01 February, 2019

তিন কুকুরের কাহিনী

পূর্ব কথন
ভেবেছিলাম অন্য কোন এক সময়ে লিখব যখন অন্য কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা চলবে তখন লিখব - লিখব ৩ টে কুকুরের কাহিনী
আমি বাধ্য হলাম আজ
আমি তাই লিখছি সেই তিন কুকুরের কাহিনী
সেই তিন কুকুর
যারা হয়তো মানুষের চেয়ে অনেক বড়
(দেবশ্রী এবং দেবলীনার চেয়ে ছোট
কারণ ওই তিন কুকুর দেব শ্রী এবং দেবলীনার মত বিষয় ভেদে “ঘেঊ ঘেউ” করে না)
প্রথম কুকুর –
সেই কুকুর টাকে আমরা কালু বলে ডাকতাম। যদিও তাকে “কালী” বলা উচিত ছিল কারণ সে তো মহিলা কুকুর ছিল। কালু অবশ্য পুরুষ মহিলা নিয়ে ভাবত না, কালু কারো কাছে খাবার চাইত না।
তখন ১৯৭৮ – আমার বয়স ১০
আমাদের নতুন বাড়ি হচ্ছে – রামকৃষ্ণ নগরে, নিরালার (মল্লিক বাড়ির) পাশে। “কালুয়া” নামটা বোধ হয় আমিই দিয়েছিলাম রং কালো বলে, লিঙ্গ ভেদ বুঝতে শিখি নি সেই প্রাচীন কালে। আমার শরীরে পক্স, জানলা দিয়ে দেখি বাড়ির কাজ চলছে, আর দেখি একটা কালো কুকুর করে ঘেউ ঘেউ (তখন জানতাম না ভবিস্যতে লেখা হবে কাব্য “মা কোথায় – ঘেউ ঘেউ”)! কালো রং বড় পছন্দ করি আমি, তাই নাম দিলাম “কালুয়া”
জানতাম না, আমার দেওয়া ওই নাম মেনে নেবেন মল্লিক দাদু, বড় মামা এবং পাড়ার অন্য সব্বাই।
কালুয়া – একটা রাস্তার কুকুর ছিল অথবা রাস্তার কুকুর ছিল না!
কালুয়া ঘুরে বেড়াত রামকৃষ্ণ নগরের কয়েক টা বাড়ির মাঝে
সেই সব বাড়ি থেকে যা খাবার পাওয়া যায় অথবা খাবার পাওয়া যেত না
তা দিয়ে কালুয়ার পেট চলত
কালুয়া কিন্ত বোস জেঠুর কথা সবচেয়ে বেশী মেনে চলত
একটা দিনের না সে এক রাত্রি র কথা বড় মনে পরে
কোন এক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত আমরা সবাই
কালুয়াকে কেউ নিমন্ত্রণ দেয় নি
(পথ কুকুর কে কেউ নিমন্ত্রণ দেয় নাকি
পথ কুকুর তো জন্মেছে উচ্ছিষ্ট খাওয়ার জন্য)
সেদিন রাতে এঁটো পাত পড়ছিল
পাড়ার অন্য কুকুর গুলো ভুখা পেটে
খাবার ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য লাফাচ্ছিল
ঘেউ ঘেউ করছিল
কালুয়া ও ছুটে ছুটে যাচ্ছিল
কিন্ত খাবারে মুখ দেয় নি
যতক্ষণ পর্যন্ত বোস জেঠু ওর মুখে
নিজের হাতে খাবার তুলে দেয় নি
ততক্ষণ পর্যন্ত কালুয়া খাবারে মুখ দেয় নি।
১৯৮৪ সাল –
কালুয়া তখনও জীবিত
আমি গড়িয়া ছাড়লাম
১৯৮৭ সালে ফিরে এসে কালুয়াকে দেখতে পাই নি
শুনলাম কেউ নাকি ওকে বিষ দিয়ে খুন করেছে।
না ১৯৮৭ সালে ফেসবুক ছিল না
তখন কুকুর প্রেমীদের কেউ চিনত না
২০১৯ এ মরলে কালুয়া সেলিব্রিটি হয়ে যেত
ফিল্ম আর টি ভির নায়িকাদের চোখের জলে বালতি ভরে যেত
তারপর যে জল অবশিষ্ট থাকত তা শুষে নিতে
সাহারায় শিহরণ জাগত
অভাগী কালুয়া – দুর্ভাগী কালুয়া
এল ১৯৯৬ আমি তখন বোলপুরে পোস্টিং, এক বছর ভাড়া বাড়িতে থাকার পর চলে এলাম সিয়ান অফিস আবাসনে। দু চারদিনের মধ্যেই পরিচয় হয়ে গেল আর এক “কালু”র সাথে। মজার কথা, সেও কিন্তু “কালী”। সকালে দুটো বিস্কুট, দুপুরে এবং রাতে আমাদের উচ্ছিস্ট এই ছিল তার বরাদ্দ। বিনিময়ে ল্যাজ নাড়ত, পায়ে পায়ে ঘুরত। অবলা জীব, কথা বলতে পারে না, (নিজের দাবী চেঁচিয়ে বললেও কুকুর প্রেমী বাদে অন্য কেউ বোঝে না) মানুষ আমি তবুও আনন্দ পেতাম না আসলে আমি ওর কাছে ঋণী আমি কৃতজ্ঞ থাকতাম। কেন ঋণী ছিলাম?
অফিসের কাজে আমাকে মাঝে মাঝে কলকাতা যেতে হত। বিশ্ব ভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ধরে যেতাম – ফিরতাম সেই গাড়িতেই। কখনো কখনো পরের দিন শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ধরে ফিরতাম। এরকম একটা পরের দিন বাড়ি ফিরেছি।
সুরিতা মানে Surita Banerjee বলল “জানো কাল এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। সন্ধ্যা বেলা লোডশেডিং – আমি “বিপদ” এর দোকান ছাড়িয়ে পাশের মুদি দোকানে পাঁউরুটি নিতে যাচ্ছি হঠাৎ পায়ের কাছে খস খস শব্দ। চমকে তাকিয়ে দেখি দুটো চোখ জ্বলছে। আমাকে দাঁড়াতে দেখেই একটা ছোট্ট আওয়াজ এল ভৌ! বুঝলাম কালু। সে দেখেছে তুমি বাড়ি নেই, তাই আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে এসেছে এবং বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে”।
এত এক রাত্রের কথা। আসলে আমি তো হিপোক্রিট কুকুরের মনের কথা বুঝতে পারি না, তাই রাস্তার কুকুর রা ও মানুষের চেয়ে বেশী আমাকে ঘৃণা করে। আমরা মর্নিং ওয়াকে বার হতাম। সবচেয়ে সমস্যা ছিল “কালু” কে নিয়ে। ও বেচারী মর্নিং ওয়াক কাকে বলে জানে না, ও জানে ওই দুটো দো পেয়ের পিছনে ওকে ন্যাজ নাড়িয়ে চলতে হবে, যাতে এই লেখক দো পেয়ের ইগো পরিতৃপ্ত হয় (সেদিন এভাবে ভাবি নি এখনও ভাবি না – সন্তান ছাড়া এই মানুষ দুটো ওদের নিজের সন্তান বলে ভাবে – সেন্টু দিলাম না) কিন্ত বে পাড়ার কুকুর গুলো তো কুকুরাধিকার (মানে এলাকার অধিকার) খুব ভালো করেই জানত (ফলে তারা তাড়া করত)। নিরীহ নারীর উপরে পুরুষের অত্যাচার! নারী কে কোন কোন দিন আমাদের মর্নিং ওয়াক অসমাপ্ত রাখতে হত। পরের দিকে হাত ভর্তি ঢিল নিয়ে বার হতাম। সীমান্ত পার হওয়ার পরে যদি দেখতাম বিপক্ষ সেনা নেই তাহলে নীরবে পথ চলতাম, যেই দেখতাম বিপক্ষ সেনা, চার হাতে ঢিল চলত ৩ ফুট দূর দিয়ে! প্রথমত কালুকে ভাগানো – দ্বিতীয়ত কালুকে বাঁচান। হতচ্ছাড়ি পরে বুঝে গেছিল আমরা ওকে মারব না, তাই ঢিল ছুঁড়লেও আমাদের পিছু পিছু আসত। আমি এবং সুরিতা চূড়ান্ত হিপোক্রিট তাই ওর গায়ে কোন দিন ঢিল মারতে পারি নি। আসলে কুকুর তো মানুষের মত কথা বলতে পারে না তাই আমরা ওর কথা বুঝতেও পারি নি।
এবার আসি “রাজা”র কথায়। চেহারা – আচার – আচরণে একদম রাজা সে। সঙ্গে দেওয়া ছবি দেখলেই বোঝা যাবে কেন ওর নাম দিয়েছিলাম “রাজা”। প্রথমে “রাজা”র সাথে আলাপ ছিল না, কালু কে দুপুর বেলা খেতে দেওয়ার সময় মাঝে মাঝে দেখতাম ও তাকিয়ে আছে। একদিন কি মনে হল, কালুকে খাবার দেওয়ার সময় ওকেও ডেকে নিলাম। একটু খাবার ওকেও দিলাম। বন্য জন্ত আমি, মানুষ নাম, মানুষের কথাই বুঝতে পারি না, অবলা জীবের কথা বুঝব কি করে? অবলা জীবের কথা বোঝে বড় বড় মানুষের দল। তবুও ওর চোখ দেখে কেন জানি মায়া পড়ে গেল। তারপর থেকে একের জায়গায় দুই হল। কি দিতাম ওদের? একটু খানি ভাত, মাছ বা মাংসের ঝোল, আর কাঁটা চোপড়া। ওরা বড় তৃপ্তি করে খেত। রাজা নিজের টা খেয়ে আবার কালুর খাবারে ভাগ বসাতে চাইত, তাই একটা লাঠি হাতে রাখতে হত। ঠক্‌ ঠক্‌ করে ভয় দেখাতাম। যেহেতু হিপোক্রিট তাই কোনও দিন আঘাত করতে পারি নি। কালু দিনে আর রাতে খেত, রাতে দিতাম দুটো শুকনো রুটি। রাজা রাতে খেতে আসত না।
সবচেয়ে মজার কথা, দুপুর বেলা আমি যখন অফিস থেকে বার হয়ে বাড়িতে খেতে আসতাম রাজা আর কালু সেই সময়েই আমার বাড়ির (মানে OFFICE QUARTERS) এর সামনে চলে আসত (আগে পরে নয়)। আমার ফ্ল্যাট ছিল গ্রাউণ্ড ফ্লোরে। QUARTERS কমিটির একটি সামান্য দায়িত্বে ছিলাম বলে মাঝে মাঝে রাতে ব্যালকনি টপকে বার হতাম – দেখতাম নাইট গার্ড রা ঠিক ঠাক পাহারা দিচ্ছে কিনা। সব সময় আমার সাথে থাকত কালু আর রাজা – মেরা সাথী।
এ তো না হয় হল। প্রায় ২০ দিনের ছুটি নিয়ে বেড়াতে গেলাম দক্ষিণ ভারত। এক দুপুর বেলা ফিরলাম। দেখি ফ্ল্যাটের একদিকে কালু আর অন্যদিকে রাজা। তারপর যা শুনলাম তা শুনে চোখের জল ধরে রাখতে পারি নি আমরা দুজনেই। প্রতি রাত্রে ওরা দুজন গোটা ক্যাম্পাসে র কোথাও যায় নি, আমাদের ফ্ল্যাটের দু পাশে বসে থেকেছে আর ঘুরে বেড়িয়েছে। রাতে নাইট গার্ড রা ও সে কথাই বললেন।
আর এক সন্ধ্যা! ফ্ল্যাট থেকে বার হচ্ছি হঠাৎ করে রাজা – মুখে একটা শুয়োর ছানা। এনে আমার পায়ের সামনে নামিয়ে রাখল। আমি অবাক! পাশে আরও দু একজন ছিল, তারা ও চুপ। উনি বেশ ল্যাজ নাড়ছেন, খুব আনন্দ আর কি! আমি বুঝলাম, উনি পাশের জঙ্গল থেকে ওটা শিকার করে আমাকে ভেট দিতে এসেছেন। এক ধমক দিলাম। মাথা নিচু করে বসে থাকল। তারপর ওটা মুখে করে নিয়ে চলে গেল। পরের দিন দুপুর বেলা খেতে এল না। মহারাজার রাগ হয়েছে। অনেক সাধ্য – সাধনা করে খাওয়াতে হয়েছিল।
২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চলে এলাম বোলপুর থেকে। মাস ছয়েক বাদে কোন একটা কাজে আবার গেলাম এক রাতের জন্য। উঠেছিলাম Sumit Senguptaর QUARTERS এ। সকাল বেলা মর্নিং ওয়াকে বার হয়েছি, দেখলাম কালু। আমার সাথে হাঁটল। ফিরে এসে সুমিত কে বললাম কালুর কথা। সুমিত বলে তুই ওকে খেতে দিতিস না, তাই ও তোকে ভোলে নি। আমার চোখে তখন জল।
হিপোক্রিট আমি তাই এ লেখা লিখতে লিখতে বার বার চোখে জল এল। তবু ধন্যবাদ কোন এক মানুষকে তিনি আমাকে “হিপোক্রিট” বলে আমার হাত থেকে এ স্মরণিকা বার করে নিলেন।
আপনাকে প্রণাম।

25 January, 2019

গল্প হলেও সত্যি অথবা সত্যি হলেও গল্প।


(প্রথমেই বলে রাখি এ ঘটনা বাস্তবের এবং এই ঘটনার মূল চরিত্রকে আমি নিজের চোখে দেখি নি, পুরো ঘটনা শুনেছি, এমন কিছু প্রিয় মানুষের কাছ থেকে, আমায় মিথ্যা বলে তাদের কোন লাভ নেই।)

ঘটনার সময়কাল ১৭/০১/২০১৯ তারিখ, আমাদের বিয়ের রজত জয়ন্তী পূর্ণ হওয়ার সন্ধ্যাবেলার। এই ঘটনা বলার আগে একটু পূর্ব কথন দরকার। আমার বন্ধু যারা ফেসবুকে আছেন, তাঁরা জানেন, গত ০৪/১২/২০১৮ তে সুরিতার মা শ্রীমতি গৌরী সেন অত্যন্ত আকস্মিক ভাবে প্রয়াত হন। তার আগের দিনই তাঁকে আমরা আমাদের বিবাহ বার্ষিকীর নিমন্ত্রণ জানাই এবং যে মানুষ বাড়ি থেকে বার হতে চাইতেন না, সেই মানুষ জানান যে তিনি অবশ্যই সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। তাঁর অকাল মৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাহত হলেও অনুষ্ঠান বন্ধ না করার সিদ্ধান্ত হয়, বিশেষত যখন জানা যায়, যে তিনি বেশ কিছু আত্মীয় পরিজন কে ১৭ তারিখের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন।

পরবর্তী ঘটনা আমার কানে আসে ১৭ তারিখের রাতে। তখন নিমন্ত্রিতরা সকলেই বিদায় নিয়েছেন, সুরিতা আমাদের ফ্ল্যাটে গেছে জিনিস পত্র রাখতে। আমি, আমার দুই শালি সুজাতা ও মিলিতা, দুই ভায়রা কুন্তল ও শান্ত এবং তাঁদের দুই ছেলে মেয়ে কস্তূরী ও সৌমিক (সোনা মা ও কুট্টুস) রয়েছি। টুকটাক আলোচনা চলছে, হঠাৎ করে সুজাতা আমাকে বলল, জানো আজকে অনুষ্ঠানের সময় একটি ঘটনা ঘটেছে। একজন বয়স্কা মহিলা সোনা মার কাছে কিছু খেতে চেয়েছিলেন, ও খাবার নিয়ে তাঁর হাতে দিয়েছে, তিনি খুব তৃপ্তি করে খেয়েছেন। আমি মনে মনে বললাম, “এই অনুষ্ঠান সার্থক হল” আর সোনা মার দিকে চেয়ে বললাম “এই মন টা সারা জীবন ধরে রাখিস মা”।

সেদিন রাতে ঘুম আসে নি দীর্ঘ ক্ষণ, রাত সাড়ে বারোটার পরেও ফোন বেজেছে। কথা হচ্ছিল মায়ের চলে যাওয়া নিয়ে। আমরা দুজনেই তাঁকে খুব ই মিস করেছি। হঠাৎ করে সুরিতা আমায় বলল “জানো বাবুই (সুজাতা) আমায় বলল দিদি তুমি কষ্ট পেও না, মা আজকে এসেছিল এবং সব কিছু খেয়ে গেছে”। তারপর বলল, সোনা মা, অনুষ্ঠানের জায়গা থেকে বার হয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল, হঠাৎ করে দেখে একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলা, গাছের নীচে একটি বেদিতে বসে আছেন। ও কৌতূহলী হয়ে ওনার কাছে যাওয়াতে উনি বলেন, “মা বড় খিদে পেয়েছে, আমাকে কিছু খেতে দেবে?” তখনও খাওয়া – দাওয়া শুরু হয় নি, সব পদ টেবিলে আসেও নি, সেই জন্য ও একটি প্লেটে চিকেন পকোড়া আর বেবি কর্ণ এনে ওনার হাতে দেয়। উনি তৃপ্তি করে সব খান। তারপর উনি ওকে জিজ্ঞাসা করেন “মা আর কিছু নেই?” । ও তখন বলে “আপনি একটু বসুন, কোথাও যাবেন না, আমি একটু পরে সব নিয়ে আসছি”। তারপর কেক কাটা, মালা বদল এই সবের মধ্যে বেচারি ভুলে গেছিল। যখন খেয়াল হয়েছে, তখন ও ওর বাবা – মাকে সব বলে। ওরা বেরিয়ে এসে দেখে যে সেই ভদ্রমহিলা তখনও বসে আছেন। এবার ওরা গিয়ে প্লেটে করে সব খাবার সাজিয়ে আনে, উনি তৃপ্তি করে সব খাবার খান। তারপর জিজ্ঞাসা করেন “মিস্টি কিছু নেই?” মিষ্টির একটাই পদ ছিল ওরা সেটা এনেছিল, ওরা বলে “ওই তো মিষ্টি”। উনি সেটাও তৃপ্তি করে খান। ওরা তারপর প্লেট নিয়ে চলে যায় আইসক্রিম আনতে কিন্ত একটু দূরে যাওয়ার পরে ফিরে তাকিয়ে তাঁকে আর দেখতে পায় নি। অবাক ঘটনা এটাই যে আমার বন্ধু গৌতম, সে ও ওই ভদ্র মহিলাকে দেখে পার্থ সেনগুপ্ত কে বলেছিল কিছু খাবার নিয়ে ওনাকে খাওয়াতে। পার্থ বলেছিল যাচ্ছে কিন্ত ও গিয়ে কাউকে দেখতে পায় নি। সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা এটাই যে, ওই ভদ্রমহিলা ঠিক সেই খাবার গুলিই চেয়ে চেয়ে খেয়েছিলেন যেগুলি আমার শাশুড়ি মায়ের সবচেয়ে প্রিয় খাবার ছিল (মানে অনুষ্ঠানে যে পদ গুলি হয়েছিল তার মধ্যে)। আরও অবাক করা ঘটনা, পার্থ এবং আমার শালী – ভগ্নীপতিরা ওনাকে যখন খোঁজ করছে তখন ওখানে যে সব গাড়ি গুলি পার্ক করা ছিল (নিমন্ত্রিতদের) তার ড্রাইভারদের জিজ্ঞাসা করে, ওই মহিলা কোথায় গেলেন, তাঁরা বলেন যে, তাঁরা ওই রকম কোন মহিলাকে দেখে নি। ওনাকে যখন ওরা দেখতে পেল না, তখন ওরা মাঠের গেটে এসে রাস্তার দু পাশে চোখ বোলায়। ওরকম কোন মহিলা হেঁটে যাচ্ছেন তাও ওরা দেখে নি। সুরিতা ওদের বলেছিল, তোরা আমাদের ডাকিস নি কেন? ওরা বলেছিল, তোমরা তখন এত ব্যস্ত যে তোমাদের বিরক্ত করতে চাই নি। এটা একদমই সত্যি কথা।

আমার যুক্তিবাদী মন বলছে, এটা একান্তই কাকতালীয় ঘটনা। কারণ ১) ভদ্র মহিলা মাঠের গেটের উল্টোদিকের গলি পথে যদি চলে যান, তাহলে রাস্তায় ওনাকে দেখা যেতেই পারে না। ২) ড্রাইভাররা সচরাচর নিজেদের মধ্যে গল্পে ব্যস্ত থাকে, কে এল কে গেল তার দিকে নজর না থাকাই স্বাভাবিক এবং ৩) অনেক মানুষের খাবারের পছন্দ অন্যের সাথে মিলে যায়।

একই সঙ্গে এটাও মনে হচ্ছে যে সুরিতা এবং তার দুই বোন যদি এই বিশ্বাস নিয়ে শান্তি পেতে চায়, যে তাঁদের মা এই অনুষ্ঠানে এসে আমাদের আশীর্বাদ করে গেছেন তাতে আমার তো কোন ক্ষতি নেই।
আমি জানি না পাঠক কোন মতে বিশ্বাসী হবেন, কোন মত গ্রহণ করবেন – সে স্বাধীনতা আপনাদের উপর থাক। আমি শুধু তৃপ্তি পেয়েছি একটি বিষয়ে, আজকের প্রজন্মের মধ্যেও এমন সুন্দর মন আছে, যারা আনন্দ অন্যের সাথে ভাগ করে নিতে পারে।

শেষ করছি এই কটি কথা বলে
“এই মনটা সারা জীবন ধরে রাখিস মা”

12 January, 2019

"ধর্মঘট নাকি নয় প্রতিবাদের এক ভাষা"

"ধর্মঘট নাকি নয় প্রতিবাদের এক ভাষা"
ও শহুরে বাবু
ধর্মঘট কেন হয়
তা বোঝে গ্রামের চাষা!
খনির তলে - মেশিন কলে
যাদের ঘাম আর জলে
তোমার ফুর্তি চলে -
ধর্মঘট যে তারাই করে
নিজেরা বাঁচবে বলে।

তোমরা শুধু চাও ওরা হাত পেতে থাকুক
ভিক্ষা করুক
তোমরা ডোল ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেবে
যেমন দিচ্ছ সিঙ্গুরে আর নন্দী গ্রামে
যেমন দিচ্ছ শবর পাড়ায়
ওরা সে ডোল চায় না,
ওরা কাজ চায় -
ওরা চায় ওঁদের ঘাম ঝরানো শ্রমের মজুরি
তাই তোমাদের ভিক্ষায় লাথি মেরে
ওদের খোলা হাত গুলো বন্ধ হয়
যাকে বলে মুঠো
ওদের সেই মুঠো করা হাতে জ্বলে
প্রতিবাদের মশাল
ওরা পথে নামে - ওরা প্রতিবাদ করে
ওরা অচল করে দেয়
তোমাদের শাসন যন্ত্রকে।
তখন আগুন জ্বলে,
তখন ধর্মঘট হয়,
তখন তোমাদের বুক কাঁপে,
তখন তোমরা ধর্মঘট কে উপহাস কর!
আসলে প্রকাশ কর নিজেদের নপুংসক চরিত্র
কারণ তোমরা জানো
প্রতিটি ধর্মঘট হল মানুষের
বাঁচার অধিকার রক্ষার লড়াই।
ইতিহাস সাক্ষী
ধর্মঘটের জয় ধ্বজার নিচে স্থান
কাপুরুষ পরাজিতের।। শ্রীতোষ ০৮/০১/২০১৯

একটি রাজনৈতিক লেখা

তিনি এবার "পুজো বন্ধ" এর সেন্টু দিয়ে বাজার গরম করতে চাইছেন এবং দাদার পালে হাওয়া দিতে চাইছেন।
"তুমি মোদী বাবু টাকা দাও? পুজো বন্ধ করে দেবে?" কে বললেন? বললেন মুখ্যমন্ত্রী। একটি দেশের এক অঙ্গ রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান সেই দেশের প্রশাসনিক প্রধানকে এই ভাবে সম্বোধন করতে পারেন কিনা সেই প্রশ্নে আমি যাচ্ছি না কারণ সর্ব কর্মে পারদর্শী একটি জীব এই পৃথিবীতে একটাই আছে, সুতরাং তার মুখের ভাষা যে তারই মত সুন্দর হবে তা নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এই মন্তব্যটা তিনি কেন করলেন> তিনি কেন ক্রুদ্ধ হয়ে ঘেউ ঘেউ করলেন (নিজেই অন্যের কথা শুনলে বলেন "ঘেউ ঘেউ করবেন না" অর্থাৎ মানুষের কথাকে তার ঘেউ ঘেউ মনে হয় এবং তিনি কবিতায় লেখেন "মা কোথায় - ঘেউ ঘেউ")। তিনি ঘেউ ঘেউ করলেন কারণ আয়কর দপ্তর কলকাতার পুজো কমিটি গুলোর কাছ থেকে জানতে চেয়েছে যে তারা পুজোর জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে টাকা খরচা করে সেই সব ক্ষেত্রে "উৎস মূলে কর সংগ্রহ" (TAX DEDUCTED AT SOURCE) করে কিনা? আরও সোজা কথায় বলতে গেলে, কোন একজন শিল্পীর সাথে বা অন্য কোন কাজের ক্ষেত্রে যে টাকা দেওয়া হয় সেই টাকা দেওয়ার আগে তার থেকে করের টাকা কেটে রাখা হয় কিনা এবং তা নির্ধারিত চালানে জমা করা হয় কিনা? ‘‘যে পুজোগুলো বড় বাজেটের, যাঁরা থিম পুজো করে থাকেন, তাঁদের ক্ষেত্রে টিডিএস কেটে শিল্পীদের পারিশ্রমিক দিতে কোনও অসুবিধা তো হওয়ার কথা নয়।”
এই তথ্য দিতে পুজো কমিটি গুলোর আপত্তি কোথায় তা তো বোঝা গেল না? তাহলে কি তারা TDS না কেটে কর ফাঁকি দিতে সাহায্য করছে? তাহলে কি পুজোর মাধ্যমে "কালো টাকা" সাদা করা হচ্ছে? তা না হলে পুজো কমিটিগুলোর আপত্তি কোথায়? তা না এটা বলা হচ্ছে কেন এটা হল পুজো বন্ধ করার চক্রান্ত?
মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী বলতে পারেন কি কটা বিগ বাজেটের পুজো মানুষের ঘরে গিয়ে চাঁদার রসিদ কেটে টাকা তোলে? যারা তোলে তাদের মোট খরচার মধ্যে ওই চাঁদা বাবদ আয় কত শতাংশ? আপনি বলছেন "জনগণের দেওয়া চাঁদায় পুজো হয়, কেউ লাভ করার জন্য পুজো করেন না, তা হলে কিসের আয়কর?" আপনি একটা রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান, সামান্যতম জ্ঞান তো মানুষ আপনার কাছ থেকে আশা করে, আর যদি নাই জেনে থাকেন তাহলে যারা জানে তাদের সাথে কথা বলে কমেন্ট করুন, তাহলে তো লোকে আর হাসে না। পুজো কমিটি গুলোকে আয়কর দেওয়ার কথা আয়কর দপ্তর বলছে না, বলছে তারা যাদের টাকা দেয় তাদের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে আয়কর কেটে তা জমা করার কথা। যেমন আমাদের মানে সরকারী কর্মচারী দের ক্ষেত্রে কেন্দ্র / রাজ্য সরকার প্রতি মাসের মাইনের থেকে "উৎস মূলে কর" (TAX DEDUCTED AT SOURCE) কাটে এবং তা আয়কর দপ্তর কে জমা করে, আমরা নিজেরা কোন চালান জমা করে আয়কর দপ্তরকে দিই না। এই সামান্য সাধারণ জ্ঞান একটা রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের থাকবে না, তা ভাবতেই একজন শিক্ষিত মানুষ হিসাবে আমার লজ্জা হয়। আপনি অতি মানুষ তাই আপনার লজ্জা - ঘৃণা কিছুই অবশিষ্ট নেই।
এবার আসি "টাকা দেওয়া"র প্রসঙ্গে - রাজ্য সরকার ক্লাব গুলোকে যে টাকা বিলোয় তাকি আপনার নিজের টাকা? কোন জমিদারী থেকে সেই টাকা আসে? আপনি জানেন না হয়ত, তবে জেনে রাখুন, যারা আপনার অনুপ্রেরণা ছাড়া কোন কিছুই করে না তাদের মাইনেটা পর্যন্ত সাধারণ মানুষের দেওয়া করের টাকা থেকে হয়, আপনার পৈতৃক জমিদারীর টাকা থেকে নয়। গত ২০১১ সাল থেকে ক্লাব গুলোকে ডোল দিচ্ছেন, কটা জাতীয় চ্যাম্পিয়ন তৈরি হয়েছে সেই ক্লাব গুলো থেকে? জুনিয়র মিট গুলোতে বাংলার ঘরে যত পদক এসেছে তার মধ্যে এই ডোল পাওয়া ক্লাব গুলো থেকে কটা এসেছে? এই ডোলের টাকা কাদের টাকা? চুল্লু খেয়ে মরলে কোন টাকা থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়? আপনার জমিদারীর টাকা? আপনি জেনে রাখুন সরকারের প্রতিটি টাকা হল সাধারণ মানুষের টাকা। সেই সাধারণ মানুষ যারা দয়া করে আপনাকে ভোট দিয়েছে বলে আপনি এখন এত বড় বড় কথা বলার দুঃসাহস দেখান। মনে রাখবেন আপনারা PUBLIC SERVANT বাংলা ভাষায় যাকে বলে জনগণের চাকর।
আসলে আপনি ভয় পেয়েছেন। "সততার প্রতীক" ফ্লেক্স টা কেন আর পথে ঘাটে দেখা যায় না তার কারণ সকলেই জানে। কোন কিছু খরচার হিসাব চাইলেই যে আপনার মাথা গরম হয়ে যায় তাও বাংলার জনগণ এখন বুঝে গেছে। সেই ভয় থেকেই আপনি পুজো বন্ধের সেন্টু দিয়ে বাজার গরম করতে চাইছেন।
চালিয়ে যান যতদিন পারেন।

ক্রিস্টা - ক্রিস্টা ডেভিস। AN ETERNAL MOTHER > MOTHER MARY

"মানব জনম দিয়ে বিধি
পাঠিও আবার পৃথিবীতে
যত মানুষ দেখলাম আমি
মাপার মত নেই যে ফিতে"
একটু পরিবর্তন করে গানটির প্রথম স্তবক লিখতে বাধ্য হলাম।
স্তম্ভিত!
এই অন্ধকার সময়েও এতখানি আলো!
মানুষ হিসাবে জন্ম নেওয়া সার্থক বলে মনে হয়।
এক গর্ভবতী মা জানতেন,তাঁর গর্ভস্থ শিশু জন্মানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে যাবে এক অন্য জগতে যেখান থেকে কেউ কোনদিন ফিরে আসে না। তবু তিনি জন্ম দিলেন। কেন বলুন তো? তাঁর সন্তানের অঙ্গে হয়তো বাঁচবে অন্য কোন মায়ের সন্তান। ভাবা যায়!
যে পৃথিবীতে মানুষ একটা বোমার ঘায়ে চোখের পলকে মেরে ফেলে লক্ষ মানুষকে, যে পৃথিবীতে গরুর নামে - রামের নামে - আল্লার নামে মানুষ পিটিয়ে মানুষকে খুন করে - সেই পৃথিবীই জন্ম দেয় এমন মায়ের
সেই মায়ের নাম পরে বলছি
১৮ সপ্তাহের মাথাতেই সেই মা জানতে পেরেছিলেন, যাঁর অপেক্ষায় তিনি দিন গুণছেন, সে বাঁচবে না। মাতৃগর্ভেই তাঁর মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি। যদি তার জন্ম হয়ও, তবে তার আয়ু হবে বড়জোর কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকটা দিন। তার পরেও শিশুকন্যার জন্ম দেন তিনি। একটাই কারণে। যাতে ওই মৃত শিশুর হৃদপিন্ড, ফুসফুস অন্য কোনও শিশুর কাজে লাগে।
মার্কিন মুলুকে টেক্সাসের ক্লিভল্যান্ডে মা ওই শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন বড়দিনে। ডাক্তাররা যা বলেছিলেন, তাই হয়েছিল। মাথার একটা অংশ না নিয়েই জন্ম হয়েছিল শিশুটির। চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিভাষায় যাকে বলে, ‘অ্যানেনসেফালি’। মা শিশুটির নাম রেখেছিলেন রিলেই আর্কাডিয়া। নিউ ইয়ার্স ইভে যখন গোটা বিশ্ব আনন্দে মাতোয়ারা, তখন তিনি আর তাঁর বয়ফ্রেন্ড ডেরেক লভেটকে কাঁদিয়ে মৃত্যু হয় রিলেইয়ের। মৃত্যুর ঘণ্টাখানেক আগেই ক্লিভল্যান্ডে তাঁর বাড়িতে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন ডাক্তার, নার্সরা। রিলেইয়ের হৃদপিন্ডের উপর নজর রাখতে। রিলেইয়ের মৃত্যুর পর তার হৃদপিন্ড, ফুসফুস অন্য শিশুকে দেওয়া যাবে কি না, তা বুঝে নিতে।
রিলেই ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর এক সপ্তাহ বাঁচল ঠিকই, কিন্তু অন্য শিশুদের কাজে লাগার জন্য দিয়ে গেল তার ছোট্ট হৃদপিন্ড, ফুসফুসকে। মৃত্যুর পর রিলেইয়ের হৃদপিন্ড দেওয়া হল একটি মুমূর্ষ শিশুকে। আর তার ফুসফুস গেল একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। গবেষণার জন্য যাঁরা হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন শিশুদের ফুসফুস।
একটি বেসরকারি সংস্থার সহকারী ম্যানেজার কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘‘ও যে থাকবে না, তা তো অনেক আগেই জানি আমি আর ডেরেক। আমি যখন ১৮ সপ্তাহের গর্ভবতী, তখনই ডাক্তাররা আমাকে সেটা বলেছিলেন। গর্ভপাতও করাতে চেয়েছিলেন। আমিই রাজি হইনি। ওকে আমি জন্মাতে দিয়েছিলাম ওর অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ দান করব বলে।’’
তিনি জানিয়েছেন, তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর গর্ভে শিশুটির প্রথম নড়াচড়া টের পেয়ে। খুশিও হয়েছিলেন। ‘‘গর্ভে থাকার সময় কোনও সমস্যাতেই ফেলেনি ও। শুধু জন্মের সময় মাথাটা উল্টো দিকে থাকায় প্রসবে কিছুটা অসুবিধা হয়েছিল’’, বলেছেন তিনি।
জন্মের পর যে সাতটা দিন শ্বাস নিয়েছিল রিলেই, তার প্রায় প্রতিটি মুহূর্তই ধরে রেখেছেন তিনি। ভিডিয়ো ক্যামেরায়। ‘‘সেই সব ছবিই সারাটা জীবন ধরে দেখে রিলেইকে মনে রাখব, মনে করব’’, বলেছেন
ক্রিস্টা - ক্রিস্টা ডেভিস।
AN ETERNAL MOTHER > MOTHER MARY
ছবিতে রিলেই আর্কাডিয়া
সংবাদ ও চিত্র সৌজন্যঃ আনন্দ বাজার ই পত্রিকা
সংবাদ সংস্থা
টেক্সাস|
১২ জানুয়ারি, ২০১৯, ১৮:১৩:৫৪
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি, ২০১৯, ১৮:১২:০৮

শিশির কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় · ৹৹৹৹৹ মুক্তির স্বপ্নের দেশভেদ নেই ৹৹৹৹

এই প্রথম অন্য কারো লেখা আমার ব্লগে কপি - পেস্ট করলাম
 
3 hrs
 
৹৹৹৹৹ মুক্তির স্বপ্নের দেশভেদ নেই ৹৹৹৹

আমার প্রোফাইলে রাইফেল হাতে যে তরুণীর ছবি আছে তার নাম তিতিকা। তিন মাস আগে ৯০ বছর বয়েসে তিনি মারা গেলেন। গ্রীসের ফ্যাসিবাদবিরোধী রেসিস্ট্যান্সে তিনি ১৭ বছর বয়েসে যোগ দেন। গোপন আণ্ডারগ্রাউণ্ডে বসে কবিতায় লেখেন –

‘time has come for women,
to plunge into battle,
to fight bravely,
to think of nothing else,
not mother or house,
not husband or children,
the cause is but one,
liberty or death’

মানুষের মুক্তির স্বপ্ন যারা দেখেন তাদের সবাইকেই বোধহয় নিজের সুখভোগ ছাড়তে হয়। বিবেকানন্দর লেখা পড়লে দেখা যায় উনি যতটা ধর্ম নিয়ে চিন্তিত, তার থেকে এক শো গুণ বেশী চিন্তিত পরাধীন দেশবাসীর কষ্ট নিয়ে, কিভাবে উৎপীড়িত নিম্নবর্গকে মুক্তির দিশা দেখানো যায়, এই চিন্তা তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে।

বিবেকানন্দের জন্ম ১২ই জানুয়ারী, ১৮৬৩ সালে। মৃত্যু ১৯০২ সালে। তাঁর মৃত্যুর ৩২ বছর পর ১৯৩৪এ এই দিনেই ফাঁসি হয় মাস্টারদা সূর্য সেনের, তিনিও মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখে আত্মসুখ বিসর্জন দিয়েছিলেন। বিবেকানন্দ ও মাস্টারদার কাহিনী অল্প বিস্তর সবারই জানা। কিন্তু বিবেকানন্দর মৃত্যুর বছরেই রাশিয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যেটা অনেকের জানা নেই। সেই ঘটনাটির কথা লিখলে বোঝা যাবে মানুষের মুক্তির স্বপ্ন কোন বিশেষ দেশে বিশেষ সময়ে বাঁধা থাকে না, এ স্বপ্ন সীমানা পেরিয়ে কালোত্তীর্ণ আন্তর্জাতিক, বিবেকানন্দ থেকে মাস্টারদা – তিতিকা – সূর্যসেন একই সূতোয় বাঁধা, সেখানেই বাঁধা ১৯০২এর রাশিয়ার ঘটনা।

আজকের সকালের পোস্টেই বলেছি আমার জীবনে বিবেকানন্দের অবদান সবকিছুকে পরীক্ষা করে নেয়া, অন্ধ বিশ্বাসে নেতার কথায় ‘লাল সেলাম’, ‘বন্দে মাতরম্’ অথবা ‘ভারতমাতা কী জয়’ কোনটাই না বলা। বিবেক নিজেও গুরুবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না, রামকৃষ্ণকেও পরীক্ষা করে তারপর শিষ্যত্ব নিয়েছিলেন। বিবেককে হিন্দুধর্মের প্রবক্তা অথবা কম্যুনিস্ট করে দেওয়ার অনেক অপচেষ্টা হয়, তিনি কোনটাই ছিলেন না। তিনি ছিলেন মানবদরদী এক বৈদিক সাম্যবাদী। বেদের সেই পর্যায়ে বর্ণভেদ, জাতিভেদ ছিল না। মহিলাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল, স্বামী যাজ্ঞ্যবল্কের সাথে মৈত্রেয়ীর দীর্ঘ তর্কযুদ্ধই সেটা প্রমাণ করে। একবার মধ্যপ্রদেশের একদল গো-রক্ষক স্বামীজির কাছে আসেন তাঁকে নিমন্ত্রণ করতে। তিনি তাদের প্রশ্ন করেন মধ্য প্রদেশে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছে সেটার ব্যাপারে ওরা কি করছেন। উত্তরে তারা বলেন ওরা শুধু গোমাতার রক্ষা নিয়ে কাজ করেন। স্বামীজি বলেন, ‘সে তো বুঝতেই পারছি, নয়ত এমন সন্তান কোথা থেকে হবে বলুন ?’

বিবেকানন্দ মার্ক্সের থেকে বয়েসে ৪৫ বছরের ছোট। তাঁর জন্মের আগেই প্যারী কম্যুউনের ঐতিহাসিক বিদ্রোহ হয়ে গিয়েছে, কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টোও প্রকাশিত। তাঁর মত মননশীল ব্যক্তিত্ব এইসব ঘটনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না এটা ভাবাই যায় না। কিন্তু তাঁর লেখায় তিনি মার্ক্সবাদে আকর্ষিত হয়েছিলেন এরকম কোন ইঙ্গিত নেই। মার্ক্স বলেছিলেন শিল্পোন্নত ইংলণ্ডে প্রথম বিপ্লব হবে, স্বামীজি বলেন রাশিয়াতে, এবং তাঁর কথাই সত্যি হয়। সুতরাং তিনি যে রাশিয়ার মানুষকে নিয়েও চিন্তা করতেন এটা বোঝা যায়। অর্থাৎ মার্ক্সীয় দর্শনের প্রভাবে না এসেও তিনি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন, কোন বাধা হয় নি।

মাস্টারদা সূর্য সেনও সেই অর্থে মার্ক্সবাদী ছিলেন না, কিন্তু পরাধীন দেশবাসীর মুক্তির স্বপ্ন দেখেন। অমানুষিক অত্যাচারে তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়বার পর তার সংজ্ঞাহীন দেহকেই ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হয়, প্রাণহীন দেহ ছুঁড়ে ফেলা হয় সমুদ্রে।

বিবেকানন্দের মৃত্যুবর্ষে, ১৯০২ সালের ৭ই মার্চ রাশিয়ার ককেশাস অঞ্চলের বাটুম শহরে তিন শো শ্রমিক ধর্মঘট করবার অপরাধে গ্রেপ্তার হলে ৯ই মার্চ এক বিপ্লবীর নেতৃত্বে লাল পতাকা হাতে শ্রমিক মিছিল জেলখানার দিকে এগিয়ে যায় কমরেডদের মুক্তির জন্য। পুলিশের গুলীতে মৃত্যু হয় ১৫ জনের।

১২ই মার্চ ওই শহীদদের সমাধিস্থ করা হয় বৈপ্লবিক মর্যাদায় এবং ওই নেতার লেখা ইস্তাহারে লেখা ছিল –

যারা সত্যের জন্য প্রাণ দিয়েছো তাদের শ্রদ্ধা জানাই,
যে মায়ের স্তন্যে তোমরা পালিত, সেই মায়েদের প্রণাম জানাই।
শহিদের কাঁটার মুকুট যে পড়েছে,
যারা মরণের মুহূর্তেও জীবনের বাণী দিয়ে গিয়েছে,
তাদর স্মৃতি আছে আমাদের সঙ্গে।
তারা আমাদের কানে কানে বলছে –
‘আমাদের উপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নাও’।

আকৈশোর মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখা সেই রাশিয়ান বিপ্লবী ১৭ বছর বয়সে ‘সোসেলো’ ছদ্মনামে ‘আইবেরিয়া’ পত্রিকায় একটি কবিতা লেখেন –

শ্রমভারে যার মেরুদণ্ড ভেঙে ভেঙে গেছে,
কাল অবধি যে আতঙ্ক ভরে হাঁটু গেড়েছিলো,
সে আবার উঠবে পর্বতের উঁচুতে,
আশার ডানা মেলে সে উঠবে সবার উপরে।

এই রাশিয়ান যুবকটি ১৯০৫ সালের ৫ই জানুয়ারী কঠিন ঠাণ্ডার মধ্যে সাইবেরিয়ার নির্বাসন থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। এর জন্ম ১৮৬৮ সালের ১৮ই ডিসেম্বর রাশিয়ার তিফলীস প্রদেশের গোরী শহরে এক দরিদ্র চর্মকারের ঘরে। পুরো নাম জোশেফ ভিসারিনোভিচ জুগাশভিলি, যিনি তাঁর ছদ্মনাম স্তালিন নামেই পরিচিত, রাশিয়ান ভাষায় স্তালিন মানে ইস্পাত।

রাশিয়ান বিপ্লবীর গল্পটি আমি শুনি আমার পিতামহের মুখে। তিনি তেভাগায় লড়েছেন, পরে আজীবন কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। বাল্যকালে খুব ভোরে তিনি আমায় নিয়ে যেতেন তিস্তাপারে, পূবদিকে মুখ করে বলাতেন, - ‘আত্মনাম্ ঋদ্ধি, জগৎ হিতায় চ’, শুধু নিজের বৃদ্ধি ঘটালেই হবে না, জগতের অন্যদের কথাও ভাবতে হবে। যেদিন সঙ্গে মা থাকতেন, গাইতেন –

জলে স্থলে তব আছে আহ্বান, আহ্বান লোকালয়ে,
চিরদিন তুই গাহিবি যে গান, সুখে দুখে লাজে ভয়ে,
ফুল পল্লব নদী নির্ঝর, সুরে সুরে তোর মিলাইবে স্বর,
দিক দিকে তোর স্পন্দিত হবে আলোক অন্ধকার,
নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার….

তখন বুঝিনি, এখন শেষবেলায় বুঝি, মানুষের মুক্তির স্বপ্ন তিস্তাপারে রবীন্দ্রনাথের সুরে মিলিয়ে দিত তিতিকার গ্রীস, বিবেক আর মাস্টারদার ভারতবর্ষ এবং স্তালিনের রাশিয়াকে। মুক্তির স্বপ্নের কোন ভৌগোলিক সীমা হয় না, সময়ের বাঁধনে সে বাঁধা পড়ে না। ১২ই জানুয়ারীতে আমার এসব কথাই মনে পড়ে বন্ধুরা।

08 January, 2019

বিপ্লব না এলে।


"বিশ্বাস বুকের ভিতর না থাকলে
স্বপ্ন দেখা যায় না
স্বপ্ন না দেখলে
লড়াই করা যায় না
লড়াই না করলে
বিপ্লব আসে না
বিপ্লব না এলে
সমাজ সুন্দর হয় না।
তাই বিপ্লবীরা স্বপ্ন দেখে।"