08 January, 2019

প্রতিটি মানুষের জীবনে পাওয়া - না পাওয়া, দুঃখ - আনন্দ মিলেমিশে থাকে। তারই নাম জীবন। আজকের দিনটা আমাদের অনেকের জীবনে এক পরম পাওয়ার দিন, দারুণ আনন্দের দিন কারণ আজকের দিনটা হারিয়ে যাওয়া বন্ধুত্বকে - যে বন্ধুত্ব মানুষের প্রথম বন্ধুত্ব, সেই ছোটবেলার বন্ধুত্বকে খুঁজে পাওয়ার দিন।
ছোটবেলার বন্ধুত্বে কোন মালিন্য থাকে না, কোন চাওয়া - পাওয়ার ক্ষেত্র থাকে না, সে তো এক হাসি - খেলার দিন। ১৯৭৮ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর এইরকমই কিছু ছোট্ট মানুষ একে অন্যের সাথে শেষ বার মিলেছিল, তারপর সময়ের তাগিদে, জীবনের চাহিদায় ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন দিকে। কারো কারো মধ্যে পারস্পরিক, যোগাযোগ থাকলেও তা অনেক ক্ষেত্রেই ছিল সাময়িক। গত বছরের এই দিনটায় আমরা আবার মিলিত হয়েছিলাম এক সাথে। আমাদের কাছে সত্যিই এই দিনটা একটা আলাদা মাধুর্য নিয়ে এসেছিল।
সলতে পাকানোর কাজটা শুরু করেছিল ৩ জন, পার্থ, বিমান এবং শ্রবণা। কোন একদিন হঠাৎ করেই পার্থ আর বিমানের মধ্যে কোন এক ব্যাংকে দেখা হয়। স্বাভাবিক ভাবেই ফোন নম্বর আদান প্রদানের মধ্যে দিয়ে যোগাযোগ শুরু হয়। ওদের মাথাতেই প্রথম এই চিন্তা আসে, পুরানো বন্ধুদের সাথে আবার যদি নতুন করে যোগাযোগ করা যায় তাহলে কেমন হয়। ওরা দুজনে কাজে নেমে পড়ে। নানা রকম সূত্রের মধ্যে থেকে ফোন নাম্বার যোগাড় করার চেষ্টা চলতে থাকে। পার্থর সাথে আমার তার আগে দু এক দিন দেখা হয়েছিল, ফলে ওর কাছে আমার নাম্বার ছিল। কোন ভাবে ওদের কাছে শ্রবণার নাম্বার আসে। ব্যস্‌! দুই পাগল ছিল, জুটে গেল এক পাগলী। ৩ পাগলে মিলে খুঁজে বেড়াতে লাগল হারানো রতন। ওদের পাগল - পাগলী বললাম কারণ আজকের এই স্বার্থপর সময়ে নিজেদের কাজের ফাঁকেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের খোঁজার চেষ্টা পাগলামো ছাড়া আর কি! আজকের দিনে ভালোবাসা শব্দটাই তো এক পাগলামো।
এক সন্ধ্যায় আমার কাছে পার্থর ফোন, "একজন তোর সাথে কথা বলবে।" শ্রবণার গলা ভোলার কথা নয়, ভুলিইও নি। ওর গলায় এমনই একটা উদার মনের সন্ধান পাওয়া যেত, যাকে বড় আপন বন্ধু বলে মনে হত। তাছাড়া কলেজ এবং চাকরী জীবনের প্রথম দিকে দু এক বার ওদের বাড়িতেও গেছিলাম। তখনও মানুষটা ছোটবেলার শ্রবণাই ছিল। ওর কাছে জানলাম, যে একটা হোয়াটস্‌ অ্যাপ গ্রুপ খোলা হয়েছে ছোটবেলার বন্ধুদের নিয়ে, নাম দেওয়া হয়েছে "বিবেক ভারতী, ১৯৭৮"। যদিও হোয়াটস্‌ অ্যাপ নামক বস্তুটিকে আমি পছন্দই করি না, তবুও পুরানো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের সুযোগ ছাড়তে ইচ্ছা করছিল না আবার একটু ভয় ও লাগছিল। জীবনে নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশী অসভ্য আচরণ এবং আঘাত পেয়েছি তাই ঝট করে কাউকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। তবে যেহেতু বিবেক ভারতী নামটা চিরকালই আমার অত্যন্ত দুর্বলতার জায়গা, শ্রদ্ধার এবং ভালোবাসার জায়গা কারণ আমার শিক্ষা জীবন এবং কর্ম জীবন শুরু হয়েছিল "বিবেক ভারতী শিশু শিক্ষা সদন" এ । এখনও স্কুলের সাথে আমার মানসিক যোগাযোগ আছে, কলকাতায় যখন ছিলাম, সরস্বতী পুজো এবং স্পোর্টসের দিন স্কুলে যাই নি, এমন হয়েছে বলে মনে করতে পারি না। যাই হোক, যোগাযোগ শুরু হল এবং বাড়তে থাকল।
এবার একদিন প্রস্তাব এল সকলে একদিন বসে আড্ডা মারলে কেমন হয়? গত বছর এই দিনটা শনিবার ছিল, ঠিক হল এইদিনের পার্থর ফার্ন রোডের ফ্ল্যাটে দেখা হবে। এর মধ্যে একদিন পোদ্দার এবং শুভঙ্করের সাথে আমাদের দুজনের কথা হয়েছে, কথা হয়েছে বিমানের সাথেও। ঠিক হল, গাড়ির ব্যবস্থা করবে বিমান। ও আর পার্থ, পোদ্দার আর শুভঙ্করকে নিয়ে আমাদের তুলে নেবে, তারপর সোমা উঠবে তালতলা মোড় থেকে, শ্রবণা ঘোষ পাড়া এবং রিন্টু উঠবে রুবি থেকে। জানলাম মলি নিজের গাড়িতে অদিতিকে নিয়ে চলে আসবে, বাকি কয়েকজন নিজেরা আসবে।
এল সেই দিন। তার আগে থেকেই আমরা দুজন বেশ উত্তেজিত। কতদিন পরে দেখা হবে? কে বলে কতদিন পরে? কে বলে ৪০ বছর পরে দেখা হল? পোদ্দার (আসলে আমাদের দুই পার্থ – একজন সেনগুপ্ত অন্যজন পোদ্দার, নাম ছোট করা আমাদের স্বভাব, তাই একজন হল পার্থ আর অন্যজন পোদ্দার!) আর শুভ হেঁটেই চলে এসেছে। যখন দেখা হল, যে ভাবে আমরা একে অন্যকে সম্বোধন করলাম, জড়িয়ে ধরলাম, মনে হল আমাদের মধ্যে কোন বিচ্ছেদ হয়ই নি। এক এক করে এল সকলে, প্রতিবারই হই হই আওয়াজ! শ্রবণা যখন উঠল তখনই দেখা গেল, ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই / ছোট সে তরী। তখনও রিন্টুর ওঠা বাকি। আসলে আমরা সকলেই তো মোটামুটি ভালোই আছি। ড্রাইভারের পাশে আমি (সেখানে অন্য কাউকে বসানোর কথা চিন্তা করাও চরম উন্মাদের কাজ) তার পিছনে মাঝের সীটে শ্রবণা, সোমা সুরিতা। পিছনের ৪ টে সীটে পোদ্দার, শুভ আর বিমান। এর মধ্যে অন্য কেউ ওঠা মানে বনগাঁ লোক্যাল বলবে আমি ভালো আছি। রুবি মোড়ে রিন্টুকে দেখার পর! উফফ্‌! সে কি অভিজ্ঞতা! আমার মনে হয় সবচেয়ে বেশী সমস্যা হচ্ছিল ড্রাইভার ভাইটির। একে তো আমাদের অমায়িক গলা, বিশেষত আমি আর শ্রবণা। সুরিতা আর শুভর গলা মোটামুটি সভ্য – ভদ্র কিন্ত তাতেও তো মনে হচ্ছিল সুভাষ দত্ত থাকলে বলতেন “৯০ ডেসিবেলের অনেক উপরে, এখুনি গলায় সাইলেন্সার, না হলে মুখে সেলোটেপ লাগাতে হবে।“ তারপর এই সব চেহারা, গাড়ির টায়ার আস্ত থাকবে তো?
এবার ফার্ন রোড! প্রায় আমাদের সাথে সাথেই এসে গেল অদিতি আর মলি! এরপর আগে পিছে এল দুই আশিস, দেবাশিস, গৌতম, দেবযানী আর দীপক। কারোর চোখই এবার আর শুকনো থাকল না – সকলের চোখে আনন্দাশ্রু । তার পরের সময়ের কথা বোধ হয় আমরা কেউ লিখে বোঝাতে পারব না, যারা ওখানে ছিল তারা কেউই বুঝতে পারল না, সময় কোথা দিয়ে কিভাবে কেটে গেল। একটা কথা বললেই মনে হয় যথেষ্ট হবে, মলি আর অদিতি বলেছিল, ৫ টা নাগাদ বার হয়ে যাবে, ওরা বার হল আমাদের সকলের সাথেই, ঘড়ির কাঁটায় তখন ৭ টা পার হয়ে গেছে। আমাদের মধ্যে দিব্যেন্দু সেই সময় সুদূর সুরাটে, ওর সাথেও কথা হল ভিডিও কলে। সকলের অনুরোধে মলি ধরল “পুরানো সেই দিনের কথা”, আমরা হারিয়ে গেলাম।
এ মিলন মেলার কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, এ তো “হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব”। তারপর আরও অনেক বার মিলেছি, আরও অনেকে যোগ দিয়েছে, সময় করতে না পারার জন্য দু একজন চলেও গেছে, তবু প্রথম বারের এ মিলন মেলার স্মৃতিতে আমরা কয়েকজন আজও আচ্ছন্ন! এ লেখা শেষ হয় না কারণ এ লেখা গত এক বছর ধরে চলছে, চলবে আরও আরও অনেক দিন। তবু কলম তো এক সময় বন্ধ করতেই হয়, তাই বন্ধ করতে বাধ্য হলাম। শেষ করি আমাদের প্রিয় শিবাণী মিসের লেখা ও সুর করা সেই গানটি দিয়ে, যে গান জড়িয়ে আছে আমাদের সকলের প্রাণে, হয়তো বা বিবেক ভারতী শিশু শিক্ষা সদনের ছাত্র – ছাত্রীরা কোথাও স্কুল থেকে একসাথে বেড়াতে গেলে আজও সেই গানটি গায় –
“আমরা চলেছি বিবেক ভারতী
আনন্দ গান গেয়ে,
চলেছি আমরা সব ভাই বোন
সকলকে সাথে নিয়ে।
লেখাপড়া আজ নাই
আমরা বেড়াতে যাই,
বছরে একটা দিন ভাই
আসে সুন্দর হয়ে
আমরা চলেছি তাই,
আনন্দ গান গেয়ে।“
সঙ্গের ছবি দুটির প্রথম টি গত বছরের মিলন মেলার দিন অদিতির ছেলের তোলা এবং দ্বিতীয়টি দ্বীপান্বিতার কাছ থেকে পাওয়া।

No comments:

Post a Comment