হুদ্রু প্রপাতের আগে তৈরি বাঁধ – মুকুটমণিপুরও  দেখলাম। আমার কাছে সবচেয়ে সেরা মুকুটমণিপুর। একদিকে বিশাল জলরাশি (তাও বৃষ্টি কম হওয়ার জন্য এবার বাঁধে জল কম) অন্যদিকে সবুজ ঢাকা পাহাড় আর চাষের জমিমাঝে দু-একবার অটো থামিয়ে ফটো তুললাম। তারপর থামলাম সেই টিলাটির নীচে যার কথা লিখেছি আগেই। টিলাটির নাম দেওয়া হয়েছে মুসাফিরানা। ওপরে সুন্দর একটি পার্ক তৈরি হচ্ছে। গাছ যতদূর সম্ভব রক্ষা করা হয়েছে – পথ সাজানো হচ্ছে সহজ পাঠের বিভিন্ন লেখা দিয়ে। এটা অনুষঙ্গ। ওখানে এ দেখতে কেউ উঠবে না – উঠবে প্রকৃতি দর্শনে। আমার ক্যামেরায় কিছু ছবি তুলেছি কিন্ত বৃথা চেষ্টা। ছবি ধরা রইল মনের ক্যামেরায় ! প্রিয় পাঠক, সত্যিই আমি এত বড় লেখক নই যে এ অপার সৌন্দর্যের বর্ণনা দেব – এ সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আপনাকে আসতেই হবে মুকুটমণিপুরে। আমি মুগ্ধ – আমি ধন্য – আমি আপ্লুত। এই জন্যই কবি বোধ হয় গেয়ে ওঠেন “সকল দেশের সেরা সে যে / আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি”। কত সময় যে ওখানে চলে গেল জানি না। নেমে এলাম, আমাদের সারথি এবার বাঁধ থেকে একটি মাটির রাস্তা ধরে নিয়ে চললেন নিচের দিকে। বেশ কিছুটা নীচে এসে থামল অটো। আরও একটু নীচে নেমে খেয়াঘাট। ওপারে গিয়ে ২ – ৩ কিমি হাঁটলে “ডিয়ার পার্ক”। পারাপার ১৫০ টাকা। সারথি বললেন, কি হবে গিয়ে ? যে কটা হরিণ ছিল সবই তো এই ক’বছরে পাচার করে দিয়েছে – এখন ২-৪ টে আছে কিনা সন্দেহ। আসলে এটা হল কংসাবতী আর কুমারী নদীর মিলনস্থল – মোহানা। এটা দেখাতেই নিয়ে আসা, আপনাদের ডানদিকে কংসাবতী আর বাঁদিকে কুমারী। আমরা চলে গেলাম একেবারে জলের ধারে – একটু বাঁদিক ঘেঁষে নদীর মাঝে একটি ছোট্ট টিলা, ওই দিকটা একদম ফাঁকা। হালকা হাওয়ার সাথে জলের কুলুকুলু ধ্বনি – আঃ! সময় চলে যায় – এক সময় মনে হয় ফিরতে হবে। এবার গন্তব্য বাঁধের একদম শেষ প্রান্ত। দেখলাম অন্যদিকের ফিডার ক্যানালটি। এর মধ্যে যথারীতি সারথির সাথে আলাপ হয়ে গেছে। ইনি ইলেকট্রিকের কাজ খুব ভালো জানেন, গত ১৫ বছর সোনারপুরের গ্রীন পার্ক এলাকায় ইলেকট্রিকের কাজ্জের সাথে যুক্ত ছিলেন। দুঃখ করে বললেন, “দাদা আগে তো ঠিক ছিল কিন্ত গত ক’বছর ধরে কারখানার অবস্থা খারাপ, লোকাল লোক নেওয়ার জন্য মালিকের উপর চাপ আর তাদের আমাদের থেকে বেশী মাইনে দিতে হবে সে তারা কাজ জানুক আর না জানুক। বললে বিশ্বাস করবেন না, গত ৩-৪ বছরে যারা কাজে ঢুকেছে তারা এখন আমাদের চেয়ে বেশী মাইনে পায় মানে তাদের বেশী মাইনে দিতে হয়। মালিকও বলেছে কারখানা গুটিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাবে। দাদা, পার্টির ব্যাপার সব সময় সব জায়গায় ছিল, কিন্ত এখন ! রাস্তায় বার হলে আমাদের আওয়াজ মারত, সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া বাঁধাত। শেষে আর না পেরে চলে এলাম। এখানে একটা ছোট ইলেকট্রিকের দোকান খুলেছি, অটো চালাই, একটু খানি জমি আছে, নিজের দেশে শান্তিতে আছি। যা রোজগার করি, আগের মত অত ভালোভাবে না হলেও চলে যাচ্ছে। দেখি তো একটা বছর” ! আমি আর কি বলব – বলার কি আছে ? আছে শোনার আর শুনে আনন্দ না দুঃখ কি হয় তাও তো ছাতা বুঝি না ! মাঝে মাঝে মনে হয়, “বেশ হয়েছে, যেমন কর্ম – তেমন ফল” বিষ বৃক্ষ পুঁতেছ বন্ধু সে গাছে অমৃত ফল ফলবে আশা কর কি করে? আবার মনে হয় এদের তো দোষ নয় এক মিথ্যা মানুষের সামনে বার বার করে বলতে থাকলে, কিছু মানুষ তো তাকে সত্য ভাবে, এরাও তাই ভেবেছে। আসল শয়তান তো তারা, যারা এই সব কথা বলে, নানা রকম পোস্ট, পুরস্কার ইত্যাদি কামিয়ে ঠাণ্ডা ঘরে বসে ল্যাজ নাড়াচ্ছে। এই সব শুনতে শুনতে আর ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেছি অম্বিকা নগর। সেখানকার রাজবাড়ি। কিন্ত সে কথা এখন নয় – সে অন্য বর্ণনা – অন্য ইতিহাস। সে কথা লিখব পরে – একদম আলাদা করে।
এবার ফেরার পালা। ফেরার সময় “সোনাঝুরি” ফরেস্ট লজ কাম প্রকৃতি উদ্যানে সময় কাটালাম বেশ কিছুক্ষণ। তারপর আবার সেই তে মাথার মোড়। দুপুরের খাওয়া সারলাম, হোটেলের নাম মনে নেই কিন্ত যা দেশী মুর্গী খেলাম – এক কথায় অসাধারণ! করাত দিয়ে মাংস কাটলে ভালো হত বোধহয়। ১৫০ টাকায় ৪ পিস – তার একখানাও খেতে পারি নি। একদম তে মাথার মোড়েই হোটেলটা। এরপর কিছু কেনাকাটা শেষ করে একটি ভ্যানো ধরে হোটেলে। রাতেই সব পেমেন্ট ক্লিয়ার করে রাখলাম। এমনিতে বাঁকুড়া ষ্টেশন পর্যন্ত প্রাইভেট গাড়ী ১০০০ টাকা! হোটেল ম্যানেজার বললেন একটি গাড়ী লোক আনতে বাঁকুড়া যাবে সকাল ৯টায়, তাতে গেলে ভাড়া পড়বে ৫০০ টাকা। আমাদের ট্রেন যদিও দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে (রাজ্য রানী এক্সপ্রেস) তবু ৫০০ টাকা বাঁচবে বলে রাজি হয়ে গেলাম।
২৩ তারিখ সকালে উঠে চা খেয়ে ৯ টার মধ্যে নীচে – হোটেলের রিসেপশনে। সই – সাবুদ সারতে সারতেই গাড়ী হাজির। বাঁকুড়া পৌঁছালাম ১০টার মধ্যে। ট্রেনের সময় ১টা ৪৫। টিকিট কেটে নিলাম ভাড়া বাঁকুড়া থেকে শালিমার ১০০ টাকা। এই ট্রেনটি সপ্তাহে তিন দিন চলে, বৃহস্পতি, শুক্র আর রবি।ট্রেনে কোন রিজার্ভ কোচ নেই। সময় কাটানোর জন্য বুক স্টলের খোঁজ করলাম – হায় রে ! এর থেকে মরুভূমিতে জল খোঁজা সোজা। গোটা ষ্টেশনে (এমনকি প্ল্যাটফর্মেও) কোন বইয়ের স্টল নেই – নেই ষ্টেশনের বাইরেও। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, কাছাকাছির মধ্যে বই পাওয়া যাবে ২ – ৩ কিমি দূরে। একটি জেলা সদর এবং জাংসন ষ্টেশন। হতে পারে, রেল মন্ত্রক মনে করে বাঁকুড়া জেলায় যারা থাকে বা যারা বাঁকুড়া ষ্টেশন দিয়ে যাতায়াত করে তারা সবাই অশিক্ষিত! কি করি ? দেখলাম বোর্ডে দেখাচ্ছে আপ রাজ্য রানী ঢুকবে ১০টা ৫৫ মিনিটে ২ নং প্ল্যাটফর্মে। এনকোয়ারি থেকে জানতে পারলাম যে আমরা চাইলে ট্রেনে উঠে বসে থাকতে পারি। অতএব সোজা প্ল্যাটফর্ম। ট্রেন ঢুকল – একটু বাদে আমরাও উঠে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ বাদে একটা অদ্ভুত বিষয় নজরে এল। আমরা যে কোচে ছিলাম, তার সামনে একটি ঘর – লেখা আছে “বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত”। সেই ঘর থেকে যে যে রেল কর্মচারী বার হচ্ছেন তাদের অবস্থা UNITED WE STAND – DIVIDED WE FALL.পালা করে দুজনে খেয়ে নিলাম। ট্রেন ছাড়ল সময় মত। পথে একটিই উল্লেখযোগ্য ঘটনা – গোকুল পুর ষ্টেশনে একটি সুপার ফাস্ট ট্রেন (আমাদেরটি) প্রায় ৪৫ মিনিট দাঁড় করিয়ে একটি আপ গুডস, একটি ডাউন গুডস এবং একটি ডাউন মেদিনীপুর লোকাল ছেড়ে দেওয়া হল। তবুও মোটামুটি ৬ টা ১৫ নাগাদ শালিমার পৌঁছে গেলাম। ওখান থেকে ট্যাক্সি ধরে বাড়ি। শেষ হল ৪ দিনের এক অসাধারণ ঘোরা।
শেষের পরেও কিছু কথা থাকে। ঘোরার সময় যা মনে হয়েছে এই জায়গাটির মধ্যে বিশাল পর্যটন সম্ভাবনা আছে। তবে কিছু কাজ করা দরকারঃ
১) অবিলম্বে সরকারী ভাবে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার (যেমন লোকাল সাইট সিয়িং, বিষ্ণুপুর – শুশুনিয়া, ঝিলিমিলি ফরেস্ট) জন্য একটি ফেয়ার লিস্ট করা প্রয়োজন যাতে পর্যটকদের সুবিধা হয়। এটা না থাকার জন্য যে যেমন খুশি ভাড়া চাইছে;
২) একটি ভালো সাইবার কাফে খোলার ব্যবস্থা;
৩) প্রতিটি রাস্তার নিয়মিত দেখভাল ও আলোর ব্যবস্থা;
৪) সরাসরি কলকাতা থেকে মুকুটমণিপুর পর্যন্ত বাসের বুকিং ও সম্ভব হলে ট্যুরিস্ট সিজনে এসি বাসের ব্যবস্থা করা।

ভ্রমণ কাহিনী ২য় পর্ব - শুশুনিয়া পাহাড় ও বিষ্ণুপুর






ভ্রমণ কাহিনী ২য় পর্ব - শুশুনিয়া পাহাড় ও বিষ্ণুপুর
২০ তারিখ সকাল ৮টায় ব্রেকফাস্ট করে আমরা তৈরি, গাড়িও চলে এল সঙ্গে সঙ্গেই। আজ সারথি অন্য এক জন। এদিন বাঁকুড়া পর্যন্ত আমাদের সঙ্গী হলেন হোটেলের এক উচ্চপদস্থ কর্মী। ড্রাইভার যেহেতু ওনার পরিচিত ফলে গাড়ী চলছিল, ওনাদের নিজেদের আলোচনাও চলছিল, আমরা নীরবে শুনছিলাম। কিছুক্ষণ পরে আবার সেই টেট – হোটেলের ওই ভদ্রলোক বলতে লাগলেন ওনার পরিচিত কে কাকে কত টাকা দিয়েছে, তারপর এল খাতরার নতুন মহিলা এস ডি পি ওর কথা, আই পি এস পাশ করে প্রথম পোস্টিংখুব নাকি কড়া অফিসার। থানার ছোটবাবু নাকি বলেছে, সব থানাকে বলে দিয়েছে “ঝামেলা হলে “ক” বা “খ” গ্রুপের লোক না দেখে তুলে এনে কেস দিয়ে দিতে – তারপর আমি দেখে নেব”। এই সব শুনতে শুনতে বাঁকুড়া। ভদ্রলোক নেমে গেলেন – গাড়ী চলল শুশুনিয়া পাহাড়ের পথে। আমাদের সারথি এবার সহজ হয়েছেন আমাদের সাথে – প্রতিটি জায়গার উপর দিয়ে যেতে যেতে সেখানকার যদি কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় থাকে তা বলে যাচ্ছিলেন, কোথায় কুষ্ঠ হাসপাতালে পুজো হচ্ছে, কোথায় মেডিক্যাল কলেজ – স ও ব। গাড়ী এল ছাতনায়, কালীমন্দিরের পাশ দিয়ে টার্ন নিতে নিতে বললেন “এরই একটু দূরে ধনঞ্জয়ের বাড়ি – এক সময়ে কত হইচই, কত লোক একেবারে চোখের জলের বন্যা বইয়ে দিলে, এখনও মাঝে মাঝে কত কি বলে, ভোট এলে – এদিকে পরিবারটা যে না খেতে পেয়ে মরে সে খবর কে রাখে”। তারপরেই বিস্ফোরণ – “এই তো শুনলেন কত কিছু, কড়া অফিসার – আসলে এদের গায়ে লাগছে, এ এক গ্রুপের। এরা একটু মাতব্বরি বেশী ফলাচ্ছিল, এখন পারছে না, তাই এদের রাগ, যা বলল সব গায়ের জ্বালায়। তবে হয় ওনাকে চলে যেতে হবে না হলে এদের দু গ্রুপের কথা মেনে চলতে হবে”। একটু পরে আবার “এই যে টেট – কি হচ্ছে বলুন তো ? আমার নিজের দুই ভাইঝি তারা দুজনেই এখন পড়ায় – একজন স্কুলে, একজন কলেজে – দুজনেই কলকাতা থেকে এম এ করেছে সাত – আট বছর হয়ে গেল চাকরী করছে। কই আমার ভাইকে তো টাকা দিতে হয় নি!” কি আর বলব – কালও চুপ করে ছিলাম আজও তাই। আমরা শহুরে মানুষ, কিছু লিখতে বা বলতে গেলেই শুনি গ্রামে তো থাকেন নি, গ্রামের মানুষের যন্ত্রণা বুঝবেন কি করে ? কি যে অত্যাচার হয়েছে ধারণা করা যায় না। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ ছিলাম পুরুলিয়ার ঝালদায় – মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক ওখান থেকেই পাশ, বোলপুরে কাটিয়েছি ১৯৯৬ – ২০০১ আর রাণাঘাটে ২০০৭ – ২০০৮। সত্যিই তো আমি গ্রামের কিছুই জানি না – আমি এটা জানি যে আমি যা জানি যে কালো এবং ভালো দিক আমি দেখেছি তা এই দেড়েল সুশীলরা দেখেন নি। সে অন্য প্রসঙ্গ – এবার তো আমি জঙ্গল মহলের এক মানুষের কাছ থেকেই শুনছি তার জীবনের অভিজ্ঞতা। গাড়ী চলছে, কিছু পরেই সবুজ মাঠের ওপারে দেখা দিল আরো সবুজ এক পাহাড় - শুশুনিয়া পাহাড় ! দুই সবুজে মিলে মিশে একাকার ! দুই সবুজের দুই রং – আহা! এই জন্যই বোধ হয় কবি লেখেন – “কোথায় এমন হরিৎক্ষেত্র / আকাশ তলে মেশে” না আকাশে নয় দুই সবুজ মিলে গেছে দিগন্তে যেন চিত্রকর আঁকতে আঁকতে মনে করেছেন আর একটু গভীর করে দিই রং ! গাড়ী থামল পাহাড় তলে। কিছু উপরে উঠতেই বুঝলাম না – যে হারে মোটা হয়েছি উঠে হয়তো যাব কিন্ত নামতে পায়ের উপর যে চাপ পড়বে (বিশেষত হাঁটু তে) তাতে রিস্ক নেওয়া যাবে না, বিশেষত সামনে পর পর শো আছে। অতএব, দু – চারটে ছবি তুলে বাই বাই শুশুনিয়া। এবার চলা বিষ্ণুপুরের পথে। আবার বাঁকুড়া। বিষ্ণুপুর পৌঁছালাম ১২টা পার করে। প্রথমেই হোটেল মোনালিসায় খেয়ে নিলাম তিনজন – একদম বাড়ির মত চমৎকার রান্না, বেশী রিচ নয়, বেড়ানোর সময় এই রকম রান্না হল সবচেয়ে ভালো। এবার চলা শুরু ইতিহাসের হাত ধরে – মল্লভূমের পথে।
ইতিহাসে পাই - খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্ন পর্যন্ত প্রায় এক সহস্রাব্দ কাল বিষ্ণুপুরের ইতিহাস হিন্দু মল্ল রাজবংশের উত্থান পতনের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, "বিষ্ণুপুরের প্রাচীন রাজবংশের সূচনা সেই সময় ঘটে যখন দিল্লিতে হিন্দু রাজবংশ শাসন করত সেই সময় ভারতের কেউ মুসলমান সম্প্রদায়ের নাম শোনেনি বখতিয়ার খিলজি হিন্দু রাজাদের হাত থেকে বাংলার শাসন অধিকার করে নেওয়ার আগে পাঁচ শতাব্দীকাল এই রাজবংশ বিষ্ণুপুর শাসন করেছিল যদিও, বাংলায় মুসলমান বিজয় বিষ্ণুপুর রাজাদের শাসনের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনেনি... বাংলার উর্বর অংশের মুসলমান শাসকেরা এই অরণ্যরাজ্য সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন না তারা এই অঞ্চলে কখনও আসেনওনি এই কারণে, শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল বিষ্ণুপুরের রাজারা নির্বিঘ্নে শাসনকাজ চালিয়ে যান পরবর্তীকালে অবশ্য মুঘল রাজশক্তি এই অঞ্চল পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল মাঝে মাঝে মুঘল বাহিনী বিষ্ণুপুরের নিকটে এসে রাজস্ব দাবি করত এবং সম্ভবত বিষ্ণুপুরের রাজারা রাজস্ব দিয়েও দিতেন মুর্শিদাবাদের সুবাদারেরা পরবর্তীকালের বীরভূম বর্ধমানের রাজাদের মতো বিষ্ণুপুরের রাজাদেরও নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্পূর্ণ সক্ষম হননি বর্ধমান রাজাদের শক্তিবৃদ্ধি হওয়ার পর বিষ্ণুপুর রাজবংশের অবক্ষয় শুরু হয় মহারাজা কীর্তিচাঁদ বিষ্ণুপুর আক্রমণ করে এই অঞ্চলের একটি বিস্তৃর্ণ অঞ্চল নিজ জমিদারির অন্তর্ভুক্ত করেন বর্গী হানার সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণুপুর রাজবংশের পতন সম্পূর্ণ হয় বর্তমানে এইটি দরিদ্র জমিদার পরিবার মাত্র"
বিষ্ণুপুর রাজাদের উৎস রহস্যাবৃত। বহু শতাব্দীকাল তাঁদের বাগদি রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও বিষ্ণুপুরের রাজারা এবং তাঁদের অনুগামীরা দাবি করেন যে তাঁরা উত্তর ভারতের ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভুত। এই অঞ্চলের আর্যীকরণের শেষ পর্যায়ে এই দাবি বিশেষ জোরালো হয়ে ওঠে। বিষ্ণুপুরের রাজারা মল্ল রাজা নামে পরিচিত। সংস্কৃত মল্ল শব্দটির অর্থ মল্লযোদ্ধা। তবে এই শব্দটির সঙ্গে এই অঞ্চলের মাল উপজাতির সম্পর্ক থাকাও সম্ভব। এই উপজাতির সঙ্গে বাগদিদের সম্পর্ক বিদ্যমান বিষ্ণুপুর-সংলগ্ন অঞ্চলটিকে অতীতে মল্লভূম বলা হত। মল্লভূম রাজ্যের কেন্দ্রীয় এলাকা ছিল বর্তমান বাঁকুড়া থানা এলাকা (ছাতনা বাদে), ওন্দা, বিষ্ণুপুর, কোতুলপুর ইন্দাস তবে প্রাচীন বিষ্ণুপুর রাজ্যের আয়তন আরও বড়ো ছিল। উত্তরে সাঁওতাল পরগনার দামিন--কোহ থেকে এই রাজ্য দক্ষিণে মেদিনীপুর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। পূর্বে বর্ধমানের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমে ছোটোনাগপুরের একটি অঞ্চলও এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মল্ল রাজারা এই সব অঞ্চলও মল্লভূমের অধিকারে আনেন
বিষ্ণুপুর রাজবংশের আদিপুরুষ “আদিমল্ল”। আদিমল্ল ৩৩ বছর লাউগ্রাম শাসন করেন এবং বাগদি রাজা নামে অভিহিত হন তাঁর পুত্র জয়মল্ল রাজা হয়ে পদমপুর আক্রমণ করে দুর্গ অধিকার করেন জয়মল্ল তাঁর রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটিয়ে বিষ্ণুপুরে রাজধানী সরিয়ে আনেন পরবর্তী রাজারাও রাজ্যবিস্তারে মন দিয়েছিলেন এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন চতুর্থ রাজা কালুমল্ল, ষষ্ঠ রাজা কাউমল্ল সপ্তম রাজা ঝাউমল্ল অষ্টম রাজা সুরমল্ল উত্তর মেদিনীপুরের বাগড়ির রাজাকে পরাজিত করেছিলেন তাঁর পরে আরও ৪০ জন বিষ্ণুপুর শাসন করেন এঁরা সকলেই মল্ল বা মল্লবনিনাথ নামে পরিচিত ছিলেন এই রাজাদের পারিবারিক নথি থেকে জানা যায়, এঁরা বিদেশি শাসনের অধীনতাপাশ থেকে মুক্ত ছিলেন রঘুনাথ সিংহ বিষ্ণুপুরের প্রথম রাজা যিনি ক্ষত্রিয় সিংহ উপাধি ব্যবহার করেন কথিত আছে, এই উপাধি মুর্শিদাবাদের নবাব তাঁকে প্রদান করেছিলেন তাঁর রাজত্বকাল থেকেই বিষ্ণুপুর রাজ্যের স্বর্ণযুগের সূচনা ঘটে রঘুনাথ সিংহের আমলে বিষ্ণুপুরে নয়নাভিরাম প্রাসাদ মন্দিরাদি নির্মিত হয় কিন্ত ১৮০৬ সালে রাজস্ব বাকি রাখার দায়ে রাজ্য বিক্রি হয়ে যায় এবং বর্ধমানের রাজা সমগ্র এস্টেটটি কিনে নেন
প্রথমে রাসমঞ্চ। সেখান থেকে একে একে চলা শ্যামরায় মন্দির, গুমঘর, মদনমোহন মন্দির, জোড়বাংলা, কালাচাঁদ মন্দির, রাধামাধব মন্দির, রাধাগোবিন্দ মন্দির, লালবাঁধ হয়ে দলমর্দন (দলমাদল) কামান। লালবাঁধ নিয়ে এক কাহিনী প্রচলিত আছে – বাইজি লালবাই রাজার ঔরসে গর্ভবতী হয়ে পড়ায় একটি বন্ধ নৌকা ফুটো করে তাকে এই দীঘিতে ডুবিয়ে মারা হয়। আর দলমাদল কামানের গল্প তো সকলেরই জানা – মদনমোহন নিজে বিষ্ণুপুর রক্ষার জন্য মারাঠাদের বিরুদ্ধে এই কামান ব্যবহার করেছিলেন।  
অনেকেই প্রশ্ন করেন, তুমি তো ঠাকুর মানো না – ধর্ম মানো না তাহলে মন্দিরে যাও কেন ? আমি বলি আমার ঠাকুর আপনি ! আমি যা করি – তাই আমার ধর্ম, আর মানুষের আনন্দ যেখানে, সেখানে আমার উৎসব শুরু হয়। আমি সেই মন্দিরে কোনদিন ঢুকি না যেখানে ছোঁয়াছুঁয়ির বারণ আছে। আমি ভারতের বহু প্রাচীন মন্দিরে গেছি যেখানে শিল্পী তার শিল্প কলায় নিজেকে অমর করে দিয়েছেন। আমরা মল্ল রাজাদের কথা পড়ি, নাম জানি, আমিও লিখলাম একটু আগে – এই যে শিল্পীরা যাদের কাজ মন্দিরের দেওয়ালে দেওয়ালে অমর হয়ে গেছে তাদের নাম জানি ? না জানি না। আমি মন্দিরে যাই কোন বিগ্রহকে নয় সেই মহান শিল্পীদের কাজকে – তাঁদের শিল্পকে প্রণাম করতে। টেরাকোটার কাজ না থাকলে এই মন্দির কে যেত দেখতে – এরকম কত মন্দির পড়ে আছে বাংলার পথে প্রান্তরে, কেউ ফিরেও তাকায় না।
এরপরে - বিষ্ণুপুরি সিল্ক  কি ভাবে তৈরি হয় সেটা দেখতে হবে আর আছে দশাবতার তাস। দুঃখের বিষয় মূল দোকান “কনিস্ক” বন্ধ, তাই দুধের সাধ ঘোলেও মিটল না কিন্ত দশাবতার তাস! সে অন্য গল্প।
এবার ফেরা – ফিরলাম একটি অন্য পথে, যার একটি বড় অংশ গেছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। সে পথ ও অসম্ভব সুন্দর ! আসলে এই গোটা ভ্রমণ কালে একমাত্র সুতানের বন বাংলো ছাড়া আর কোন কিছু দেখে আমার খারাপ লাগে নি (রাস্তা ঘাট ও অন্যান্য কিছু বিষয় আলাদা)। হোটেলে ফিরলাম যখন প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। এই দিন গাড়ী ভাড়া গেল ২৫০০ টাকা। শেষ হল ২য় পর্ব। ৩য় পর্বে আসবে মুকুটমণিপুর বাঁধ ও সংলগ্ন দুএকটি স্থান ঘোরার কাহিনী।