ভ্রমণ
কাহিনী ২য় পর্ব - শুশুনিয়া পাহাড় ও বিষ্ণুপুর
২০
তারিখ সকাল ৮টায় ব্রেকফাস্ট করে আমরা তৈরি, গাড়িও চলে এল সঙ্গে সঙ্গেই। আজ সারথি
অন্য এক জন। এদিন বাঁকুড়া পর্যন্ত আমাদের সঙ্গী হলেন হোটেলের এক উচ্চপদস্থ কর্মী।
ড্রাইভার যেহেতু ওনার পরিচিত ফলে গাড়ী চলছিল, ওনাদের নিজেদের আলোচনাও চলছিল, আমরা
নীরবে শুনছিলাম। কিছুক্ষণ পরে আবার সেই টেট – হোটেলের ওই ভদ্রলোক বলতে লাগলেন ওনার
পরিচিত কে কাকে কত টাকা দিয়েছে, তারপর এল খাতরার নতুন মহিলা এস ডি পি ওর কথা, আই
পি এস পাশ করে প্রথম পোস্টিং। খুব নাকি কড়া অফিসার। থানার ছোটবাবু নাকি বলেছে, সব
থানাকে বলে দিয়েছে “ঝামেলা হলে “ক” বা “খ” গ্রুপের লোক না দেখে তুলে এনে কেস দিয়ে
দিতে – তারপর আমি দেখে নেব”। এই সব শুনতে শুনতে বাঁকুড়া। ভদ্রলোক নেমে গেলেন –
গাড়ী চলল শুশুনিয়া পাহাড়ের পথে। আমাদের সারথি এবার সহজ হয়েছেন আমাদের সাথে –
প্রতিটি জায়গার উপর দিয়ে যেতে যেতে সেখানকার যদি কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় থাকে তা
বলে যাচ্ছিলেন, কোথায় কুষ্ঠ হাসপাতালে পুজো হচ্ছে, কোথায় মেডিক্যাল কলেজ – স ও ব।
গাড়ী এল ছাতনায়, কালীমন্দিরের পাশ দিয়ে টার্ন নিতে নিতে বললেন “এরই একটু দূরে
ধনঞ্জয়ের বাড়ি – এক সময়ে কত হইচই, কত লোক একেবারে চোখের জলের বন্যা বইয়ে দিলে,
এখনও মাঝে মাঝে কত কি বলে, ভোট এলে – এদিকে পরিবারটা যে না খেতে পেয়ে মরে সে খবর
কে রাখে”। তারপরেই বিস্ফোরণ – “এই তো শুনলেন কত কিছু, কড়া অফিসার – আসলে এদের গায়ে
লাগছে, এ এক গ্রুপের। এরা একটু মাতব্বরি বেশী ফলাচ্ছিল, এখন পারছে না, তাই এদের
রাগ, যা বলল সব গায়ের জ্বালায়। তবে হয় ওনাকে চলে যেতে হবে না হলে এদের দু গ্রুপের
কথা মেনে চলতে হবে”। একটু পরে আবার “এই যে টেট – কি হচ্ছে বলুন তো ? আমার নিজের
দুই ভাইঝি তারা দুজনেই এখন পড়ায় – একজন স্কুলে, একজন কলেজে – দুজনেই কলকাতা থেকে
এম এ করেছে সাত – আট বছর হয়ে গেল চাকরী করছে। কই আমার ভাইকে তো টাকা দিতে হয় নি!”
কি আর বলব – কালও চুপ করে ছিলাম আজও তাই। আমরা শহুরে মানুষ, কিছু লিখতে বা বলতে
গেলেই শুনি গ্রামে তো থাকেন নি, গ্রামের মানুষের যন্ত্রণা বুঝবেন কি করে ? কি যে
অত্যাচার হয়েছে ধারণা করা যায় না। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ ছিলাম পুরুলিয়ার ঝালদায় –
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক ওখান থেকেই পাশ, বোলপুরে কাটিয়েছি ১৯৯৬ – ২০০১ আর
রাণাঘাটে ২০০৭ – ২০০৮। সত্যিই তো আমি গ্রামের কিছুই জানি না – আমি এটা জানি যে আমি
যা জানি যে কালো এবং ভালো দিক আমি দেখেছি তা এই দেড়েল সুশীলরা দেখেন নি। সে অন্য
প্রসঙ্গ – এবার তো আমি জঙ্গল মহলের এক মানুষের কাছ থেকেই শুনছি তার জীবনের
অভিজ্ঞতা। গাড়ী চলছে, কিছু পরেই সবুজ মাঠের ওপারে দেখা দিল আরো সবুজ এক পাহাড় -
শুশুনিয়া পাহাড় ! দুই সবুজে মিলে মিশে একাকার ! দুই সবুজের দুই রং – আহা! এই জন্যই
বোধ হয় কবি লেখেন – “কোথায় এমন হরিৎক্ষেত্র / আকাশ তলে মেশে” না আকাশে নয় দুই সবুজ
মিলে গেছে দিগন্তে যেন চিত্রকর আঁকতে আঁকতে মনে করেছেন আর একটু গভীর করে দিই রং !
গাড়ী থামল পাহাড় তলে। কিছু উপরে উঠতেই বুঝলাম না – যে হারে মোটা হয়েছি উঠে হয়তো
যাব কিন্ত নামতে পায়ের উপর যে চাপ পড়বে (বিশেষত হাঁটু তে) তাতে রিস্ক নেওয়া যাবে
না, বিশেষত সামনে পর পর শো আছে। অতএব, দু – চারটে ছবি তুলে বাই বাই শুশুনিয়া। এবার
চলা বিষ্ণুপুরের পথে। আবার বাঁকুড়া। বিষ্ণুপুর পৌঁছালাম ১২টা পার করে। প্রথমেই
হোটেল মোনালিসায় খেয়ে নিলাম তিনজন – একদম বাড়ির মত চমৎকার রান্না, বেশী রিচ নয়,
বেড়ানোর সময় এই রকম রান্না হল সবচেয়ে ভালো। এবার চলা শুরু ইতিহাসের হাত ধরে –
মল্লভূমের পথে।
ইতিহাসে পাই - খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্ন পর্যন্ত প্রায় এক সহস্রাব্দ কাল বিষ্ণুপুরের ইতিহাস হিন্দু মল্ল রাজবংশের উত্থান ও পতনের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, "
বিষ্ণুপুরের প্রাচীন রাজবংশের সূচনা সেই সময় ঘটে যখন দিল্লিতে হিন্দু রাজবংশ শাসন করত। সেই সময় ভারতের কেউ মুসলমান সম্প্রদায়ের নাম শোনেনি। বখতিয়ার খিলজি
হিন্দু রাজাদের হাত থেকে বাংলার শাসন অধিকার করে নেওয়ার আগে পাঁচ শতাব্দীকাল এই রাজবংশ বিষ্ণুপুর শাসন করেছিল। যদিও,
বাংলায় মুসলমান বিজয় বিষ্ণুপুর রাজাদের শাসনের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনেনি...
বাংলার উর্বর অংশের মুসলমান শাসকেরা এই অরণ্যরাজ্য সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন না। তারা এই অঞ্চলে কখনও আসেনওনি। এই কারণে,
শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল বিষ্ণুপুরের রাজারা নির্বিঘ্নে শাসনকাজ চালিয়ে যান। পরবর্তীকালে অবশ্য মুঘল রাজশক্তি এই অঞ্চল পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। মাঝে মাঝে মুঘল বাহিনী বিষ্ণুপুরের নিকটে এসে রাজস্ব দাবি করত এবং সম্ভবত বিষ্ণুপুরের রাজারা রাজস্ব দিয়েও দিতেন। মুর্শিদাবাদের সুবাদারেরা
পরবর্তীকালের বীরভূম ও বর্ধমানের রাজাদের মতো বিষ্ণুপুরের রাজাদেরও নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্পূর্ণ সক্ষম হননি। বর্ধমান রাজাদের
শক্তিবৃদ্ধি হওয়ার পর বিষ্ণুপুর রাজবংশের অবক্ষয় শুরু হয়। মহারাজা কীর্তিচাঁদ
বিষ্ণুপুর আক্রমণ করে এই অঞ্চলের একটি বিস্তৃর্ণ অঞ্চল নিজ জমিদারির অন্তর্ভুক্ত করেন। বর্গী হানার সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণুপুর রাজবংশের পতন সম্পূর্ণ হয়। বর্তমানে এইটি দরিদ্র জমিদার পরিবার মাত্র।"
বিষ্ণুপুর রাজাদের উৎস রহস্যাবৃত। বহু শতাব্দীকাল তাঁদের বাগদি রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও বিষ্ণুপুরের রাজারা এবং তাঁদের অনুগামীরা দাবি করেন যে তাঁরা উত্তর ভারতের ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভুত। এই অঞ্চলের আর্যীকরণের শেষ পর্যায়ে এই দাবি বিশেষ জোরালো হয়ে ওঠে। বিষ্ণুপুরের রাজারা মল্ল রাজা নামে পরিচিত। সংস্কৃত মল্ল শব্দটির অর্থ মল্লযোদ্ধা। তবে এই শব্দটির সঙ্গে এই অঞ্চলের মাল উপজাতির সম্পর্ক থাকাও সম্ভব। এই উপজাতির সঙ্গে বাগদিদের সম্পর্ক বিদ্যমান। বিষ্ণুপুর-
সংলগ্ন অঞ্চলটিকে অতীতে মল্লভূম বলা হত। মল্লভূম রাজ্যের কেন্দ্রীয় এলাকা ছিল বর্তমান বাঁকুড়া থানা এলাকা (
ছাতনা বাদে),
ওন্দা,
বিষ্ণুপুর,
কোতুলপুর ও ইন্দাস। তবে প্রাচীন বিষ্ণুপুর রাজ্যের আয়তন আরও বড়ো ছিল। উত্তরে সাঁওতাল পরগনার
দামিন-ই-কোহ থেকে এই রাজ্য দক্ষিণে মেদিনীপুর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। পূর্বে বর্ধমানের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমে ছোটোনাগপুরের একটি অঞ্চলও এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মল্ল রাজারা এই সব অঞ্চলও মল্লভূমের অধিকারে আনেন।
বিষ্ণুপুর রাজবংশের আদিপুরুষ “আদিমল্ল”। আদিমল্ল ৩৩ বছর লাউগ্রাম শাসন করেন এবং বাগদি রাজা নামে অভিহিত হন। তাঁর পুত্র জয়মল্ল রাজা হয়ে পদমপুর আক্রমণ করে দুর্গ অধিকার করেন। জয়মল্ল তাঁর রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটিয়ে বিষ্ণুপুরে রাজধানী সরিয়ে আনেন। পরবর্তী রাজারাও রাজ্যবিস্তারে মন দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন চতুর্থ রাজা কালুমল্ল, ষষ্ঠ রাজা কাউমল্ল ও সপ্তম রাজা ঝাউমল্ল। অষ্টম রাজা সুরমল্ল উত্তর মেদিনীপুরের বাগড়ির রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। তাঁর পরে আরও ৪০ জন বিষ্ণুপুর শাসন করেন। এঁরা সকলেই মল্ল বা মল্লবনিনাথ নামে পরিচিত ছিলেন। এই রাজাদের পারিবারিক নথি থেকে জানা যায়, এঁরা বিদেশি শাসনের অধীনতাপাশ থেকে মুক্ত ছিলেন। রঘুনাথ সিংহ বিষ্ণুপুরের প্রথম রাজা যিনি ক্ষত্রিয় সিংহ উপাধি ব্যবহার করেন। কথিত আছে, এই উপাধি মুর্শিদাবাদের নবাব তাঁকে প্রদান করেছিলেন। তাঁর রাজত্বকাল থেকেই বিষ্ণুপুর রাজ্যের স্বর্ণযুগের সূচনা ঘটে। রঘুনাথ সিংহের আমলে বিষ্ণুপুরে নয়নাভিরাম প্রাসাদ ও মন্দিরাদি নির্মিত হয়। কিন্ত ১৮০৬ সালে রাজস্ব বাকি রাখার দায়ে রাজ্য বিক্রি হয়ে যায় এবং বর্ধমানের রাজা সমগ্র এস্টেটটি কিনে নেন।
প্রথমে
রাসমঞ্চ। সেখান থেকে একে একে চলা শ্যামরায় মন্দির, গুমঘর, মদনমোহন মন্দির,
জোড়বাংলা, কালাচাঁদ মন্দির, রাধামাধব মন্দির, রাধাগোবিন্দ মন্দির, লালবাঁধ হয়ে
দলমর্দন (দলমাদল) কামান। লালবাঁধ নিয়ে এক কাহিনী প্রচলিত আছে – বাইজি লালবাই রাজার
ঔরসে গর্ভবতী হয়ে পড়ায় একটি বন্ধ নৌকা ফুটো করে তাকে এই দীঘিতে ডুবিয়ে মারা হয়। আর
দলমাদল কামানের গল্প তো সকলেরই জানা – মদনমোহন নিজে বিষ্ণুপুর রক্ষার জন্য
মারাঠাদের বিরুদ্ধে এই কামান ব্যবহার করেছিলেন।
অনেকেই
প্রশ্ন করেন, তুমি তো ঠাকুর মানো না – ধর্ম মানো না তাহলে মন্দিরে যাও কেন ? আমি
বলি আমার ঠাকুর আপনি ! আমি যা করি – তাই আমার ধর্ম, আর মানুষের আনন্দ যেখানে,
সেখানে আমার উৎসব শুরু হয়। আমি সেই মন্দিরে কোনদিন ঢুকি না যেখানে ছোঁয়াছুঁয়ির
বারণ আছে। আমি ভারতের বহু প্রাচীন মন্দিরে গেছি যেখানে শিল্পী তার শিল্প কলায়
নিজেকে অমর করে দিয়েছেন। আমরা মল্ল রাজাদের কথা পড়ি, নাম জানি, আমিও লিখলাম একটু
আগে – এই যে শিল্পীরা যাদের কাজ মন্দিরের দেওয়ালে দেওয়ালে অমর হয়ে গেছে তাদের নাম
জানি ? না জানি না। আমি মন্দিরে যাই কোন বিগ্রহকে নয় সেই মহান শিল্পীদের কাজকে –
তাঁদের শিল্পকে প্রণাম করতে। টেরাকোটার কাজ না থাকলে এই মন্দির কে যেত দেখতে –
এরকম কত মন্দির পড়ে আছে বাংলার পথে প্রান্তরে, কেউ ফিরেও তাকায় না।
এরপরে -
বিষ্ণুপুরি সিল্ক কি ভাবে তৈরি হয় সেটা
দেখতে হবে আর আছে দশাবতার তাস। দুঃখের বিষয় মূল দোকান “কনিস্ক” বন্ধ, তাই দুধের
সাধ ঘোলেও মিটল না কিন্ত দশাবতার তাস! সে অন্য গল্প।
এবার
ফেরা – ফিরলাম একটি অন্য পথে, যার একটি বড় অংশ গেছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। সে পথ ও
অসম্ভব সুন্দর ! আসলে এই গোটা ভ্রমণ কালে একমাত্র সুতানের বন বাংলো ছাড়া আর কোন
কিছু দেখে আমার খারাপ লাগে নি (রাস্তা ঘাট ও অন্যান্য কিছু বিষয় আলাদা)। হোটেলে
ফিরলাম যখন প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। এই দিন গাড়ী ভাড়া গেল ২৫০০ টাকা। শেষ হল
২য় পর্ব। ৩য় পর্বে আসবে মুকুটমণিপুর বাঁধ ও সংলগ্ন দুএকটি স্থান ঘোরার কাহিনী।