10 November, 2015

কভনার



লেখকের নিবেদনঃ ২য় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় এ আত্মকথার সব চরিত্রই কাল্পনিক আবার কাল্পনিক নয়ও। হিটলারি জার্মানি এমন অনেক নৃশংস  অত্যাচার সংগঠিত করেছে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ঠিক তেমনই সশস্ত্র এবং নিরস্ত্র দুই প্রতিরোধও সংগঠিত হয়েছে – অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি যার জীবন্ত প্রমাণ। সেই বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় রচিত একটি নাটকের একটি চরিত্রের আত্মকথন এই লেখাটি।
আমি কভনার। পেশায় ট্রাক ড্রাইভার। বাড়ী অস্ট্রিয়া। না ভুল বললাম এখন আর অস্ট্রিয়া নয়, আমরা অস্ট্রিয়ান ছিলাম। সালজবুরগ পার হয়ে অস্ট্রিয়ান আল্পসের পাশে এক গ্রামে বাস ছিল আমাদের। সভ্যতার ছোঁয়া ছিল – তার পাপ লাগে নি কোনদিন। সবুজ মাঠে ভেড়া চরত – ফলত ফসল। বাবা আর তার বন্ধুরা ছোট ছোট ট্রাক ভর্তি করে শস্য আর ভেড়া নিয়ে যেত শহরে।
পড়াশোনার চেয়ে অনেক বেশী আমার মন টানত ছোট ট্রাক গুলো। স্কুলে থাকার চেয়ে স্কুলের বাইরের মাঠ – পাহাড় চুড়ো আর নীল আকাশ দুলিয়ে দিত আমার মন। আর দুরন্তপনা ! কত যে মারামারি করেছি, যেমন মার খেয়েছি পাল্টা মারও দিয়েছি। আমি ছোটবেলা থেকেই অন্যের কষ্ট সহ্য করতে পারতাম না। বেশী মারামারি করেছি সেই জন্যই। মা বকতেন কিন্ত বাবা বলতেন এই তো চাই।
বাবার ট্রাকটা পরিষ্কার করার সময় আমি থাকতাম বাবার সাথে। মাঝে মাঝে শহরে যেতাম। এই ভাবে ট্রাকটার প্রতি একটা ভালোবাসা জন্মে গেছিল। বাবার সাথে যখন শহরে যেতাম চলার পথে বাবা গল্প বলতেন – মানুষের গল্প। কিভাবে মানুষ প্রকৃতির খামখেয়ালীপনার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, কিভাবে অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে – কত গল্প। ধীরে ধীরে বুঝছিলাম মানুষকে ভালবাসতে গেলে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে একা লড়া যায় না। দল গড়তে হয় আর প্রয়োজনে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হয়।
আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিলাম। হঠাৎ করে এক রবিবার চার্চে শুনলাম দুদিন পরে গ্রামে এক সভা হবে – কিসব নতুন কথা বলা হবে, নতুন শাসন চালু হয়েছে দেশে। এল সেই দিন – দেখলাম সভাস্থল ঘিরে ফেলা হয়েছে নতুন পতাকায়, স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা। সভা শুরু হল গান দিয়ে “ডয়েসল্যান্ড উইবার অ্যালেস”। এ তো  আমাদের গান নয়, এত জার্মানির গান। সভাতে বলা হল আমরা নাকি আসলে অস্ট্রিয়ান নই, আমরা জার্মান, আমাদের দেশ জার্মানি, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত “ডয়েসল্যান্ড উইবার অ্যালেস”, আমাদের জাতীয় পতাকা  স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা ওই পতাকা। মিলিটারি পোশাকে একদল লোক দাঁড়িয়ে ছিল তাঁরা স্লোগান তুলল “হেইল হিটলার”। আরও বলা হল যুদ্ধ শুরু হবে ফলে সেনাবাহিনীতে অনেক লোক লাগবে – প্রতি পরিবার থেকে ১/২ জন সক্ষম পুরুষকে সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে হবে। ফসলের এবং ভেড়া গুলোর একটা অংশ সেনাবাহিনীর জন্য দিতে হবে নিয়মিত ভাবে। যারা এই নির্দেশ মানবে না তাদের জন্য কঠোর শাস্তি বরাদ্দ। পরদিন থেকেই গ্রামে একটা পুলিশ ঘাঁটি তৈরি হল – গ্রামের মোড়ল কে তার পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে সেখানে বাইরে থেকে আসা একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হল।
স্বাভাবিক ভাবেই সবাই এ কথা মেনে নেয় নি। ফলে শুরু হল অত্যাচার। মার – ধোর থেকে শুরু করে ফসল নষ্ট করা, বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া – সব কাজ চলতে লাগল সমান তালে। গ্রামের অবস্থাপন্ন পরিবার গুলো আর কিছু শয়তান প্রথম থেকেই ওদের দলে ভিড়েছিল আর এসব কাজে ওদের উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশী। আমার বয়স তখন ২৬। গ্রামে আমার নিজস্ব একটা বড় দল ছিল যারা আমার কথা শুনত আর শুনত ইয়রগের কথা। ইয়রগ আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। ওর দোষ ছিল একটাই – বড্ড মাথা গরম। ওকে বোঝাতাম এখন আমাদের শক্তি কম তাই চুপ করে থাক একদিন সময় আসবে। কথা শুনল না – একদিন দেখল দুটো পুলিশ একটা মেয়ের সাথে অসভ্যতা করছে, ব্যস ! দুটোর অবস্থা খারাপ করে ছেড়ে দিল। পরের দিন – গ্রামের সবার ডাক পড়ল স্কোয়ারে। দেখলাম ইয়রগের দুহাত টেনে বাঁধা – বিচার হবে। জার্মান পুলিশের গায়ে অন্যায় ভাবে হাত তোলা, জার্মান শাসনের বিরোধিতা ইত্যাদি আরও কি কি সব অপরাধ। যারা অভিযোগকারী তারাই সাক্ষী। বিচারে রায় – দুহাত টান করে ঝুলিয়ে রাখা হবে দুদিন – কোন খাবার/জল পাবে না আর ১০০ ঘা বেত। বেত মারা শুরু হল। সকলকে বাধ্য করা হল দেখতে। না ইয়রগের মুখ থেকে কোন আর্তনাদ শোনে নি কেউ। দুদিন গেল না তার আগেই ইয়রগের শাস্তি শেষ হয়ে গেল। পরের দিন সন্ধ্যায় ইয়রগকে নামিয়ে আনা হল কারণ ওকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আর কারও ছিল না।
ঠিক এক সপ্তাহ পরে আমি জার্মান আর্মি তে যোগ দিলাম ট্রাক ড্রাইভার হয়ে। সেই থেকে আজও করে চলেছি সেই কাজ। আমার প্রথম পোস্টিং হয় রাশিয়ায়, লেনিনগ্রাদে। সেখানেই যুদ্ধবন্দীদের মাধ্যমে রাশিয়ান সাথে পরিচয়। ওদের মধ্যে কেউ কেউ জার্মান বলতে পারত। আস্তে আস্তে রুশ শিখতে লাগলাম। না কোন একজনের কাছ থেকে নয় – অনেকের কাছ থেকে। আমার কাজ ছিল ওদের সাথেই – ট্রাকে করে ওদের আনা – নেওয়া করা। ওদের দিয়ে বাঙ্কার বানানো, ট্রেঞ্চ খোঁড়া, ময়লা পরিষ্কার এই ধরনের অজস্র কাজ করানো হত। সবচেয়ে বেশী অত্যাচার চলত গেরিলাদের উপর। আমি সহ্য করতে পারতাম না তবু চুপ করে থাকতাম। থাকতাম সুযোগের অপেক্ষায়।

একদিন আমি আর আরও দুটো ট্রাক চলেছে বন্দিদের নিয়ে, এমন সময় হামলা হল। আমার পাশে বসা সৈন্যটার হাতে গুলি লাগতেই ওর হাত থেকে সাবমেসিনগানটা পড়ে গেল – আমি এক ঝটকায় সেটা তুলেই ওকে ওর দোসরদের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। তারপর এক লাফে ছুটে গেলাম বাকি হারামজাদা গুলো যেদিকে আড়াল নিয়েছে সেই দিকে। ওরা ভাবল, আমি ওদের বাঁচাতে এসেছি। আমার চোখের সামনে তখন ইয়রগের রক্তাক্ত শরীরটা। এমনই একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম এতদিন। গেরিলারা ছুটে এল ওদের সঙ্গীদের নিয়ে যেতে। আমাকে দেখেই সাবমেসিনগান তুলে ধরল একজন। বাঁচিয়ে দিল আমার ট্রাকে থাকা এক বন্দী। নাম ফিওদর – না তখন আমি ওর নাম জানতাম না জেনেছি পরে। আমি দেখলাম সবকটা জার্মান মরেছে। আমি বললাম আমায় বন্দী কর। বন্দী হলাম। তারপরের কাহিনী শেষ করি একটু দ্রুতলয়ে।
লেনিনগ্রাদ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় আমার বাহিনী আমায় উদ্ধার করেকপালে সেলাইয়ের দাগ, তিনটে বুলেট হাতে আর পায়ে নিয়ে আমি কোন রকমে এসে পড়ি ওদের গাড়িগুলোর সামনে। বিশ্বাস করুন, ওই তিনটে বুলেট মেরেছিল আমার বন্ধু ইয়রগ (না ও তো ফিওদর – যার মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছি ইয়রগকে)। আমি আমার দেশে ফিরে এলাম – জার্মানিতে ! গুলির আঘাত সারল। এবার আমার পোস্টিং হল লাতভিয়ায়। আপনাদের এখানে, কমরেড সেলমা গ্রোসমান ছিলেন এর পিছনে ! হ্যাঁ আমি কমরেড শব্দটার মানে এতদিনে জেনে গেছি। পার্টিজান ক্যাম্প থেকে এক বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে আমাকে পাঠানো হয়েছিল জার্মানদের কাছে। যেদিন থেকে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি, সেই দিন থেকে আমি তাঁর নির্দেশেই চলেছি এবং আজও তাঁর নির্দেশেই আমি আপনাদের সামনে যদিও আপনাদের মতই তাঁকে আমি চিনি না। আমি চিনতে চাইও না কমরেডস্‌ কারণ কমরেড ফিওদর আমাকে শিখিয়েছেন –
যাই হোক, আমার আঁকা দেখে কি বুঝছেন আমি জানি না, শুধু এটা জানি শেষ হিসেবের সময় এবার এসে গেছে। আপনারা ঠিক করুন, কাল আমার ট্রাকে কে কে যাবেন, আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। একটা কথা শুধু বলে যাই কমরেড আনাতোল – যদি নির্দেশ আসে আমার ট্রাকটা চালিয়ে আগুনের মাঝে ঢুকে পড়ে বিস্ফোরণে শয়তানের আস্তানা উড়িয়ে দেওয়ার, আমার স্টিয়ারিং ধরা হাতটা একটুও কাঁপবে না কারণ আমি বিশ্বাস করি মানুষের বাঁচার জন্য – এই সংহারক দানবিক শক্তির হাত থেকে মানব সভ্যতাকে বাঁচানোর জন্য তা বড় দরকার – ওই বাচ্চা মেয়েটার জন্য বড় দরকার। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি কমরেড।
পরদিনের জন্য আর অপেক্ষা করতে হয় নি আমায়। সেদিনই আমার ট্রাকে করে বিস্ফোরক পাঠানোর কথা ছিল। লাল ফৌজ তখন ঘেটো থেকে মাত্র ৩ কিমি দূরে।  কমরেড গ্রোসমানের নির্দেশে আমি আমার ট্রাক নিয়ে ঢুকে যাই ওদের অস্ত্রাগারে, যে অস্ত্রাগার থেকে আমার ট্রাকে ওঠানো হয়েছিল ডিনামাইট স্টিকগুলো সেখানেই। ওদের জিনিস ওদেরকেই ফিরিয়ে দিতে আর ওই বাচ্চা মেয়েটাকে বাঁচাতে। আমি শোধ করেছি ইয়রগের ঋণ – আমি শোধ করেছি আমার দেশ অস্ট্রিয়ার ঋণ – সবচেয়ে বড় আমি শোধ করেছি মানুষের ঋণ।
আমি জানি, দানবিক শক্তি আবার যখন মাথা তুলবে ইয়রগ, কমরেড ফিওদর, কমরেড গ্রোসমান, কমরেড আনাতোলরা আমার মত কভনারদের আবার মুক্তির পথ দেখাবে।

No comments:

Post a Comment