10 November, 2015

মুকুটমণিপুর, বিষ্ণুপুর, শুশুনিয়া - ভ্রমণ কাহিনী – প্রথম পর্ব




আমার এই লেখাটি কে তিনটি আলাদা ভাগে ভাগ করব। একটি ভ্রমণ কাহিনী বাকি দুটি দুই বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাস – তার এক অংশে আছে এক লোকশিল্প আর দ্বিতীয়টি এক পুরানো রাজা তথা জমিদারের কথা।
ভ্রমণ কাহিনী – প্রথম পর্ব
মুকুটমণিপুর, বিষ্ণুপুর, শুশুনিয়া পাহাড় দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে আমার বহুদিনের – বিশেষত বিষ্ণুপুর। ওখানকার মল্ল রাজবংশ, টেরাকোটা, দলমর্দন (দলমাদল) কামান, বিষ্ণুপুরি সিল্ক, বালুচরি ও স্বর্ণচরি শাড়ি, দশাবতার তাসের কথা বহুবার পড়েছি আর মনে মনে ঘুরে বেড়িয়েছি বিষ্ণুপুরের পথে পথে। তাই ভাবলাম এবার না হয় বাংলার এই অঞ্চলেই আসি ঘুরে – সঙ্গে ঘোরা হবে জঙ্গলমহলের এক অংশ – দেখতে পাব আমার মাতৃভূমি বাংলার আর এক রূপ – আবার নতুন করে কিছুদিনের বাঁচার রসদ পেয়ে যাব।
যথা ইচ্ছা – তথা কর্ম। আমার ফেসবুকিয় বন্ধু, আমাদের সকলের প্রিয়, চির তরুণ শ্যামলদাকে ধরলাম। তার “পর্যটক” সংস্থার মাধ্যমে ১৯শে অক্টোবর থেকে ২৩শে অক্টোবর পর্যন্ত থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল “হোটেল অপরাজিতা”য়। বাসের টিকিট তিনিই কেটে দিলেন (আমার প্ল্যান ছিল আরণ্যক এক্সপ্রেসে যাব – ফেরার সময় দেখলাম সেটা করলে ভুল হত)। ১৭ আর ১৮ শনি – রবি থাকার জন্য জিনিস গুছাতে কোন সমস্যাই হয় নি, আবার বাড়ির সামনেই, আমাদের প্রতিবেশী একজনের ট্যাক্সি আছে (আলাদা চালক আছে কিন্ত প্রয়োজনে নিজেও চালান)ফলে ভোরবেলা বাড়ি থেকে বার হতেও কোন অসুবিধা হয় নি। অবশ্য এটা স্বীকার করব, পঞ্চমীর রাতে দেশপ্রিয় পার্কের “কেলোর কীর্তি”র ফলে কলকাতা যেভাবে আটকে গেছিল তাতে একটু ভয় হয়েছিল যে ট্যাক্সিটা আদপে ঢুকতে পারবে তো। না, সে ভয় অমূলক ছিল কারণ গাড়ী ১২টার আগেই বোধহয় ঢুকে গেছিল (আগে শুয়ে পড়লেও টেনশনে ঘুম হচ্ছিল না, ১২টা নাগাদ একবার ব্যালকনিতে এসে দেখলাম ট্যাক্সি যথাস্থানে)।
বিছানা ছাড়লাম ৩টেয় – ৫টার মধ্যে তৈরি হয়ে নিলাম দুজনে। (এর মাঝে অবশ্য ফেসবুকে “দানবিক দুর্গা” নিয়ে করা আমার পোষ্টের উপর করা কিছু কমেন্টের উপযুক্ত উত্তর দিতে ভুলিনি।) দুয়ারে প্রস্তত গাড়ী – যাত্রা হল শুরু। যাত্রার প্রথম পর্ব শেষ হল SBSTC ধর্মতলা বাস স্ট্যান্ডে এসে। গাড়ী ছাড়বে সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটে, আমরা এসে গেছি ৬টায়। অতএব, বাসে বসে প্রতীক্ষা। ঠিক ৬টা ৪৫ মিনিটে বাস ছাড়ল – শুরু হল দ্বিতীয় পর্ব। বিদ্যাসাগর সেতু পার হয়ে কোণা এক্সপ্রেসওয়েতে পড়েই রানওয়ের মত মসৃণ রাস্তা পেয়ে গতির ডানায় ভর করে উড়ে চলল বাস। যেহেতু সামনের দিকেই সীট ছিল, মাঝে মাঝে ভয় লাগছিল, বিশেষ করে উল্টো দিক আশা গাড়ী গুলোকে বা পাশ দিয়ে চলা মোটর বাইক / সাইকেলগুলো দেখে। দেখলাম ভয় পেয়ে লাভ নেই বরং চোখ বন্ধ করে থাকি (আমরা এটা যে একেবারে পারি না, তাতো নয়)। শক্তিগড় এসে গেল যেন চোখের পলকে। এরপর পানাগড় পর্যন্ত রাস্তা ভালো, তারপর দেখলাম কাজ চলছে – দুর্গাপুর পর্যন্ত গাড়ী একটু ঢিমে – তেতালায় চলল। সমস্যা হল দুর্গাপুরে ঢুকে। সিটি সেন্টার ও ষ্টেশন মিলিয়ে বাস থামল প্রায় ১ঘণ্টা। তারপর অবশ্য ৪০ মিনিটের মধ্যেই বাঁকুড়া ঢুকল, বাঁকুড়া থেকে মুকুটমণিপুর রাস্তাও খুব ভালো, ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের মধ্যে ঢুকে গেলাম – আমার ঘড়িতে তখন দুপুর ১টা ১৫ মিনিটবাঁধের মোড় থেকে ভ্যানোতে চেপে হোটেল অপরাজিতা – সময় লাগল ৫ মিনিট মত, ভাড়া লাগল ২০ টাকা। শেষ হল যাত্রা পর্ব। বলতে ভুলে গেছি, ধর্মতলা বাস স্ট্যান্ড থেকে কিন্ত সরাসরি মুকুটমণিপুরের টিকিট পাবেন না, পাবেন বাঁকুড়া পর্যন্ত – ভাড়া ১৫০ টাকা। দুর্গাপুর থেকে আলাদা টিকিট দিয়ে দেবে বাঁকুড়া – মুকুটমণিপুর, ভাড়া ৪২ টাকা।
এবার আসি অপরাজিতার কথায়। হোটেলটি মূল রাস্তা থেকে প্রায় ১ কিমি দূরত্বে এবং রাস্তা বলতে কোন এক কালে পিচের আস্তরণ পড়েছিল (এখন আবার পড়ছে [কারণ তিনি আসছেন] আর  যেভাবে পড়ছে তাতে অচিরাৎ পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে এটা নিশ্চিত) এরকম একটি UNDULATING ROAD.  হোটেলের প্রতিটি ঘর এসি কিন্ত সেই এসিতে আওয়াজ বেশী হয় – ঘর ঠাণ্ডা হয় কম। হোটেলের মধ্যেই রেস্তোরাঁ ও বার আছে। রেস্তোরাঁয় খাবারের কোয়ালিটি ভালো কিন্ত দাম যথেষ্ট চড়া, বারে মদের দাম কলকাতার চেয়ে তুলনামূলক ভাবে একটু কম। হোটেলের রুম সার্ভিস ও স্টাফদের আচরণ প্রশংসনীয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা মূল লোকালয় থেকে বেশ কিছুটা দূরে হওয়ার জন্য এবং রাস্তায় আলো না থাকার জন্য সূর্য ডুবে যাওয়ার পরে আর কিছু করার নেই (যদি আপনার নিজস্ব গাড়ী না থাকে)এমনিতে এই রাজ্যের যে কোন পর্যটন স্থলের চেয়ে মুকুটমণিপুর ঘুরতে খরচা বেশী পড়ে কারণ আপনাকে গাড়ী নিয়ে ঘুরতে হবে আর গাড়ী ভাড়া – ঝিলিমিলি ফরেস্ট দেখে আসার জন্য আমার গাড়ী ভাড়া লেগেছে মাত্র ১১০০ টাকা। আসলে আমি যদি মূল শহরে থাকতে পারতাম তাহলে অনেক কম টাকা লাগত কিন্ত হোটেল অপরাজিতা বা এই ধরনের হোটেল গুলির ক্ষেত্রে দরদাম করার সুযোগ নেই, আবার বাঁধের পাশাপাশি মূল রাস্তার ধারে যে সব হোটেল গুলি রয়েছে (রাজ্য সরকারী বাদে) সেই সব হোটেলের ম্যানেজাররাও নিজেরা কমিশন খাওয়ার জন্য ওদের মাধ্যমেই গাড়ী নিতে জোর দেয় এবং গাড়ী চালক ভাইয়েরা জানেন তারা যদি এদের কথায় না চলেন তবে ভবিষ্যতে তাদের রোজগারের পথ অনেকটাই কমে যাবে।

যাই হোক, ২০ তারিখ সকালে ৯টার সময় গাড়ী হাজির। আমরাও তৈরি। গন্তব্য ঝিলিমিলি ফরেস্ট। রানিবাঁধ মহকুমার অন্তর্ভুক্ত এই ফরেস্ট (মুকুটমণিপুর খাতরা মহকুমার অন্তর্ভুক্ত) জঙ্গলমহলের একটি অংশ। এই ফরেস্টের সৌন্দর্যের বর্ণনা আমার কলমে আসা কঠিন কারণ এ লেখার নয় এ পড়ার নয়, এ সৌন্দর্য অনুভবের ! অনন্ত সবুজ – শাল, পলাশ, মহুয়া, ইউক্যালিপটাস ও আরও কত নাম না জানা গাছে ঢাকা এ অরণ্য। পায়ের তলার মাটি লাল উপরে নীল আকাশ আর মাঝে সবুজ বনানী - ধরণী মা তার যেন বুকের রক্তে লালন করে চলেন তার প্রিয় সন্তানকে ! দিগন্তে সবুজ বনে ঢাকা পাহাড়ের সারি, তার মাঝে অস্পষ্ট চোখে পড়ে কুঁয়ারি নদী। আমাদের সারথি আমাদের বিভিন্ন ভিউ পয়েন্টে নিয়ে যাচ্ছিলেন, আমি এক সময় বলেই ফেললাম – “আপনি আর কি ভিউ পয়েন্ট দেখাবেন, পুরো পথটাই তো ভিউ পয়েন্ট!” উনি হেসে ফেললেন – “তা যা বলেছেন!” গেলাম একটি বিশাল বড় পুকুরে – চারিদিকের জঙ্গল ধুয়ে আসা জল দিয়ে এ পুকুর তৈরি – নাম বোধ হয় তালড্যাঙরাআগে এখানে বোটিং হত – এখন সব বন্ধ কারণ উন্নয়ন চলছে আর জঙ্গলমহল হাসছে ! সে যাই হোক, জায়গাটার সৌন্দর্য অসাধারণ ! আরও বোধহয় এই কারণে বেশী ভালো লেগেছে যে সেই সময় সেখানে আমরা তিনজন ছাড়া (আমি, সুরিতা ও আমাদের সারথি) আর কেউ ছিল না – জঙ্গলের সরব নীরবতা উপলব্ধি করতে পারছিলাম আমরা। ফেরার সময় একটি ছোট্ট গ্রামে গাড়ী দাঁড় করালাম, যাওয়ার সময় মনে হয়েছিল ওখানে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারব। ঠিক তাই দুটি অল্প বয়সী বন্ধু (দুজনেই এম এস সি পাশ) একটি মোবাইল সারাই, রিচার্জ ইত্যাদির দোকান করেছে সঙ্গে অনলাইনে বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম ফিলাপ এর কাজও করে (এত কথা জেনেছি পরে)। ওখানে গিয়ে আমার ক্যামেরা আর মোবাইল থেকে বেশ কিছু ছবি পোস্ট করলাম ফেসবুকে। প্রথম দিকে ওদের একটু দ্বিধা ছিল তারপর আস্তে আস্তে ওরাও সহজ হয়ে মিশে গেল। ঝিলিমিলি জঙ্গলের ছবি ফেসবুকে দিচ্ছি দেখে ওদের মুখ ভরা হাসি দেখে মনে হল আমার বেড়ানোর প্রকৃত আনন্দ যেন আমি খুঁজে পেলামকথায় কথায় জানতে পারলাম ওরা  টেট বা রাজ্য সরকারী কোন পরীক্ষা বাদে অনেক পরীক্ষাই দিয়েছে (এখনও দিচ্ছে)কিন্ত হয় নি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন টেট নয় কেন ? বলল ৫ লাখ বা ১০ লাখ টাকা কোথায় পাব কাকু ? আর দিলেই যে হবে তার নিশ্চয়তা কি ? আমাদের সারথি ভদ্রলোক একটু তর্ক জুড়ে দিলেন, আমি আমার কাজে ব্যস্ত থেকে ওদের কথা শুনতে থাকলাম । শেষে ওরা বলল, আপনি চুপ করুন তো এবার যদি কোর্টে টেট আটকে যায়, তখন দেখবেন এখানে কি হয়। কাকু তো চলে যাবেন, আমি – আপনি তো থাকব, যারা পয়সা দিয়ে সাদা খাতা জমা দিয়েছে, তারা এমনি এমনি ছেড়ে দেবে নাকি! যদি এখন কিছু না করে তাহলে মওকায় থাকবে, যেদিন তালে পাবে, বুঝে নেবে। আমার কাজ ইতিমধ্যে শেষ, ওদের টাকা দিতে হবে, জিজ্ঞাসা করতে ওরা বলল “ও আপনি যা ভালো বুঝবেন তাই দেবেন”। আমার সাধ্যমত যা পারলাম দিয়ে চলে আসছি বলল “কাকু আবার আসবেন”, তারপর আমাদের সারথি দাদার দিকে তাকিয়ে বলল “আমাদের কথায় কষ্ট পাবেন না, আমরা দুই বন্ধু ঠিক চালিয়ে নেব – আপনাদের এই সরকারের কোন ভিক্ষা আমাদের দরকার নেই”। গাড়িতে বসে ভাবলাম, আমার অর্ধেক বয়সের দুটো ছেলে এই মনের জোর পেল কোথা থেকে ? বুঝলাম জীবন শিক্ষা দেয় – বুঝলাম এই হল “আঠারো বছর বয়স”। ওরা বারবার বলেছিল সুতানে যেতে, সেই সুতান যে সুতান বনবাংলো উড়িয়ে দিয়েছিল “না থাকা মাওবাদীরা”। “না থাকা মাওবাদী” বললাম এই কারণে যে বর্তমান শাসক দল ২০১১ সালের আগে পশ্চিমবঙ্গে “মাওবাদী” নামক কিছুর অস্তিত্ব আছে তাই স্বীকার করত না – বলত জঙ্গলমহলে কোন “মাওবাদী” নেই আছে “কামাওবাদী” ! যাই হোক, আমাদের সারথি নিমরাজি হলেও আমাদের আগ্রহে যেতে বাধ্য হলেন – গভীর জঙ্গলের পথে ঢুকল গাড়ী, রাস্তা পিচের হলে কি হয় দুপাশে ঘন জঙ্গল। এক পাশে দেখলাম পথ নির্দেশ দেওয়া “লেথরা গ্রাম”, এরকম আরও দুটি গ্রামের নাম লেখা দেখেছি ওই পথে – একটি অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া আর কোন গাড়ী দেখতে পাই নি। সত্যি কথা বলতে কি মাঝে মাঝে একটু ভয় করছিল – এসে পৌঁছালাম সুতান বন বাংলোর সামনে – ধ্বংসের চিহ্ন বয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে নীরব প্রকৃতির মাঝে। না কোন ছবি তুলি নি – তুলতে ইচ্ছা করে নি। “সুতান বন বাংলোর” ছবি এক কাঁটা হয়ে আমার মনে থেকে যাবে আর আমার ঘৃণাকে চির জাগরূক করে রাখবে সেই সব মানুষের মুখোশধারী চাটুকারদের প্রতি যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী বলেন। আসলে এটাই খারাপ লাগে যে, এত সুন্দর একটি জায়গাকে, এখানকার মানুষের সুন্দর মনকে এরা বিষাক্ত করেছেন নিজেদের স্বার্থে – এই সহজ সরল মানুষের কথা ভেবে নয় ! তাহলে এরা এখানে এসে কাজ করতেন এখানকার মানুষদের জন্য – এখানকার শিল্প – এখানকার সংস্কৃতি, এখানকার ঐতিহ্যকে তুলে ধরতেন বিশ্বের মানচিত্রে – তা এরা করবেন কেন ? ওটা অনেক পরিশ্রমের কাজ ! এরা তো এত জন দরদী ! আপনাদের কাছে প্রশ্ন করি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী – আলিপুর বোমার মামলায় জড়িত অম্বিকা নগরের রাজার রক্ত যাদের শরীরে বইছে তাদের কেন আমার মত অকিঞ্চনদের তাদের পুরানো ইতিহাস শুনিয়ে টাকা রোজগার করতে হয় ? কেন সেখান থেকে চুরি যাওয়া কালাচাঁদ মূর্তির হদিশ পুলিশ এখনও করতে পারে না ? কেন বলুন তো ? অম্বিকানগরের গল্প এক আলাদা ইতিহাস – আলাদা করেই লিখব সে ইতিহাস, ছবি সহ। এখন ঝিলিমিলি ভ্রমণ শেষ, ২১ তারিখ যাব শুশুনিয়া পাহাড় ও বিষ্ণুপুর, সকাল ৮টায় যাত্রা হবে শুরু।

1 comment:

  1. এটা কি travel blog ছিল না কি রাজনৈতিক প্রবন্ধ? বড় আশা করে page টি খুলেছিলাম বাঁকুড়ার দর্শনীয় জায়গা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবো

    ReplyDelete