অ্যাবারডীন! ভারতের
মূল ভূখণ্ড থেকে বহু শত মাইল দূরে থাকা এক বিস্মৃত ইতিহাসের নাম অ্যাবারডীন!
অ্যাবারডীনের লড়াই!
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে কিন্ত এ লড়াই তার প্রাপ্য
মর্যাদা পায় নি যদিও ইতিহাসের নিরিখে এ লড়াই সাঁওতাল বিদ্রোহের থেকে কিছু মাত্র কম
যোগ্য নয়। ফেসবুকের নব্য দেশপ্রেমী (শখের দেশপ্রেমী)রা এ লড়াই সম্পর্কে কতটুকু জানে
আমি সেটা জানি না (বুঝি জানে না, তা না হলে তাদের দেশপ্রেমিক পোষ্টে এ লড়াইয়ের উল্লেখ
থাকত)।
এ কি বীরত্বের ইতিহাস
নাকি বিশ্বাসঘাতকতার – প্রশ্ন জাগে তা নিয়েও।
চলুন পাঠক আমরা ফিরে যাই ১৮৫৯ সালের আন্দামানে। ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম, সিপাহী বিদ্রোহ বলে
যার পরিচয় ইতিহাসের পাতায়, তার রক্ত স্নান সবে হয়েছে শেষ। প্রচুর দেশী সিপাহী বন্দী
ব্রিটিশ হেফাজতে। দেশের মূল ভূখণ্ডে এঁদের আটকে রাখা বিপদ জনক তাই পাঠিয়ে দাও সাগর
পাড়ের ওই দ্বীপে। যাওয়ার পথে মরবে কিছু, কিছু মরবে ওখানকার রোগে আর বন্য জন্তু যথা সাপ ইত্যাদির আক্রমণে, কিছু মরবে আদিবাসী দের
হাতে, আমাদের লাভ এদের দিয়েই জঙ্গল হাসিল করে বানিয়ে নেওয়া যাবে থাকার আর আমোদ
ফুর্তির জায়গা। মাইনে দেওয়ার কোন ঝামেলা, শুধু খাওয়া আর পোশাকের খরচা। তা এই সব
নেটিভ গুলোর জন্য ও সবের পিছনে বেশী খরচা করতে হবে না। চারিদিকে সমুদ্র – পালানোর
ও জায়গা নেই। অতএব ঝাঁকে ঝাঁকে বন্দী জাহাজের খোলে ভর্তি হয়ে খালাস হল পোর্ট
ব্লেয়ারে। উল্টো দিকে রস আইল্যান্ড – ব্রিটিশ অফিসার, সৈন্য এবং কিছু নেটিভ বন্দী
থাকে সেখানে। পোর্ট ব্লেয়ার এবং রসের নেটিভ বন্দীদের কাজ জঙ্গল কাটা, বাড়ি ঘরদোর
বানানো, সাহেব প্রভুদের খিদমত খাটা। বেশীর ভাগের পায়ে লোহার শিকল। জঙ্গল কাটা বা
সেখান থেকে কাঠ আনতে গেলে মাঝে ওখানকার আদিবাসীদের হাতে আক্রান্ত হতে হয় কিন্ত সব
সময় নয়।
ওখানে যে আদিবাসীদের বাস তারা ১০ টি গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। প্রতি গোষ্ঠীর
নিজস্ব ভাষা ও নিজস্ব রীতি নীতি ছিল তবে প্রতিটিই ছিল একে অন্যের সাথে সম্পর্ক
যুক্ত। এঁরা হলেন “কারি”, “কোরা”, “বো”, “জেরু”, “কেদে”, “কোল”, “জুওই”,
“পুচিকোয়ার”, “বালে” এবং “বিএ” – এঁদের একসঙ্গে বলা হয় ‘গ্রেট আন্দামানীজ’
(প্রসঙ্গত শেষ ৬ টি গোষ্ঠী ১৯২১ থেকে ১৯৩১ এর মধ্যে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে
গেছে – কৃতিত্ব সভ্য মানুষের)। এই গ্রেট আন্দামানিজ দের সাথে মেইনল্যান্ডার বা
ব্রিটিশ এবং নেটিভ বন্দীদের প্রতি বিরোধের একমাত্র কারণ ওদের আগ্রাসনের সামনে পড়ে
তাঁদের নিজেদের জঙ্গল হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল – ধ্বংস হচ্ছিল জঙ্গল। তবে ওঁরা কিন্তু
যাঁদের পায়ে শিকল বা বেড়ি থাকত তাঁদের কক্ষনো আক্রমণ করতেন না। এই ছিল পটভূমি।
যাঁদের রক্তে জ্বলেছিল বিদ্রোহের আগুন, তাঁরা চুপ করে থাকার পাত্র নন।
মানুষ মাত্রেই স্বাধীনতা চায়। অতএব পালাতে হবে। প্রায় ১৩০ জন (৯০ জন রস এবং বাকি
৪০ জন চ্যাথাম আইল্যান্ড ও ফিনিক্স বে) বন্দী একদিন পালালেন ব্রিটিশ অত্যাচারীদের
খপ্পর থেকে, যাঁদের মধ্যে ছিলেন কয়েদী নাম্বার ২৭৬ – দুধনাথ তেওয়ারী। পলাতক রা
ভেবেছিলেন জঙ্গল পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যাবেন বার্মা মুল্লুকে। তাঁরা জানতেন না, বার্মার
সাথে কোন সড়ক যোগাযোগ নেই। পালাতে তাঁরা ব্যর্থ হলেন এবং গ্রেট আন্দমানিজ দের হাতে
নিহত হলেন সব্বাই একমাত্র ওই কয়েদী নাম্বার ২৭৬ – দুধনাথ তেওয়ারী বাদে। দুধ নাথের
শরীরে তিন খানি বিষাক্ত তীর বিঁধেছিল এবং তিনি মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু কোন
এক অজ্ঞাত কারণে আদিবাসীরা তাকে সেবা যত্ন করে বাঁচিয়ে তোলে। ধীরে ধীরে দুধনাথ
ওদের একজন হয়ে উঠতে থাকেন। প্রথমে আদিবাসীরা তাকে বিশ্বাস করতেন না কিন্তু সময়ের
সাথে সাথে দুধনাথ ওঁদের আস্থা ভাজন হয়ে ওঠেন। এক সময় তিনি দুটি (মতান্তরে ১ টি)
আদিবাসী মেয়েকে বিয়ে করেন এবং তাঁদের সন্তানও হয়। তিনি সাকুল্যে ১ বছর ২৪ দিন
আদিবাসীদের সঙ্গে ছিলেন।
ব্রিটিশ আগ্রাসনে ক্রমশ শঙ্কিত হয়ে ওঠা আদিবাসীরা এক সময় বেছে নিল প্রতি আক্রমণের
পথ। ১৮৫৯ সালের ৬ ই এপ্রিল প্রায় ২০০ আদিবাসী আক্রমণ করল ২৪৮ জন বন্দীকে যারা হ্যাডো
এলাকায় জঙ্গল কাটার কাজ করছিলেন। পরের আক্রমণ হল এপ্রিলের ১৪ তারিখে। এবার প্রায় ১৫০০
আদিবাসী অংশ নিল আক্রমণে। এল মে মাসের ১৭ তারিখ। আদিবাসীরা ঠিক করলেন রাতের অন্ধকারের
সুযোগ নিয়ে আক্রমণ চালানো হবে এবং আন্দামান থেকে ওই সাদা চামড়ার লোক গুলোকে নিকেশ করা
হবে। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি চলল। প্রতি যোদ্ধার মুখ শপথে কঠিন, আমাদের জঙ্গল আমাদের
নিজেদের। আমাদের মাতৃভূমি আমাদের নিজেদের, বিদেশী সাদা চামড়া গুলো এমনিতে যাবে না,
এদের মেরে তাড়াতে হবে। ওঁরা জানতেন না, ওঁরা দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পুষেছেন, যে কাল
সাপের নাম দুধনাথ তেওয়ারী – কয়েদী নাম্বার ২৭৬।
আক্রমণ কারি দের সাথেই এলেন দুধনাথ। তাঁরা যখন সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছেন সেই
ফাঁকে দুধনাথ লুকিয়ে চলে গেলেন ব্রিটিশ প্রভু দের কাছে। যাঁদের কাছে মুক্তির স্বাদ
পেয়েছিলেন, সুন্দর জীবন কাটাচ্ছিলেন তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে একটুও চিন্তা
করলেন না, চলে এলেন তাদের কাছে যাঁদের কাছে পেয়েছিলেন অমর্যাদা আর অত্যাচার। আসলে
যুগে যুগে বিভীষণরা এই রকমই হয়। দুধনাথের কাছে খবর পেয়ে সতর্ক হয়ে গেল ব্রিটিশ
বাহিনী। ফলে ঘটল এক নির্মম ঘটনা। কালাপানির জল লাল হয়ে উঠল মাটির মানুষের রক্তে।
একদিকে তীর, বল্লম, ছুরি, কুড়ুল নিয়ে মুক্তি পাগল আদিম মানুষ আর তার বিপরীতে
আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী। বন্দুক – রাইফেল আর কামানের কাছে তীর আর বর্শা কি
করবে? যাকে ইংরাজিতে বলা হয় Annihilation, সেদিন ঘটল তাই। একটা গোটা জাতিই প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল পৃথিবীর বুক
থেকে।বেশীর ভাগ গ্রেট আন্দামানি পুরুষ, যাঁদের মধ্যে এক বড় অংশ ছিল তরুণ ও যুবক
হারিয়ে গেল কালাপানির জলে, তাঁদের সঠিক সংখ্যা আজ ও কেউ জানে না তবে কোন ভাবেই তা
৫ – ৭ হাজারের কম নয়। কমতে কমতে ১৯৯৪ সালে তাঁদের সংখ্যা মাত্র ৫৭! আর দুধনাথ –
তার কি হল? তিনি ক্ষমা পেয়েছিলেন, ফিরে গেছিলেন মূল ভূখণ্ডে তাঁর গ্রামে। তার পর
তার কথা আর কেউ জানে না।
কালাপানি হয়তো এখনও কাঁদে – এখনও হয় তো সে খুঁজে ফেরে তার নিজের মানুষদের,
যারা তার বুকে বেয়ে যেত নৌকা, তার সৈকতে মেতে উঠত আনন্দে। সময় বড়
বলবান, যা নিয়ে যায় তা দেয় না ফিরিয়ে। আজ যখন দেশপ্রেমে মাতোয়ারা আ সমুদ্র হিমাচল
তখন এই ভুলে যাওয়া শহীদদের স্মরণ করে দেশমাতৃকা কে জানাই আমার প্রণাম। সামান্য
মানুষ আমি, এর চেয়ে বেশী আর কি ই বা করতে পারি।
শেষ কিছু শব্দ লিখে যাই
দেশপ্রেমের আড়ালে দ্বেষ প্রেমিক রা আজও অস্ত্র নিয়ে বাঁচে
দেশপ্রেমিকদের শেষ করবে বলে
দুধনাথের মত মানুষ গুলোই
আজকের তথাকথিত দেশপ্রেমিক।
বিশ্বাসঘাতক দুধনাথ তুমি নিজেই স্বাধীনতাবিরোধী।
ReplyDeleteএকটা জাতিকে তুমি শেষ করে দিলে তোমার ফাসি দেওয়া উচিতছিল।