01 February, 2019

তিন কুকুরের কাহিনী

পূর্ব কথন
ভেবেছিলাম অন্য কোন এক সময়ে লিখব যখন অন্য কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা চলবে তখন লিখব - লিখব ৩ টে কুকুরের কাহিনী
আমি বাধ্য হলাম আজ
আমি তাই লিখছি সেই তিন কুকুরের কাহিনী
সেই তিন কুকুর
যারা হয়তো মানুষের চেয়ে অনেক বড়
(দেবশ্রী এবং দেবলীনার চেয়ে ছোট
কারণ ওই তিন কুকুর দেব শ্রী এবং দেবলীনার মত বিষয় ভেদে “ঘেঊ ঘেউ” করে না)
প্রথম কুকুর –
সেই কুকুর টাকে আমরা কালু বলে ডাকতাম। যদিও তাকে “কালী” বলা উচিত ছিল কারণ সে তো মহিলা কুকুর ছিল। কালু অবশ্য পুরুষ মহিলা নিয়ে ভাবত না, কালু কারো কাছে খাবার চাইত না।
তখন ১৯৭৮ – আমার বয়স ১০
আমাদের নতুন বাড়ি হচ্ছে – রামকৃষ্ণ নগরে, নিরালার (মল্লিক বাড়ির) পাশে। “কালুয়া” নামটা বোধ হয় আমিই দিয়েছিলাম রং কালো বলে, লিঙ্গ ভেদ বুঝতে শিখি নি সেই প্রাচীন কালে। আমার শরীরে পক্স, জানলা দিয়ে দেখি বাড়ির কাজ চলছে, আর দেখি একটা কালো কুকুর করে ঘেউ ঘেউ (তখন জানতাম না ভবিস্যতে লেখা হবে কাব্য “মা কোথায় – ঘেউ ঘেউ”)! কালো রং বড় পছন্দ করি আমি, তাই নাম দিলাম “কালুয়া”
জানতাম না, আমার দেওয়া ওই নাম মেনে নেবেন মল্লিক দাদু, বড় মামা এবং পাড়ার অন্য সব্বাই।
কালুয়া – একটা রাস্তার কুকুর ছিল অথবা রাস্তার কুকুর ছিল না!
কালুয়া ঘুরে বেড়াত রামকৃষ্ণ নগরের কয়েক টা বাড়ির মাঝে
সেই সব বাড়ি থেকে যা খাবার পাওয়া যায় অথবা খাবার পাওয়া যেত না
তা দিয়ে কালুয়ার পেট চলত
কালুয়া কিন্ত বোস জেঠুর কথা সবচেয়ে বেশী মেনে চলত
একটা দিনের না সে এক রাত্রি র কথা বড় মনে পরে
কোন এক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত আমরা সবাই
কালুয়াকে কেউ নিমন্ত্রণ দেয় নি
(পথ কুকুর কে কেউ নিমন্ত্রণ দেয় নাকি
পথ কুকুর তো জন্মেছে উচ্ছিষ্ট খাওয়ার জন্য)
সেদিন রাতে এঁটো পাত পড়ছিল
পাড়ার অন্য কুকুর গুলো ভুখা পেটে
খাবার ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য লাফাচ্ছিল
ঘেউ ঘেউ করছিল
কালুয়া ও ছুটে ছুটে যাচ্ছিল
কিন্ত খাবারে মুখ দেয় নি
যতক্ষণ পর্যন্ত বোস জেঠু ওর মুখে
নিজের হাতে খাবার তুলে দেয় নি
ততক্ষণ পর্যন্ত কালুয়া খাবারে মুখ দেয় নি।
১৯৮৪ সাল –
কালুয়া তখনও জীবিত
আমি গড়িয়া ছাড়লাম
১৯৮৭ সালে ফিরে এসে কালুয়াকে দেখতে পাই নি
শুনলাম কেউ নাকি ওকে বিষ দিয়ে খুন করেছে।
না ১৯৮৭ সালে ফেসবুক ছিল না
তখন কুকুর প্রেমীদের কেউ চিনত না
২০১৯ এ মরলে কালুয়া সেলিব্রিটি হয়ে যেত
ফিল্ম আর টি ভির নায়িকাদের চোখের জলে বালতি ভরে যেত
তারপর যে জল অবশিষ্ট থাকত তা শুষে নিতে
সাহারায় শিহরণ জাগত
অভাগী কালুয়া – দুর্ভাগী কালুয়া
এল ১৯৯৬ আমি তখন বোলপুরে পোস্টিং, এক বছর ভাড়া বাড়িতে থাকার পর চলে এলাম সিয়ান অফিস আবাসনে। দু চারদিনের মধ্যেই পরিচয় হয়ে গেল আর এক “কালু”র সাথে। মজার কথা, সেও কিন্তু “কালী”। সকালে দুটো বিস্কুট, দুপুরে এবং রাতে আমাদের উচ্ছিস্ট এই ছিল তার বরাদ্দ। বিনিময়ে ল্যাজ নাড়ত, পায়ে পায়ে ঘুরত। অবলা জীব, কথা বলতে পারে না, (নিজের দাবী চেঁচিয়ে বললেও কুকুর প্রেমী বাদে অন্য কেউ বোঝে না) মানুষ আমি তবুও আনন্দ পেতাম না আসলে আমি ওর কাছে ঋণী আমি কৃতজ্ঞ থাকতাম। কেন ঋণী ছিলাম?
অফিসের কাজে আমাকে মাঝে মাঝে কলকাতা যেতে হত। বিশ্ব ভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ধরে যেতাম – ফিরতাম সেই গাড়িতেই। কখনো কখনো পরের দিন শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ধরে ফিরতাম। এরকম একটা পরের দিন বাড়ি ফিরেছি।
সুরিতা মানে Surita Banerjee বলল “জানো কাল এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। সন্ধ্যা বেলা লোডশেডিং – আমি “বিপদ” এর দোকান ছাড়িয়ে পাশের মুদি দোকানে পাঁউরুটি নিতে যাচ্ছি হঠাৎ পায়ের কাছে খস খস শব্দ। চমকে তাকিয়ে দেখি দুটো চোখ জ্বলছে। আমাকে দাঁড়াতে দেখেই একটা ছোট্ট আওয়াজ এল ভৌ! বুঝলাম কালু। সে দেখেছে তুমি বাড়ি নেই, তাই আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে এসেছে এবং বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে”।
এত এক রাত্রের কথা। আসলে আমি তো হিপোক্রিট কুকুরের মনের কথা বুঝতে পারি না, তাই রাস্তার কুকুর রা ও মানুষের চেয়ে বেশী আমাকে ঘৃণা করে। আমরা মর্নিং ওয়াকে বার হতাম। সবচেয়ে সমস্যা ছিল “কালু” কে নিয়ে। ও বেচারী মর্নিং ওয়াক কাকে বলে জানে না, ও জানে ওই দুটো দো পেয়ের পিছনে ওকে ন্যাজ নাড়িয়ে চলতে হবে, যাতে এই লেখক দো পেয়ের ইগো পরিতৃপ্ত হয় (সেদিন এভাবে ভাবি নি এখনও ভাবি না – সন্তান ছাড়া এই মানুষ দুটো ওদের নিজের সন্তান বলে ভাবে – সেন্টু দিলাম না) কিন্ত বে পাড়ার কুকুর গুলো তো কুকুরাধিকার (মানে এলাকার অধিকার) খুব ভালো করেই জানত (ফলে তারা তাড়া করত)। নিরীহ নারীর উপরে পুরুষের অত্যাচার! নারী কে কোন কোন দিন আমাদের মর্নিং ওয়াক অসমাপ্ত রাখতে হত। পরের দিকে হাত ভর্তি ঢিল নিয়ে বার হতাম। সীমান্ত পার হওয়ার পরে যদি দেখতাম বিপক্ষ সেনা নেই তাহলে নীরবে পথ চলতাম, যেই দেখতাম বিপক্ষ সেনা, চার হাতে ঢিল চলত ৩ ফুট দূর দিয়ে! প্রথমত কালুকে ভাগানো – দ্বিতীয়ত কালুকে বাঁচান। হতচ্ছাড়ি পরে বুঝে গেছিল আমরা ওকে মারব না, তাই ঢিল ছুঁড়লেও আমাদের পিছু পিছু আসত। আমি এবং সুরিতা চূড়ান্ত হিপোক্রিট তাই ওর গায়ে কোন দিন ঢিল মারতে পারি নি। আসলে কুকুর তো মানুষের মত কথা বলতে পারে না তাই আমরা ওর কথা বুঝতেও পারি নি।
এবার আসি “রাজা”র কথায়। চেহারা – আচার – আচরণে একদম রাজা সে। সঙ্গে দেওয়া ছবি দেখলেই বোঝা যাবে কেন ওর নাম দিয়েছিলাম “রাজা”। প্রথমে “রাজা”র সাথে আলাপ ছিল না, কালু কে দুপুর বেলা খেতে দেওয়ার সময় মাঝে মাঝে দেখতাম ও তাকিয়ে আছে। একদিন কি মনে হল, কালুকে খাবার দেওয়ার সময় ওকেও ডেকে নিলাম। একটু খাবার ওকেও দিলাম। বন্য জন্ত আমি, মানুষ নাম, মানুষের কথাই বুঝতে পারি না, অবলা জীবের কথা বুঝব কি করে? অবলা জীবের কথা বোঝে বড় বড় মানুষের দল। তবুও ওর চোখ দেখে কেন জানি মায়া পড়ে গেল। তারপর থেকে একের জায়গায় দুই হল। কি দিতাম ওদের? একটু খানি ভাত, মাছ বা মাংসের ঝোল, আর কাঁটা চোপড়া। ওরা বড় তৃপ্তি করে খেত। রাজা নিজের টা খেয়ে আবার কালুর খাবারে ভাগ বসাতে চাইত, তাই একটা লাঠি হাতে রাখতে হত। ঠক্‌ ঠক্‌ করে ভয় দেখাতাম। যেহেতু হিপোক্রিট তাই কোনও দিন আঘাত করতে পারি নি। কালু দিনে আর রাতে খেত, রাতে দিতাম দুটো শুকনো রুটি। রাজা রাতে খেতে আসত না।
সবচেয়ে মজার কথা, দুপুর বেলা আমি যখন অফিস থেকে বার হয়ে বাড়িতে খেতে আসতাম রাজা আর কালু সেই সময়েই আমার বাড়ির (মানে OFFICE QUARTERS) এর সামনে চলে আসত (আগে পরে নয়)। আমার ফ্ল্যাট ছিল গ্রাউণ্ড ফ্লোরে। QUARTERS কমিটির একটি সামান্য দায়িত্বে ছিলাম বলে মাঝে মাঝে রাতে ব্যালকনি টপকে বার হতাম – দেখতাম নাইট গার্ড রা ঠিক ঠাক পাহারা দিচ্ছে কিনা। সব সময় আমার সাথে থাকত কালু আর রাজা – মেরা সাথী।
এ তো না হয় হল। প্রায় ২০ দিনের ছুটি নিয়ে বেড়াতে গেলাম দক্ষিণ ভারত। এক দুপুর বেলা ফিরলাম। দেখি ফ্ল্যাটের একদিকে কালু আর অন্যদিকে রাজা। তারপর যা শুনলাম তা শুনে চোখের জল ধরে রাখতে পারি নি আমরা দুজনেই। প্রতি রাত্রে ওরা দুজন গোটা ক্যাম্পাসে র কোথাও যায় নি, আমাদের ফ্ল্যাটের দু পাশে বসে থেকেছে আর ঘুরে বেড়িয়েছে। রাতে নাইট গার্ড রা ও সে কথাই বললেন।
আর এক সন্ধ্যা! ফ্ল্যাট থেকে বার হচ্ছি হঠাৎ করে রাজা – মুখে একটা শুয়োর ছানা। এনে আমার পায়ের সামনে নামিয়ে রাখল। আমি অবাক! পাশে আরও দু একজন ছিল, তারা ও চুপ। উনি বেশ ল্যাজ নাড়ছেন, খুব আনন্দ আর কি! আমি বুঝলাম, উনি পাশের জঙ্গল থেকে ওটা শিকার করে আমাকে ভেট দিতে এসেছেন। এক ধমক দিলাম। মাথা নিচু করে বসে থাকল। তারপর ওটা মুখে করে নিয়ে চলে গেল। পরের দিন দুপুর বেলা খেতে এল না। মহারাজার রাগ হয়েছে। অনেক সাধ্য – সাধনা করে খাওয়াতে হয়েছিল।
২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চলে এলাম বোলপুর থেকে। মাস ছয়েক বাদে কোন একটা কাজে আবার গেলাম এক রাতের জন্য। উঠেছিলাম Sumit Senguptaর QUARTERS এ। সকাল বেলা মর্নিং ওয়াকে বার হয়েছি, দেখলাম কালু। আমার সাথে হাঁটল। ফিরে এসে সুমিত কে বললাম কালুর কথা। সুমিত বলে তুই ওকে খেতে দিতিস না, তাই ও তোকে ভোলে নি। আমার চোখে তখন জল।
হিপোক্রিট আমি তাই এ লেখা লিখতে লিখতে বার বার চোখে জল এল। তবু ধন্যবাদ কোন এক মানুষকে তিনি আমাকে “হিপোক্রিট” বলে আমার হাত থেকে এ স্মরণিকা বার করে নিলেন।
আপনাকে প্রণাম।

No comments:

Post a Comment