25 January, 2019

গল্প হলেও সত্যি অথবা সত্যি হলেও গল্প।


(প্রথমেই বলে রাখি এ ঘটনা বাস্তবের এবং এই ঘটনার মূল চরিত্রকে আমি নিজের চোখে দেখি নি, পুরো ঘটনা শুনেছি, এমন কিছু প্রিয় মানুষের কাছ থেকে, আমায় মিথ্যা বলে তাদের কোন লাভ নেই।)

ঘটনার সময়কাল ১৭/০১/২০১৯ তারিখ, আমাদের বিয়ের রজত জয়ন্তী পূর্ণ হওয়ার সন্ধ্যাবেলার। এই ঘটনা বলার আগে একটু পূর্ব কথন দরকার। আমার বন্ধু যারা ফেসবুকে আছেন, তাঁরা জানেন, গত ০৪/১২/২০১৮ তে সুরিতার মা শ্রীমতি গৌরী সেন অত্যন্ত আকস্মিক ভাবে প্রয়াত হন। তার আগের দিনই তাঁকে আমরা আমাদের বিবাহ বার্ষিকীর নিমন্ত্রণ জানাই এবং যে মানুষ বাড়ি থেকে বার হতে চাইতেন না, সেই মানুষ জানান যে তিনি অবশ্যই সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। তাঁর অকাল মৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাহত হলেও অনুষ্ঠান বন্ধ না করার সিদ্ধান্ত হয়, বিশেষত যখন জানা যায়, যে তিনি বেশ কিছু আত্মীয় পরিজন কে ১৭ তারিখের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন।

পরবর্তী ঘটনা আমার কানে আসে ১৭ তারিখের রাতে। তখন নিমন্ত্রিতরা সকলেই বিদায় নিয়েছেন, সুরিতা আমাদের ফ্ল্যাটে গেছে জিনিস পত্র রাখতে। আমি, আমার দুই শালি সুজাতা ও মিলিতা, দুই ভায়রা কুন্তল ও শান্ত এবং তাঁদের দুই ছেলে মেয়ে কস্তূরী ও সৌমিক (সোনা মা ও কুট্টুস) রয়েছি। টুকটাক আলোচনা চলছে, হঠাৎ করে সুজাতা আমাকে বলল, জানো আজকে অনুষ্ঠানের সময় একটি ঘটনা ঘটেছে। একজন বয়স্কা মহিলা সোনা মার কাছে কিছু খেতে চেয়েছিলেন, ও খাবার নিয়ে তাঁর হাতে দিয়েছে, তিনি খুব তৃপ্তি করে খেয়েছেন। আমি মনে মনে বললাম, “এই অনুষ্ঠান সার্থক হল” আর সোনা মার দিকে চেয়ে বললাম “এই মন টা সারা জীবন ধরে রাখিস মা”।

সেদিন রাতে ঘুম আসে নি দীর্ঘ ক্ষণ, রাত সাড়ে বারোটার পরেও ফোন বেজেছে। কথা হচ্ছিল মায়ের চলে যাওয়া নিয়ে। আমরা দুজনেই তাঁকে খুব ই মিস করেছি। হঠাৎ করে সুরিতা আমায় বলল “জানো বাবুই (সুজাতা) আমায় বলল দিদি তুমি কষ্ট পেও না, মা আজকে এসেছিল এবং সব কিছু খেয়ে গেছে”। তারপর বলল, সোনা মা, অনুষ্ঠানের জায়গা থেকে বার হয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল, হঠাৎ করে দেখে একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলা, গাছের নীচে একটি বেদিতে বসে আছেন। ও কৌতূহলী হয়ে ওনার কাছে যাওয়াতে উনি বলেন, “মা বড় খিদে পেয়েছে, আমাকে কিছু খেতে দেবে?” তখনও খাওয়া – দাওয়া শুরু হয় নি, সব পদ টেবিলে আসেও নি, সেই জন্য ও একটি প্লেটে চিকেন পকোড়া আর বেবি কর্ণ এনে ওনার হাতে দেয়। উনি তৃপ্তি করে সব খান। তারপর উনি ওকে জিজ্ঞাসা করেন “মা আর কিছু নেই?” । ও তখন বলে “আপনি একটু বসুন, কোথাও যাবেন না, আমি একটু পরে সব নিয়ে আসছি”। তারপর কেক কাটা, মালা বদল এই সবের মধ্যে বেচারি ভুলে গেছিল। যখন খেয়াল হয়েছে, তখন ও ওর বাবা – মাকে সব বলে। ওরা বেরিয়ে এসে দেখে যে সেই ভদ্রমহিলা তখনও বসে আছেন। এবার ওরা গিয়ে প্লেটে করে সব খাবার সাজিয়ে আনে, উনি তৃপ্তি করে সব খাবার খান। তারপর জিজ্ঞাসা করেন “মিস্টি কিছু নেই?” মিষ্টির একটাই পদ ছিল ওরা সেটা এনেছিল, ওরা বলে “ওই তো মিষ্টি”। উনি সেটাও তৃপ্তি করে খান। ওরা তারপর প্লেট নিয়ে চলে যায় আইসক্রিম আনতে কিন্ত একটু দূরে যাওয়ার পরে ফিরে তাকিয়ে তাঁকে আর দেখতে পায় নি। অবাক ঘটনা এটাই যে আমার বন্ধু গৌতম, সে ও ওই ভদ্র মহিলাকে দেখে পার্থ সেনগুপ্ত কে বলেছিল কিছু খাবার নিয়ে ওনাকে খাওয়াতে। পার্থ বলেছিল যাচ্ছে কিন্ত ও গিয়ে কাউকে দেখতে পায় নি। সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা এটাই যে, ওই ভদ্রমহিলা ঠিক সেই খাবার গুলিই চেয়ে চেয়ে খেয়েছিলেন যেগুলি আমার শাশুড়ি মায়ের সবচেয়ে প্রিয় খাবার ছিল (মানে অনুষ্ঠানে যে পদ গুলি হয়েছিল তার মধ্যে)। আরও অবাক করা ঘটনা, পার্থ এবং আমার শালী – ভগ্নীপতিরা ওনাকে যখন খোঁজ করছে তখন ওখানে যে সব গাড়ি গুলি পার্ক করা ছিল (নিমন্ত্রিতদের) তার ড্রাইভারদের জিজ্ঞাসা করে, ওই মহিলা কোথায় গেলেন, তাঁরা বলেন যে, তাঁরা ওই রকম কোন মহিলাকে দেখে নি। ওনাকে যখন ওরা দেখতে পেল না, তখন ওরা মাঠের গেটে এসে রাস্তার দু পাশে চোখ বোলায়। ওরকম কোন মহিলা হেঁটে যাচ্ছেন তাও ওরা দেখে নি। সুরিতা ওদের বলেছিল, তোরা আমাদের ডাকিস নি কেন? ওরা বলেছিল, তোমরা তখন এত ব্যস্ত যে তোমাদের বিরক্ত করতে চাই নি। এটা একদমই সত্যি কথা।

আমার যুক্তিবাদী মন বলছে, এটা একান্তই কাকতালীয় ঘটনা। কারণ ১) ভদ্র মহিলা মাঠের গেটের উল্টোদিকের গলি পথে যদি চলে যান, তাহলে রাস্তায় ওনাকে দেখা যেতেই পারে না। ২) ড্রাইভাররা সচরাচর নিজেদের মধ্যে গল্পে ব্যস্ত থাকে, কে এল কে গেল তার দিকে নজর না থাকাই স্বাভাবিক এবং ৩) অনেক মানুষের খাবারের পছন্দ অন্যের সাথে মিলে যায়।

একই সঙ্গে এটাও মনে হচ্ছে যে সুরিতা এবং তার দুই বোন যদি এই বিশ্বাস নিয়ে শান্তি পেতে চায়, যে তাঁদের মা এই অনুষ্ঠানে এসে আমাদের আশীর্বাদ করে গেছেন তাতে আমার তো কোন ক্ষতি নেই।
আমি জানি না পাঠক কোন মতে বিশ্বাসী হবেন, কোন মত গ্রহণ করবেন – সে স্বাধীনতা আপনাদের উপর থাক। আমি শুধু তৃপ্তি পেয়েছি একটি বিষয়ে, আজকের প্রজন্মের মধ্যেও এমন সুন্দর মন আছে, যারা আনন্দ অন্যের সাথে ভাগ করে নিতে পারে।

শেষ করছি এই কটি কথা বলে
“এই মনটা সারা জীবন ধরে রাখিস মা”

No comments:

Post a Comment