10 November, 2015

ভ্রমণ কাহিনী ৩য় তথা শেষ পর্ব।



ভ্রমণ কাহিনী ৩য় তথা শেষ পর্ব।
এদিন ঠিক করেছিলাম একদম নিজেদের মত করে ঘুরব। তাই সকালে চা খেয়ে তৈরি হয়ে বার হয়ে পড়লাম দুজনে। হোটেলে জিজ্ঞাসা করল লাঞ্চ নেব কিনা – আমরা বললাম জানি না – ১ ঘণ্টায় ফিরে আসতে পারি – ফিরতে পারি সন্ধ্যা পার করে। পায়ে হেঁটে মূল রাস্তায় এসে বাঁধের লক গেট বা মূল নদী পার হয়ে এলাম এক তে মাথায়। সামনে অনেকগুলো খাওয়ার দোকান। একটি দোকানে জিজ্ঞাসা করলাম “কি পাওয়া যাবে” ? বলল গরম পুরি – তরকারী। ঠিক আছে আজ না হয় সাহেব থেকে বাঙালী হই। লাগাও দাদা – দু জায়গায়। এখানকার মানুষরা মানুষের সাথে মিশতে চায়, তাই অল্প সময়েই তার জানা হয়ে গেল আমি থাকি গড়িয়ায় আর সে কাজ করে রুবিতে – বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হচ্ছে সেখানে। এই সময় দিয়ে এসেছে, জানুয়ারি পার হলে আবার চলে যাবে, না হলে খাবে কি ? সত্যিই তো এলাকায় যেখানে উন্নয়নের জোয়ার বইছে সেখানকার মানুষই তো যাবে রুবিতে জন খাটতে ! যাই হোক, খাওয়া – দাওয়া মিটল, এবার ঘুরে দেখব এলাকা। প্রথমেই বাঁধ দেখতে হবে – কংসাবতী ও কুমারি নদীর উপর নির্মিত এ বাঁধ   বিশ্বের ২য় দীর্ঘতম মাটির বাঁধ। মোট দৈর্ঘ্য ৬ কিমি ৪০০ মিটার। কংসাবতীর দিকে উচ্চতা সর্বোচ্চ ৩৮.১০ মিটার এবং কুমারী নদীর দিকে ৪১.১৫ মিটার। এই দুটি অংশ একটি টিলার মাধ্যমে যুক্ত হয়েছে। এই বাঁধের দুদিকে রয়েছে দুটি ফিডার ক্যানাল। এ তো গেল ব্যবহারিক বর্ণনা। এবার বলি, ঘুরলাম কিভাবে ? তে মা






থার মোড় থেকে একটি অটো ভাড়া করে নিলাম – আশেপাশে যা আছে ঘুরিয়ে দেখাবে। অটো নিলাম এই কারণেই যে তীব্র রোদের হাত থেকে একটু ছায়া তো দরকার ! বাঁধের উপর দিয়ে যাত্রা শুরু। আমি মাইথন, পাঞ্চেত, ফারাক্কা (ফারাক্কার সৌন্দর্য অন্যরকম), দেখেছি হুদ্রু প্রপাতের আগে তৈরি বাঁধ – মুকুটমণিপুরও  দেখলাম। আমার কাছে সবচেয়ে সেরা মুকুটমণিপুর। একদিকে বিশাল জলরাশি (তাও বৃষ্টি কম হওয়ার জন্য এবার বাঁধে জল কম) অন্যদিকে সবুজ ঢাকা পাহাড় আর চাষের জমিমাঝে দু-একবার অটো থামিয়ে ফটো তুললাম। তারপর থামলাম সেই টিলাটির নীচে যার কথা লিখেছি আগেই। টিলাটির নাম দেওয়া হয়েছে মুসাফিরানা। ওপরে সুন্দর একটি পার্ক তৈরি হচ্ছে। গাছ যতদূর সম্ভব রক্ষা করা হয়েছে – পথ সাজানো হচ্ছে সহজ পাঠের বিভিন্ন লেখা দিয়ে। এটা অনুষঙ্গ। ওখানে এ দেখতে কেউ উঠবে না – উঠবে প্রকৃতি দর্শনে। আমার ক্যামেরায় কিছু ছবি তুলেছি কিন্ত বৃথা চেষ্টা। ছবি ধরা রইল মনের ক্যামেরায় ! প্রিয় পাঠক, সত্যিই আমি এত বড় লেখক নই যে এ অপার সৌন্দর্যের বর্ণনা দেব – এ সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আপনাকে আসতেই হবে মুকুটমণিপুরে। আমি মুগ্ধ – আমি ধন্য – আমি আপ্লুত। এই জন্যই কবি বোধ হয় গেয়ে ওঠেন “সকল দেশের সেরা সে যে / আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি”। কত সময় যে ওখানে চলে গেল জানি না। নেমে এলাম, আমাদের সারথি এবার বাঁধ থেকে একটি মাটির রাস্তা ধরে নিয়ে চললেন নিচের দিকে। বেশ কিছুটা নীচে এসে থামল অটো। আরও একটু নীচে নেমে খেয়াঘাট। ওপারে গিয়ে ২ – ৩ কিমি হাঁটলে “ডিয়ার পার্ক”। পারাপার ১৫০ টাকা। সারথি বললেন, কি হবে গিয়ে ? যে কটা হরিণ ছিল সবই তো এই ক’বছরে পাচার করে দিয়েছে – এখন ২-৪ টে আছে কিনা সন্দেহ। আসলে এটা হল কংসাবতী আর কুমারী নদীর মিলনস্থল – মোহানা। এটা দেখাতেই নিয়ে আসা, আপনাদের ডানদিকে কংসাবতী আর বাঁদিকে কুমারী। আমরা চলে গেলাম একেবারে জলের ধারে – একটু বাঁদিক ঘেঁষে নদীর মাঝে একটি ছোট্ট টিলা, ওই দিকটা একদম ফাঁকা। হালকা হাওয়ার সাথে জলের কুলুকুলু ধ্বনি – আঃ! সময় চলে যায় – এক সময় মনে হয় ফিরতে হবে। এবার গন্তব্য বাঁধের একদম শেষ প্রান্ত। দেখলাম অন্যদিকের ফিডার ক্যানালটি। এর মধ্যে যথারীতি সারথির সাথে আলাপ হয়ে গেছে। ইনি ইলেকট্রিকের কাজ খুব ভালো জানেন, গত ১৫ বছর সোনারপুরের গ্রীন পার্ক এলাকায় ইলেকট্রিকের কাজ্জের সাথে যুক্ত ছিলেন। দুঃখ করে বললেন, “দাদা আগে তো ঠিক ছিল কিন্ত গত ক’বছর ধরে কারখানার অবস্থা খারাপ, লোকাল লোক নেওয়ার জন্য মালিকের উপর চাপ আর তাদের আমাদের থেকে বেশী মাইনে দিতে হবে সে তারা কাজ জানুক আর না জানুক। বললে বিশ্বাস করবেন না, গত ৩-৪ বছরে যারা কাজে ঢুকেছে তারা এখন আমাদের চেয়ে বেশী মাইনে পায় মানে তাদের বেশী মাইনে দিতে হয়। মালিকও বলেছে কারখানা গুটিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাবে। দাদা, পার্টির ব্যাপার সব সময় সব জায়গায় ছিল, কিন্ত এখন ! রাস্তায় বার হলে আমাদের আওয়াজ মারত, সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া বাঁধাত। শেষে আর না পেরে চলে এলাম। এখানে একটা ছোট ইলেকট্রিকের দোকান খুলেছি, অটো চালাই, একটু খানি জমি আছে, নিজের দেশে শান্তিতে আছি। যা রোজগার করি, আগের মত অত ভালোভাবে না হলেও চলে যাচ্ছে। দেখি তো একটা বছর” ! আমি আর কি বলব – বলার কি আছে ? আছে শোনার আর শুনে আনন্দ না দুঃখ কি হয় তাও তো ছাতা বুঝি না ! মাঝে মাঝে মনে হয়, “বেশ হয়েছে, যেমন কর্ম – তেমন ফল” বিষ বৃক্ষ পুঁতেছ বন্ধু সে গাছে অমৃত ফল ফলবে আশা কর কি করে? আবার মনে হয় এদের তো দোষ নয় এক মিথ্যা মানুষের সামনে বার বার করে বলতে থাকলে, কিছু মানুষ তো তাকে সত্য ভাবে, এরাও তাই ভেবেছে। আসল শয়তান তো তারা, যারা এই সব কথা বলে, নানা রকম পোস্ট, পুরস্কার ইত্যাদি কামিয়ে ঠাণ্ডা ঘরে বসে ল্যাজ নাড়াচ্ছে। এই সব শুনতে শুনতে আর ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেছি অম্বিকা নগর। সেখানকার রাজবাড়ি। কিন্ত সে কথা এখন নয় – সে অন্য বর্ণনা – অন্য ইতিহাস। সে কথা লিখব পরে – একদম আলাদা করে।
এবার ফেরার পালা। ফেরার সময় “সোনাঝুরি” ফরেস্ট লজ কাম প্রকৃতি উদ্যানে সময় কাটালাম বেশ কিছুক্ষণ। তারপর আবার সেই তে মাথার মোড়। দুপুরের খাওয়া সারলাম, হোটেলের নাম মনে নেই কিন্ত যা দেশী মুর্গী খেলাম – এক কথায় অসাধারণ! করাত দিয়ে মাংস কাটলে ভালো হত বোধহয়। ১৫০ টাকায় ৪ পিস – তার একখানাও খেতে পারি নি। একদম তে মাথার মোড়েই হোটেলটা। এরপর কিছু কেনাকাটা শেষ করে একটি ভ্যানো ধরে হোটেলে। রাতেই সব পেমেন্ট ক্লিয়ার করে রাখলাম। এমনিতে বাঁকুড়া ষ্টেশন পর্যন্ত প্রাইভেট গাড়ী ১০০০ টাকা! হোটেল ম্যানেজার বললেন একটি গাড়ী লোক আনতে বাঁকুড়া যাবে সকাল ৯টায়, তাতে গেলে ভাড়া পড়বে ৫০০ টাকা। আমাদের ট্রেন যদিও দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে (রাজ্য রানী এক্সপ্রেস) তবু ৫০০ টাকা বাঁচবে বলে রাজি হয়ে গেলাম।
২৩ তারিখ সকালে উঠে চা খেয়ে ৯ টার মধ্যে নীচে – হোটেলের রিসেপশনে। সই – সাবুদ সারতে সারতেই গাড়ী হাজির। বাঁকুড়া পৌঁছালাম ১০টার মধ্যে। ট্রেনের সময় ১টা ৪৫। টিকিট কেটে নিলাম ভাড়া বাঁকুড়া থেকে শালিমার ১০০ টাকা। এই ট্রেনটি সপ্তাহে তিন দিন চলে, বৃহস্পতি, শুক্র আর রবি।ট্রেনে কোন রিজার্ভ কোচ নেই। সময় কাটানোর জন্য বুক স্টলের খোঁজ করলাম – হায় রে ! এর থেকে মরুভূমিতে জল খোঁজা সোজা। গোটা ষ্টেশনে (এমনকি প্ল্যাটফর্মেও) কোন বইয়ের স্টল নেই – নেই ষ্টেশনের বাইরেও। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, কাছাকাছির মধ্যে বই পাওয়া যাবে ২ – ৩ কিমি দূরে। একটি জেলা সদর এবং জাংসন ষ্টেশন। হতে পারে, রেল মন্ত্রক মনে করে বাঁকুড়া জেলায় যারা থাকে বা যারা বাঁকুড়া ষ্টেশন দিয়ে যাতায়াত করে তারা সবাই অশিক্ষিত! কি করি ? দেখলাম বোর্ডে দেখাচ্ছে আপ রাজ্য রানী ঢুকবে ১০টা ৫৫ মিনিটে ২ নং প্ল্যাটফর্মে। এনকোয়ারি থেকে জানতে পারলাম যে আমরা চাইলে ট্রেনে উঠে বসে থাকতে পারি। অতএব সোজা প্ল্যাটফর্ম। ট্রেন ঢুকল – একটু বাদে আমরাও উঠে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ বাদে একটা অদ্ভুত বিষয় নজরে এল। আমরা যে কোচে ছিলাম, তার সামনে একটি ঘর – লেখা আছে “বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত”। সেই ঘর থেকে যে যে রেল কর্মচারী বার হচ্ছেন তাদের অবস্থা UNITED WE STAND – DIVIDED WE FALL.পালা করে দুজনে খেয়ে নিলাম। ট্রেন ছাড়ল সময় মত। পথে একটিই উল্লেখযোগ্য ঘটনা – গোকুল পুর ষ্টেশনে একটি সুপার ফাস্ট ট্রেন (আমাদেরটি) প্রায় ৪৫ মিনিট দাঁড় করিয়ে একটি আপ গুডস, একটি ডাউন গুডস এবং একটি ডাউন মেদিনীপুর লোকাল ছেড়ে দেওয়া হল। তবুও মোটামুটি ৬ টা ১৫ নাগাদ শালিমার পৌঁছে গেলাম। ওখান থেকে ট্যাক্সি ধরে বাড়ি। শেষ হল ৪ দিনের এক অসাধারণ ঘোরা।
শেষের পরেও কিছু কথা থাকে। ঘোরার সময় যা মনে হয়েছে এই জায়গাটির মধ্যে বিশাল পর্যটন সম্ভাবনা আছে। তবে কিছু কাজ করা দরকারঃ
১) অবিলম্বে সরকারী ভাবে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার (যেমন লোকাল সাইট সিয়িং, বিষ্ণুপুর – শুশুনিয়া, ঝিলিমিলি ফরেস্ট) জন্য একটি ফেয়ার লিস্ট করা প্রয়োজন যাতে পর্যটকদের সুবিধা হয়। এটা না থাকার জন্য যে যেমন খুশি ভাড়া চাইছে;
২) একটি ভালো সাইবার কাফে খোলার ব্যবস্থা;
৩) প্রতিটি রাস্তার নিয়মিত দেখভাল ও আলোর ব্যবস্থা;
৪) সরাসরি কলকাতা থেকে মুকুটমণিপুর পর্যন্ত বাসের বুকিং ও সম্ভব হলে ট্যুরিস্ট সিজনে এসি বাসের ব্যবস্থা করা।

No comments:

Post a Comment