কিভাবে শুরু করব আর কোথায় শেষ করব বুঝতে পারছি না। এখনও মনে
হচ্ছে একটা স্বপ্নের মধ্যে আছি, একটা ঘোরের মধ্যে আছি। এমন একটা দিন, যে দিন এর
আগে আমাদের জীবনে আসে নি, যে দিনের স্মৃতি নিয়ে চলা যায় বাকি জীবনের প্রতিটি
মুহূর্ত।
আমাদের
২৫ বছরের বিবাহবার্ষিকী। এই দিনের কথা ভাবতে শুরু করেছিলাম অন্তত
৫ বছর আগে থেকে। আমাদের ২৫ বছরের বিবাহবার্ষিকী হবে এমন একটি অনুষ্ঠান, যেখানে
আমাদের আত্মীয় – স্বজন, দুজনের বন্ধুরা এবং আমার অফিসের সহকর্মীরা একসাথে মিলে
আনন্দ করতে পারব। একটি চিন্তা ছিল, যে আমাদের লোক বল সেরকম নেই, কি করে সুন্দর
ভাবে সম্পূর্ণ করতে পারব? তারপর মনে হল, আমার জীবনের চলার পথে একটা মজার বিষয় আছে।
যে কোন কাজেই প্রথমে একটু অসুবিধা হয়, তারপর কি করে যেন সব ঠিক হয়ে যায়। সেই ভরসা
সাহস যোগাল মনে। তখন ২০১৪ সাল, বদলী হয়ে এলাম রাজডাঙ্গা বিল্ডিং এ। পোস্টিং
সার্ভিস ট্যাক্স ওয়ান কমিশনারেট বি বি ডি বাগ টু ডিভিশন, রেঞ্জ থ্রি তে। পরিচয় হল SUPERINTENDENT শ্রী সুনীল দাশ এর সাথে। আস্তে আস্তে ডিভিশনের অন্য অফিসারদের
সাথে পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা বাড়তে শুরু করল। মনের ইচ্ছাও ডানা মেলতে শুরু করল একই
সাথে। সজল, কাকলি, গৌরব, প্রসাদ সাহেব, সতীশ স্যার, মল্লিক সাহেব – ২৪৯ নাম্বার ঘর
টা তখন যেন রুক্ষ মরুভূমির মধ্যে এক চিলতে সবুজ মরুদ্যান। অফিসের কাজের সাথে হাসি,
ঠাট্টা, সিরিয়াস আলোচনা, আড্ডা, লেগ পুলিং – কি নেই সে মরুদ্যানে! এবার যুক্ত হল
খাওয়া – দাওয়া। (যাই হোক, সার্ভিস ট্যাক্স
ওয়ান কমিশনারেট, বি বি ডি বাগ টু ডিভিশন আর এক আলাদা অভিজ্ঞতা শেয়ার করার দাবী
রাখে। শুধু বলি,
চারিদিক
দেখে বেড়ায় পাঁচ জনা
মনের
পথে ভেসে বেড়ায় পাঁচ জনা
মনের
সাথী খুঁজে পায় রে এক জনা
চারিদিক
খুঁজে বেড়ায় পাঁচ জনা)
মনের
সাথী খুঁজে পেয়েছিলাম আমরা সব্বাই। অনেক গল্প আছে, আছে অনেক সুন্দর অভিজ্ঞতা। এখন
না হয় থাক সে কথা।
একটা
সময় আমি সবার কাছে কালকের এই দিনের কথা
বললাম। সকলেই হই হই করে উঠল। দিন – তারিখ মনে নেই, সকলে মিলে মাঝে মাঝেই আমার LEG PULLING শুরু হল।সেই সময়, BBD BAG – II DIVISION এর SUPERINTENDENT,
U. C. MALLIK এর প্রমোশন আসন্ন, একই সাথে প্রমোশন
পাবেন শ্রী সুনীল দাস এবং আরও বেশ কিছু SUPERINTENDENT,
ওরা
ASSISTANT
COMMISIONER হবেন এবং সেই খালি জায়গায় PROMOTION পাব আমি (SENIORITY LIST অনুযায়ী)! আর কে কাকে
পায়! জুনিয়র দের মধ্যে সিনিয়র মোস্ট আমি, ফলে সব্বাই মিলে আমার পিছনে! তার সঙ্গে
শুরু হল, আরও পিছনে লাগা, কবে আসবে সেই দিন। এই ভাবে চলছিল, ২০১৭ র ৩১ শে মার্চ প্রমোশন পেলাম, তারপর GST. বদলী
হয়ে ছড়িয়ে পড়লাম কিন্ত গ্রুপ ভাঙ্গলো না বরং জন্ম নিল BBD BAG – II WHAT’S APP গ্রুপ। আগের মতই মাঝে মাঝে খাওয়া – দাওয়া, আড্ডা চলতে থাকল। এল
২০১৭ র ডিসেম্বর। বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে একসাথে মিললাম বিবেক ভারতী শিশু শিক্ষা
সদনের ১৯৭৮ পাশ আউট ব্যাচের বন্ধুরা। দিনটা ছিল ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭। প্রথম মিলনমেলায় আমাদের নিয়ে উৎসাহ টা বেশী ছিল (এবং এখনও আছে) কারণ বন্ধুদের
মধ্যে আমরাই সেই বন্ধুকে চিরকালের সাথী করে নিয়েছি। হাসি – মজা – আড্ডার মাঝেই আমি
জানালাম, ২০১৯ সালের ১৭ই জানুয়ারী আমাদের বিয়ের ২৫ বছর পূর্ণ হতে চলেছে এবং
বন্ধুরা সব্বাই (তাদের পরিবার সহ) এই অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত। BBD BAG – II তে শুরু হয়েছিল সলতে পাকানোর কাজ এবার তাতে ঘি ঢালা হল। আর
একটা WHAT’S
APP গ্রুপ জন্ম নিল, “বিবেক ভারতী, ১৯৭৮”।
মাঝে
মাঝেই দেখা হয়, গল্প হয় তার সাথে চলতে থাকে, ১৭র পরিকল্পনা। প্রথমেই বাড়ি দেখা।
আমাদের ইচ্ছা ছিল আমাদের ফ্ল্যাটের কাছাকাছি কোন একটি জায়গায় অনুষ্ঠান করব। প্রথম
পছন্দ ছিল কল্যাণ পরিষদ ক্লাবের কল্যাণ ভবন ও সংলগ্ন মাঠ। পার্থ পোদ্দার এবং
বিমানের দৌলতে সে ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমাদের আর চিন্তা নেই কারণ এখন আমাদের পাশে
এসে গেছে আমাদের ছোট্ট বেলার বন্ধুরা, সেই বন্ধুরা, যাদের ভালোবাসায় কোন খাদ নেই। উলটি
গিনতি (COUNT
DOWN) শুরু হয়ে গেছে। তারপর বয়ে গেল বেশ কিছু পল – অনুপল। আচম্বিতেই বদলী। চলে গেলাম গ্যাংটক। এদিকের কাজের দায়িত্ব নিয়ে নিল বিবেক
ভারতীর বন্ধুরা। এল ডিসেম্বর মাস। ০৩/১২/২০১৮ তারিখ থেকে শুরু হল নিমন্ত্রণ।
প্রথমেই সুরিতার বাবা – মা। মা বললেন “তিনি অবশ্যই যাবেন ওই দিন”। কে জানত সেই
সময়, হয়তো তিনি আমাদের উপর এক মারাত্মক অভিমানে ওই কথা বলেছিলেন। পরের দিন রাত যখন
১২টা ৩০ মিনিট, আমার ফোনে খবর এল তিনি চলে গেছেন এমন এক নিমন্ত্রণ রাখতে, যে
নিমন্ত্রণ খেয়ে কেউ কোন দিন ফিরে আসে না। ০৫/১২/২০১৮ র দুপুরে তাঁকে চির বিদায়
জানালাম আমরা। সেই সময় আমরা জানতে পারলাম, চলে যাওয়ার আগে তিনি আমাদের হয়ে আমাদের
বেশ কিছু আত্মীয়কে জানিয়ে গেছেন ১৭/০১/২০১৯ র অনুষ্ঠানের কথা। ফিরে গেলাম
১৯/১২/২০১৮ তারিখে।
এল
০৪/০১/২০১৯। আগের দু দিন ধরে টেনশন যে পাকিয়ং (সিকিমের একমাত্র বিমান বন্দর) থেকে
ফ্লাইট উড়বে কি না? গাড়ির ড্রাইভারের সাথে কথা হল যে ফ্লাইট না উড়লে আমরা সোজা
শিলিগুড়ি চলে যাব, ০৭/০১/২০১৯ এ দার্জিলিং মেলের টিকিট কাটা ছিল। যাই হোক, তার
দরকার হল না, নির্ধারিত সময়ে ফ্লাইট ছেড়ে কলকাতায় নামল সময়ের আগে। ব্যাগেজ কালেক্ট
করে বাইরে এসে আর এক বিপত্তি, নেট কাজ করছে না, ফলে উবের বা ওলা কিছুই বুক করতে
পারলাম না। কিছুক্ষণ বৃথা চেষ্টার পর, প্রি পেড বুথ থেকে ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি।
গড়িয়াতে ঢোকার আগে বিমান কে ফোন করে বললাম, পেটের মধ্যে আগুন জ্বলছে কিছু খাবার
নিয়ে আয়। যেহেতু ১৯ তারিখে যাওয়ার সময় ফ্রিজ চালু করে রেখে গেছিলাম এবং ঘর দোর
মোটামুটি পরিষ্কার ছিল, তাই আমি বাড়িতে থাকলাম জিনিসপত্র আন লোড করার জন্য আর
সুরিতা দৌড়াল ওদের বাড়ি থেকে রাতের খাবার আনার জন্য। এর মধ্যে বিমান চলে এসেছে,
আমরা গল্প করতে করতেই সুরিতা চলে এল, তার একটু বাদে পার্থ। চার বন্ধুতে মিলে যেমন
আড্ডা হল তেমনি ১৭ই জানুয়ারির ফাইনাল প্ল্যানিং ও হল। তারপরের দিন রান্নার গ্যাসের
ব্যবস্থা হল পার্থর দৌলতে। ৫ তারিখ সকাল থেকেই লিস্ট মিলিয়ে ফোন করা (যাদের বলা হয়
নি) শুরু। ৭ তারিখে দৌড়ানো অফিসে, কিছু টাকার ব্যবস্থা করার জন্য। আমাদের কো
অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটির বন্ধুরা ভীষণই কো অপারেটিভ, তাই দু তিন ঘণ্টার মধ্যেই
সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। ০৮/০১/২০১৯ এবং
০৯/০১/২০১৯ গেল বন্ধ পালনে। যদিও আমি ছুটিতে ছিলাম তবুও নীতি গত ভাবে যেহেতু দাবী
গুলোর সমর্থক তাই রাস্তায় বার হই নি শুধু বুধবার সন্ধ্যা বেলা এক পরিচিত দাদার
সাথে একটু গল্প করতে গেছিলাম। ১১ তারিখ বিমান আর পোদ্দারের মাধ্যমে ডেকোরেশন আর
ইলেকট্রিকের কাজ যারা করবেন তাঁদের সাথে কথা বলে ঠিক হল যে ১৩ তারিখ (রবিবার)
সকালে ওদের সাথে দেখা করে সব কিছু ঠিকঠাক করা হবে। যেই কথা সেই কাজ। সব কিছু ঠিক
হল। এর মধ্যে অনুষ্ঠানের জন্য কিছু নতুন পোশাক কেনা হয়েছে, এটাও ঠিক হয়েছে যে
সুরিতাকে সাজানোর দায়িত্ব পার্থর গিন্নী বর্ণালীর। যত দিন এগোচ্ছে টেনশন বাড়ছে, সব
কিছু ঠিকঠাক হবে তো! আসলে সমস্ত নিমন্ত্রিতকে চিনি একমাত্র আমরা দুজন। না ভুল হল
কথাটা, আমাদের বন্ধুদের বেশীর ভাগের স্বামী / স্ত্রীর সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয়
হবে। সকলকে আপ্যায়ন করা খুব একটা সোজা কাজ নয়।
১৬
তারিখ রাতে মাত্র ঘণ্টা তিনেক ঘুমিয়েছি। সকাল বেলা উঠেই সাড়ে সাত টা নাগাদ একবার
গিয়ে দেখে এলাম কত টা কাজ এগিয়েছে। ফিরে এসে স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে সুরিতাদের
বাড়িতে। বাবা – মা কে প্রণাম করতে। মার ছবির সামনে গিয়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারি
নি। বাবা সুরিতার হাতে তুলে দিলেন মায়ের আশীর্বাদী। আমরা বার বার করে অনুরোধ
করাতেও উনি রাতে যেতে রাজি হলেন না। আমরাও আর জোরাজুরি না করে চলে এলাম কল্যাণ
পরিষদের মাঠে। দেখলাম যে গাড়িটা বুক করেছিলাম তিনি একদম ঘড়ির কাঁটা ধরে ওখানে
উপস্থিত। ড্রাইভার ভাইয়ের সাথে কথা বলে, গাড়িটা মাঠের ভিতরে পারকিং এর ব্যবস্থা
করে ঢুকতে যাব, হঠাৎ দেখি মাথা থেকে হেলমেট খুলতে খুলতে একজন বলছে “কিরে চোখ তুলে
তো দেখিস ও না!” অবাক হয়ে দেখলাম পার্থ – আমার ব্যাচমেট পার্থ মিত্র। ঘেরা জায়গার
ভিতরে চেয়ার টেনে বসলাম তিনজনে। একটু বাদেই একে একে এল বিমান, পোদ্দার এবং পার্থ।
তখন একেবারে তিন অর্জুনের সমাবেশ! পার্থ মিত্র উলিকটের ইনারের উপর একটা জ্যাকেট
চাপিয়েই চলে এসেছে। ওকে টিফিন খেতে বললাম কিন্ত ও বলল বাড়ি থেকে খেয়েই এসেছে, তবুও
একটা মিষ্টি খেয়ে আরও কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে চলে গেল। এর পরে এল আমার মেজ গিন্নী
বাবুই, হাতে ২৫ টি গোলাপের তোড়া (ওর ও ১৫ তম বিবাহ বার্ষিকী) তারপর শ্রবণা আর দীপা। তার আগেই মোবাইলে ছবি তোলা শুরু হয়ে গেছে এবং ফেসবুক আর WHAT’S APP এ পোস্ট হচ্ছে মজার মজার কমেন্ট সহ। সঙ্গীতা আর এল কিছু সময়
পরে। চলে এসেছেন আমার বড় কাকা – কাকিমা, দুই
খুড়তুতো বোন রিম্পা এবং রিমি আর আমাদের সকলের আদরের হিয়া মা (রিম্পার মেয়ে)। বড় কাকা, কাকিমা ঠিক ঠাক গুছিয়ে বসতে না বসতেই
চলে এলেন নতুন কাকা – কাকিমা (আমার মেজ কাকা)। আমাদের বন্ধুদের সাথে আলাপ করিয়ে
দিলাম সকলের। আমাদের আত্মীয়রা ক্লাব ঘরের দোতলা আর বন্ধুরা নিচে চেয়ার নিয়ে বসে
আড্ডা মারছে। এর মধ্যে ফোন, আমার বউদিভাই এবং তাঁর বৌমা গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেছে আমার
ফ্ল্যাট ছাড়িয়ে, তাঁদের আবার ফিরিয়ে আনা হল। এবার তো নরক গুলজার। কখনও এদিকে হা হা
হা তো কখন ও অন্যদিকে হো হো হো। একদিকে চলছে রান্না, অন্যদিকে ডেকোরেশন আর
ইলেকট্রিকের কাজ। এর মধ্যে দক্ষিণেশ্বর থেকে এসে পড়ল অদিতি। সুচরিতা কে ফোন করে
বললাম, অদিতি এসে গেল দক্ষিণেশ্বর থেকে আর তুই পাশের পাড়ার লোক হয়ে এখনও আসতে
পারলি না। দুপুর দেড়টা বাজতে না বাজতে
খাওয়ার তাড়া। নতুন কাকা – কাকিমা ফিরে যাবেন, রান্নার লোকদেরও ফ্রি করে দিতে হবে। সব খেতে বসিয়ে দেওয়া হল। তাও সব মিটতে মিটতে প্রায় পৌনে তিনটে। এর মধ্যে একটা
ছোট ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছিল, আমার অতিরিক্ত
টেনশনের কারণে, মিটেও গেল তা। বড় কাকা সহ অন্যান্যরা গেল আমার ফ্ল্যাটে। অদিতি আর
শ্রবণা বলল ওখানেই চেঞ্জ করে নেবে, বাকিরা গেল নিজেদের বাড়ি। বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ সুরিতা বেরিয়ে গেল সাজু
গুজু করতে। একটু বাদে আমিও ফ্ল্যাটে গিয়ে সকলের পিছনে তাড়া দিলাম। সবাইকে তৈরি করে
নিজে তৈরি হয়ে ফিরে এলাম ঘড়িতে তখন ৫ টা ৪৫ মিনিট। একটু বাদে পার্থর ফোন, গাড়ি পাঠাতে
হবে ম্যাডামকে আনার জন্য।
মিনিট
১০ পরে গাড়ি ফেরত এল। একি দেখছি! পিছনের সীটে যে বসে আছে সে কি সেই মেয়েটা, যার
সাথে এতদিন ঘর করেছি! এতো একদম অন্য মহিলা! একেবারে রাজেন্দ্রাণী! নিজেকে একটু এSMART ভাবছিলাম,
ইনি তো এক টুসকিতে আমাকে নেই করে দিলেন। ওকে দেখে সকলেই অবাক। এবার শুরু হল
নিমন্ত্রিতদের আসা। দুই শালী ও ভায়রা মিলে কেক অর্ডার দিয়েছিল জানতাম কিন্ত
বন্ধুদের মধ্যেও ফিস ফাস চলছে। বন্ধুদের মধ্যে যারা দেরী হবে বলেছিল তারাও অনেকে
চলে এসেছে। আমার BBD BAG
– II এর বন্ধুরাও (সিনিয়র
স্যাররাও) প্রায় সব চলে এসেছে (কাকলী বাদে)। হঠাৎ দেখি বিমান আর পোদ্দার মিলে কি সব ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে, চোখের পলকে
একটা টেবিল পাতা হল, চলে এল কেক! সেই সময় হয়তো সবচেয়ে বেশী প্রিয়জন উপস্থিত। কেক
কাটার পরেই বিমান আর পার্থ হাতে ধরিয়ে দিল মালা, মালা বদল করতে হবে।
লাজে রাঙা হল কনে বৌ গো
মালা বদল হবে এরাতে।
ও তোরা উলু দে রাঙা বর এলো যে
মাথায় টোপর দিয়ে চতুর্দোলাতে
মালা বদল হবে এ রাতে
আজি মালা বদল হবে এরাতে।
না আজ সুরিতা আর আমি দুজনের কেউই কনে বৌ বা রাঙা বর
নই, লাজে রাঙাও হই নি,
আমরা রাঙা হয়েছিলাম ভালোবাসায়,
আনন্দে! যে সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়
আমরা বন্ধনে জড়িয়েছিলাম, সেই সন্ধ্যা সুন্দর স্বর্ণালী হয়ে আমাদের জীবনে ২৫ বছর আগে আসে নি। সে সন্ধ্যা ছিল এক বাধ্য হওয়া সন্ধ্যা, আমাদের দুজনের জেদের কাছে আপস করা এক সন্ধ্যা। প্রথম মালা বদলের সময় আমরা যে আনন্দ পাব বলে ভেবেছিলাম, তার চেয়ে লক্ষ গুণ আনন্দ আমরা পেলাম আমাদের ২৫ তম বিবাহ বার্ষিকীতে।
আমরা বন্ধনে জড়িয়েছিলাম, সেই সন্ধ্যা সুন্দর স্বর্ণালী হয়ে আমাদের জীবনে ২৫ বছর আগে আসে নি। সে সন্ধ্যা ছিল এক বাধ্য হওয়া সন্ধ্যা, আমাদের দুজনের জেদের কাছে আপস করা এক সন্ধ্যা। প্রথম মালা বদলের সময় আমরা যে আনন্দ পাব বলে ভেবেছিলাম, তার চেয়ে লক্ষ গুণ আনন্দ আমরা পেলাম আমাদের ২৫ তম বিবাহ বার্ষিকীতে।
এক বার নয়, তিন তিন বার মালা বদল করতে হল। শুধু তাই নয় “সিঁদুর” যতই পরাধীনতার প্রতীক হোক না কেন, মালা হোক
শৃঙ্খলের,কবি লিখে গেছেন
এ গান যেখানে সত্য
অনন্ত গোধুলিলগ্নে
সেইখানে
বহি চলে ধলেশ্বরী,
তীরে তমালের ঘন ছায়া—
আঙিনাতে
যে আছে অপেক্ষা ক’রে, তার
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর॥
তাই তাকে “নতুন করে পাব বলে” পরিয়ে দিলাম _ _ _ _
কত হাসি, কত কত কথা, কত গান বেজে ওঠে – কত ক্যামেরার চোখ পরে আমাদের
পরে
মনে হয় স্বপ্ন দেখছি না তো
এই দিনটাকে কল্পনা করেছিলাম যখন আমরা গেয়েছিলাম
“কে প্রথম কাছে এসেছি কে প্রথম চেয়ে দেখেছি
কিছুতেই পাই না ভেবে কে প্রথম ভালবেসেছি
তুমি না অমি
ডেকেছি কে আগে কে দিয়েছে সাড়া
কার অনুরাগে কে গো দিশাহারা
কে প্রথম মন জাগানো সুখে হেসেছি
তুমি না অমি
কে প্রথম কথা দিয়েছি
দুজনার এ দুটি হৃদয় একাকার করে নিয়েছি
শুরু হল কবে এত চাওয়া পাওয়া
একই অনুভবে একই গান গাওয়া
কে প্রথম মন হারানোর স্রোতে ভেসেছি
তুমি না আমি”
কিছুতেই পাই না ভেবে কে প্রথম ভালবেসেছি
তুমি না অমি
ডেকেছি কে আগে কে দিয়েছে সাড়া
কার অনুরাগে কে গো দিশাহারা
কে প্রথম মন জাগানো সুখে হেসেছি
তুমি না অমি
কে প্রথম কথা দিয়েছি
দুজনার এ দুটি হৃদয় একাকার করে নিয়েছি
শুরু হল কবে এত চাওয়া পাওয়া
একই অনুভবে একই গান গাওয়া
কে প্রথম মন হারানোর স্রোতে ভেসেছি
তুমি না আমি”
২৫ বছর পরে তা দেখলাম নিজেদের জীবনে
পূর্ণ হল সে গান!
তারপর! তারপর হারিয়ে গেলাম মানুষের মাঝে! ভয় ছিল সকলকে ঠিক ঠাক আপ্যায়ন করতে পারব তো? দেখলাম সকলেই কেমন ভাবে
যেন নিজেরাই নিজেদের আপ্যায়িত করে নিচ্ছেন।
কেক
কাটা এবং মালা বদলের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে কি হয় নি, চলে এলেন লপিতাদি সাথে দাদা।
একমাত্র শিক্ষক যিনি উপস্থিত হয়েছিলেন আমাদের আশীর্বাদ করতে (লপিতাদি এমন এক মানুষ
তাঁকে নিয়ে আলাদা করে লিখতে হবে) তাঁদের আশীর্বাদে পূর্ণ হলাম আমরা। অনেক আগে চলে
এসেছে ভুটান দা সাথে ঈশিতা, খারাপ লাগল পুঁচকে টার পরীক্ষা তাই সে আসতে পারে নি।
ভুটানদা, তার তুলনা বোধ হয় সে নিজেই। নিজের দিকে নজর নেই, সব মানুষের পাশে দাঁড়ানো
যেন তার জীবনের একমাত্র ব্রত।
কত
মানুষ এসেছেন –কার নাম লিখতে গিয়ে কার নাম লিখব? ভয় হয় যদি কারো নাম বাদ পড়ে যায়। তাই
আলাদা করে আর কারো নাম লিখছি না।
চলে
এসেছে বিবেক ভারতী শিশু শিক্ষা সদনের এবং হরিমতী গার্লসের বন্ধুরা, যারা বেশীর ভাগ
আমাদের কমন ফ্রেন্ড। হরিমতীর বন্ধুরা তো আরও আপ্লুত কারণ তারা তাদের লপিতাদির দেখা পেয়েছে।
এ
তো আমাদের ২৫ বছরের বিবাহবার্ষিকী নয়, এ যেন এক মিলন মেলা। দুই বান্ধবী একে অন্যের
WORST
HALF কে পরিচয় করিয়ে দিল, দেখা গেল তারা
দুজনে একই কলেজের ছাত্র। ব্যস্ এবার দুজনে জমে গেল আড্ডায়। এক বান্ধবীর ছেলে আর
মেয়ের সাথে অন্য এক বান্ধবীর মেয়ের ভাব হয়ে গেল, তিন জনে গল্প কথা, সেলফি তোলা,
মায়ের বন্ধুদের ফটো তোলা – এই সবে মেতে উঠল। এক বন্ধুর বৌ বলে উঠল, তোমরা এই রকম
ভাবে প্রতি মাসে একবার আড্ডা মার না কেন? এবার ওদের সকলকে আমাদের বাড়িতে ডাক! কে
বলবে এদের বেশীর ভাগ মানুষ, এর আগে একে অন্যকে চিনত না।
শেষ
হয়ে হয় নাকো শেষ। শেষের স্বাদ বড় মিষ্টি। তারক দা আগেই এসেছিল, এবার দেখলাম
নন্দনকে। সাথে মৌমিতা, সুধীরদা আর মৌমিতার ভাই এবং আমাদের মৌলী। নন্দন আসাতে এই
অনুষ্ঠান একদম পূর্ণ হয়ে উঠল। এল কল্যাণ, দোলা এবং ওদের পুঁচকে টা। সুদীপ্ত এবং
ঋজু এল সব শেষে। ২৫ বছর আগের এই দিনটায় আমার ও সুরিতার যে দুজন বন্ধু আমাদের পাশে
ছিল তার মধ্যে সবচেয়ে কাছের ছিল নন্দন ও দীপান্বিতা। দীপা তো সকাল থেকেই ছিল,
নন্দন আসাতে এই অনুষ্ঠান প্রায় সম্পূর্ণ হল। শুধু তরুণ দা থাকল অনুপস্থিত। তরুণ দা
– তরুণ মুখোপাধ্যায়। আমার নিজের দাদা র চেয়েও বড়! তরুণ দা আমার FRIEND – PHILOSOPHER AND GUIDE. জীবনের সমস্ত বিপদের মুহূর্তে – দুঃখের মুহূর্তে – সংকটের
মুহূর্তে এই মানুষটা “মধুসূদন দাদা” হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই অনুষ্ঠানে
তরুণ দার না থাকতে পারা, আমাদের কাছে বড় দুঃখের।
কত
সুন্দর মুহূর্ত তৈরি হল, কত হাসি – কত গান, এ কলমে তা লিখব কি করে? সব মুহূর্তের
সাক্ষী তো এই কলমচি নয়। সে শুধু দেখল আর সাক্ষী থাকল তাদের স্বপ্নের সত্যি হয়ে ওঠা
এক সন্ধ্যার। তারা দুজনে চেয়েছিল, তাদের বিয়েতে ডাকবে তাদের স্কুল – কলেজের
বন্ধুদের, হই হই করবে, মেতে উঠবে আনন্দে, সেদিন তাদের সে চাওয়া পূর্ণ হয় নি।
সুরিতা চেয়েছিল জীবনে একবার সিংহাসনে বসবে (বিয়ে এবং বৌভাতে যেমন অন্য মেয়েরা বসে)
তার সে চাওয়া পূর্ণ হয় নি। নিজের পছন্দ মত শাড়িও সে তার নিজের বিয়েতে পরতে পারে
নি।
“কোথায়
স্বর্গ কোথায় নরক
কে
বলে তা বহুদূর
মানুষের
মাঝে স্বর্গ নরক
মানুষেতেই
সুরাসুর”
“শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে
জয়লোভে যশোলোভে রাজ্যলোভে, অয়ি,
বীরের সদ্গতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই”।
এ কামনা করার অধিকার তারা তাদের নিজেদের কর্ম গুণে হারিয়েছে।
আমি
সুরিতাকে বলেছিলাম, তোমার যে যে চাওয়া সেদিন অপূর্ণ থেকে গেছিল, তুমি মন খুলে
আমাকে বলবে, এই দিনে তোমার সব চাওয়া আমি পূর্ণ করে দেব, তাতে আমার পায়ের নখ থেকে
মাথার চুল পর্যন্ত যদি ধারে ডুবে যায় – যাবে। অন্য কোন মেয়ে হলে কি চাইত আমি জানি
না, ও কিচ্ছু চায় নি। বিভিন্ন সময় ওর কথা থেকে আমি যা যা জানতে পেরেছিলাম, আমি ওকে
তাই দিয়েছি – দিয়েছি কি! আসলে আমি ওর কাছ থেকে যা পেয়েছি, তাতে এ দেওয়া কিছুই নয়।
আসলে আমাদের মধ্যে কোন দেনা – পাওনার সম্পর্ক নেই, আছে পরস্পরের প্রতি অকৃত্রিম
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
সময়
পার হয়ে গেল। ঘড়ি বলছে রাত ১২ টা ১৫ অর্থাৎ ইংরাজি মতে ১৮/০১/২০১৯। আমরা বাড়িতে।
চোখে ঘুম নেই, দুজনেই বিভোর গল্প কথায়! হাসি আর গানে, কথায় ও সুরে সময় কেটে গেল।
অবশেষে ঘুম নামে চোখে। এক সুন্দর দিন হল শেষ।
গাহিবে একজন খুলিয়া গলা, আরেক জন গাবে মনে।
তটের বুকে লাগে জলের ঢেউ তবে সে কলতান উঠে,
বাতাসে বনসভা শিহরি কাঁপে তবে সে মর্মর ফুটে।
জগতে যেথা যত রয়েছে ধ্বনি যুগল মিলিয়াছে আগে--
যেখানে প্রেম নাই, বোবার সভা, সেখানে গান নাহি জাগে”।
ঠিক তাই! একা গান গাওয়া যায় না। যাঁরা আমাদের এই মিলন মেলায় এসেছিলেন তাঁরা যদি না আসতেন, এই লেখা লিখতে পারতাম কি?
সলতে পাকানো থেকে প্রদীপ জ্বালানো পর্যন্ত যাঁরা পাশে ছিলেন, তাঁরা না থাকলে এই অনুষ্ঠান সুন্দর হত কি? সফল হত কি ?
কি বল বাবুই – কুন্তল – মিতে – শান্ত – সোনা মা আর কুট্টুস?
কি বলে আমার দুই কাকা – কাকিমা, রিম্পা – রিমি, হিয়া মা আর দেবার্ঘ্য?
দাদাভাই – বউদিভাই – পুম্পল – রিমি – বুয়াদা – জয় কি বলিস তোরা?
মল্লিক সাহেব, দাস সাহেব, সজল , কাকলী সহ BBD BAG II – এঁরা কি বলেন?
কি বলে আমার বিবেক ভারতীর বন্ধুরা? কি বলে হরিমতীর বন্ধুরা?
বিমান – বাড়িতে প্রত্যেকে অসুস্থ। ওর নিজের গায়ে জ্বর! সারাদিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেল! আমি আর সুরিতা ওর কে? আমাদের পরিচয় আমরা ওর বন্ধু!
অদিতি – নিজে ভালোভাবে হাঁটতে পারে না, দাঁড়ালে বসতে কষ্ট হয়, বসলে দাঁড়াতে কষ্ট হয়, দক্ষিণেশ্বর থেকে চলে এল – সারা দিন থাকল! আমরা কে ওর? বন্ধু।
পার্থ – সব সময় বুদ্ধি – পরামর্শ নিয়ে পাশে, ওর স্ত্রী বর্ণালী সাজিয়ে দিল সুরিতা কে – কেন? আমরা ওদের বন্ধু!
সুমিতা – ওর বর (নাকি সমস্ত বরের মত বর্বর – মানে আমরা তো worst HALF তাই) ববি – ভুবনেশ্বর থেকে চলে এল। কেন? এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবে বলে। আমাদের সাথে ওদের সম্পর্ক কি? বন্ধু! কাকে ছেড়ে কার কথা বলব!
সুদুর সুরাট থেকে হাবু (দিব্যেন্দু) সারা দিনে তিনবার ভিডিও কল করল। কি জন্য? এটাই হচ্ছে ভালোবাসা – নিখাদ বন্ধুত্ব।
(দুঃখিত সোমা – তোকে এই তালিকায় রাখতে পারলাম না কারণ তুই নিজেও জানিস চেষ্টা করলে ৫ মিনিটের জন্য হলেও তুই এসে একবার দেখা করে যেতে পারতিস। তোর বাড়ি থেকে অনুষ্ঠান এর জায়গায় যেতে এরোপ্লেন, ট্রেন, ট্রাম, বাস, ওলা, উবের কিচ্ছু লাগে না, লাগে মনের ইচ্ছে। পোদ্দার, দীপা, শ্রবণা, সুচরিতা, সঙ্গীতা,মলি, রিন্টু, দেবী, শুভ, গৌতম, দেবাশিস, সব্য সব্বাই এল। অনি, কৌশিক আসতে পারে নি তার যথেষ্ট কারণ ছিল। আশিস কেন আসে নি, জানি না তবে কোন লেম এক্সকিউজ দেয় নি, যেটা তুই দিয়েছিস। তোর খারাপ লাগতে পারে, যে আমি ওপেন এই কথা গুলো লিখলাম কিন্ত এটাই আমি। সোজা কথা, মুখের উপর সোজা ভাবে বলি। আমাদের খারাপ লেগেছে কারণ আমরা জানি আমাদের নিমন্ত্রণে কোন ত্রুটি ছিল না।)
ও আর একজনের কথা না বললে তো এ লেখা শেষ হতেই পারে না। LAST BUT NOT THE LEAST বলতেও পারব না – কি বলব তাই বুঝতে পারছি না
শিশির দা (FRIENDS CATERER) – আজ তার সাথেও আমাদের সম্পর্কের ২৫ বছর পূর্ণ হল। আমাদের বিয়ের দিনেও শিশির দাই ছিলেন খাওয়া – দাওয়ার দায়িত্বে এবং আজকেও তাই।
তাই শিশির দার কথার মাধ্যমেই মধুরেণ সমাপয়েৎ।
সব শেষে বলি সকলের ভালোবাসা এবং অংশগ্রহণে আমরা পূর্ণ হলাম –
আমরা আমাদের মাথা নত করে আবার তোমাদের প্রণতি জানাই! জীবন সায়াহ্নে এসে এই উপহার পাব এ আমরা কল্পনাও করি নি।
মূল লেখার মধ্যে সোমার কথা অন্য ভাবে লিখেছিলাম এক ভীষণ অভিমানে। গতকাল সেই অভিমান মুছে গেল। মুছিয়ে দিল সোমা নিজেই। কাল সন্ধ্যা বেলা দীপার সাথে এসে দেখা করে গেল আর বলল সেদিন ও সত্যিই ব্যস্ত ছিল, ওর ভীষণ খারাপ লেগেছিল সেই জন্য ও ফোন করতে পারে নি। আমাদের আর কোন অভিমান রইল না। এটাই বন্ধুত্ব! কালকে সোমার আসায় আমার এ অনুষ্ঠান সত্যিকারের পূর্ণতা পেল।
No comments:
Post a Comment