18 October, 2016

পুরানো সেই দিনের কথা

পুজো মানে আমাদের মত চুলে পাক ধরাদের কাছে পুরানো দিনে ফিরে যাওয়া। তখন মহালয়া চারদিন ধরে (এখন অবশ্য ১৪ দিন ধরে) যখন খুশী বাজত না। টেবিল ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে শুতে যাওয়া এবং অবধারিত ভাবে সারা রাত আধো ঘুমে থাকা। তখন কলকাতা "খ" এ মহালয়া একটু পরে শুরু হত। "ক" এর মহালয়া শেষ হওয়ার পর ফুল তুলতে বেরিয়ে পড়া। অনেক বাড়িতে তখনও মহালয়া চলছে। সদ্য ফোটা শিউলি ফুল যখন মাথায় ঝরে পড়ত, কি যে ভালো লাগত তা আমাদের বয়সীরাই একমাত্র বুঝতে পারবে। ফুল তোলার সময় একটা ফুল পায়ের তলায় পড়লে মন খারাপ হয়ে যেত।
তখনকার গড়িয়া আর আজকের গড়িয়ার মধ্যে আকাশপাতাল ফারাক। গড়িয়াতে তখনও গরুর গাড়ী চলে। সময়ের পাল্টে যাওয়া তখনও গতি নিতে পারেনি আজকের মত। সেই সে দিনে মহালয়ার পরেই আমাদের একমাত্র কাজ ছিল বরদা প্রসাদ স্কুল প্রাঙ্গণে চলে যাওয়া কারণ সেই রাতেই নব দুর্গা মণ্ডপে চলে এসেছে। ওই সকাল টুকু সময় - তারপর মুখ আবার ঢাকা পড়ে যাবে, সামনে কাপড় টানিয়ে চলবে সেই মুহূর্তের কাজ। ওই সময় আমাদের মধ্যে ভীষণ তর্ক হত - গতবারের চেয়ে এবারের দুর্গা কি কি কারণে ভাল / খারাপ, কোন দুর্গার (নটি রূপের মধ্যে) মুখ কত সুন্দর, এই সব নিয়ে। এছাড়া লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ - বাদ যেত না কেউ।
পুজোর চারটে দিন মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়ানো (সকাল থেকে দুপুর), ক্যাপ ফাটানো, ক্যাপ ফাটিয়ে যুদ্ধ - কত মজা। বিকেলে ঠাকুর দেখতে বার হওয়া। এত পুজো ছিল না - ছিল না এত জৌলুস কিন্ত আনন্দ ছিল। বিজয়া দশমীর দিন পাড়ার ঠাকুর বরণ হয়ে যাওয়ার পরে চলে যাওয়া রাসবিহারী অ্যাভিনিউ তে। মাঝখান দিয়ে উঁচু ট্রাম লাইন আর তার উপরে হাজার হাজার মানুষ। বুড়ো থেকে বাচ্চা - বাদ নেই কেউ ই। আমরা থাকতাম ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের সামনে দিয়ে কারণ পণ্ডিতিয়া রোডে ছিল আমাদের পৈতৃক বাড়ী। মনে পড়ে বালিগঞ্জ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের শোভাযাত্রার কথা। বাচ্চা থেকে বয়স্ক (যারা হাঁটতে পারে) ছেলেদের পোশাক ধুতি ও পাঞ্জাবী, আর মেয়েদের লাল পাড় শাড়ি। ছেলেদের একটা দল - মেয়েদের আর একটি। দল সাজান হত বাচ্চা থেকে বড় - এই ভাবে লাইন করে। সঙ্গে ব্যান্ড থাকত। আর থাকত দুটি বড় ট্রাক যাতে যারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তারা উঠে পড়ত আবার যারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছে তারা ভরাট করে দিত সেই জায়গা। কি অসাধারণ যে লাগত যারা না দেখেছে তারা বুঝতে পারবে না। প্রতিটি ক্লাবের নিজস্ব একটি রীতি ছিল - সেই রীতি মেনে বিসর্জনের শোভাযাত্রা বার হত।
এত পুরস্কার ছিল না। ছিল শুধু এশিয়ান পেন্টস শারদ সম্মান। আজকে তো মদ কোম্পানিও শারদ সম্মান দেয়। এবার তো দেখলাম এ বি পি আনন্দ পুরস্কারের হরির লুট লাগিয়ে দিয়েছে। পুজোর আবার থিম সং। তাহলে মহালয়া জিনিস টা কি - ওটা বন্ধ করে দিলেই তো হয়। বেস্ট থিম সং এর জন্য আবার পুরস্কার। হয়তো কোনদিন দেখব অমুক মণ্ডপে বেস্ট ফুচকা বিক্রি হয়েছে তার জন্য "বেস্ট ফুচকা মণ্ডপ" পুরস্কার। সেই সময়ে দুর্গা বিসর্জন হত হাজার মানুষের প্রণাম নিয়ে - মানুষের চোখের জলে, যখন মানুষ বাড়ী ফিরত তখন প্রত্যেকের মন বিষণ্ণ।
আজকে কলকাতায় যা চলছে - আগামীর কলকাতায় যা চলবে তাতে আর যাই হোক বিষণ্ণতা থাকে না। পুজো হয়েছে আজ পণ্য - পুঁজ বার হচ্ছে তা থেকে। বারোইয়ারি পুজোর সংজ্ঞা ধরে রাখতে পেরেছে (কিছুটা) বিভিন্ন পাড়ায় হওয়া ছোট পুজো এবং আবাসনের পুজো। তাই পুজো আজ আর কোন আলাদা অর্থ বহন করে আসে না - পুজো আজ এক বিরক্তিকর অভ্যাস, তাই পালিয়ে যাই কলকাতা থেকে। আগে মনে হত পুজোয় কলকাতায় থাকব না - তাকি হয়, আর আজ মনে হয় পুজোয় কলকাতায় থাকব কি করে হয় ?

No comments:

Post a Comment