অবশেষে শুরু। আশা করি কাল গ্যাস সংযোগ পেয়ে যাব এবং গ্যাংটক পরবাস পর্ব সম্পূর্ণ ভাবে শুরু হবে।জীবন যে এক ভাঙ্গা – গড়ার খেলা তা কত সুন্দর ভাবে বুঝেছি আমরা। ভেঙ্গেছি আর গড়েছি আবার দিয়েছি ভেঙে।
নিজেদের প্রথম স্বাধীন সংসার গড়ে উঠল ১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে বোলপুরের কাছারিপট্টির বাড়িতে। সে সংসার ভেঙে দিয়ে নতুন সংসার গড়া সিয়ান আবাসনের টাইপ ৩ এর ১৭ নম্বরে, যার স্থায়িত্ব মাত্র ৩ টি মাস। তারপর টাইপ ২ এর ২২ নাম্বার। সুখে – দুঃখে সে সংসার চলল ২০০১ এর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। ২০০১ এর ফেব্রুয়ারি পরবর্তী ৩ টে মাস কেটে গেল আর / ১১৭ তে। এবার ৭৪ নম্বর আর কে নগর। ভাবলাম এই বুঝি শেষ। তা কি হয়? পথ বেঁধে দিল বন্ধন হীন গ্রন্থী / আমরা দুজনে চলতি হাওয়ার পন্থী। ফলে সযতনে গড়া সে সংসার ভেঙে চিরকালের জন্য ওই বাড়ি ছেড়ে ভেসে পড়লাম নীল সমুদ্রে। কালাপানি পার হয়ে তাল – তমাল, নীল আকাশ আর সমুদ্র যেখানে এক হয়ে যায় সেই পোর্ট ব্লেয়ারে বাঁধলাম জীবন তরণী। সে ঘাটে থাকলাম বাঁধা ২০০৫ এর মে মাস পর্যন্ত। আবার ভাঙ্গা, এবার ফেরা আর / ১১৭ তে। মনে ইচ্ছা ছিল এমন একটা বাসা গড়ি যে বাসা গড়ে উঠবে আমাদের দুজনের ভালোবাসা। যেখান থেকে কেউ আমাদের বের করে দেওয়ার সাহস করবে না।
স্বপ্ন সফল হল ২০০৬ এর জুলাই মাসে। নিজেদের ভালোবাসা দিয়ে গড়া সে বাসার নাম দিলাম “ভালোবাসা”। পায়ে যাদের সর্ষে, খেলছে যারা ভাঙ্গা – গড়ার খেলা, তারা তো স্থির থাকতে পারে না। তাই ভালো বাসা টি ছেড়ে ২০০৭ এর জুনে পাড়ি রানাঘাট, নিজেদের জীবনের সবচেয়ে অন্ধকারের কাল কাটাতে। ২০০৮ সালের নভেম্বরে আবার ফেরা নিজেদের ভালোবাসায়। ১০ বছর কাটানোর পর এবার পাড়ি গ্যাংটকে।
আসলে ভাঙ্গা – গড়ার খেলা খেলতে এত বেশী অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে ভাঙতে গিয়ে গড়ি আবার গড়তে গিয়ে ভেঙে ফেলি সব। জীবন নাটকের মঞ্চে বয়ে চলেছে আমাদের এই ভাঙ্গা – গড়ার খেলা। জানি, যেদিন শেষ হাসি হেসে উইংসের অন্ধকারে হারিয়ে যাব আমরা দুজনে সেদিন শেষ হবে এই ভাঙ্গা – গড়ার খেলা। তার আগে পর্যন্ত
চলতে থাকুক – চলতে থাকুক – চরৈবেতি - চরৈবেতি
পরবাসী জীবনের কথকতা।
অবশেষে গ্যাংটক বাস (অথবা প্রবাস) নিশ্চিত হল। গত ১৪ দিনে শহর টার সাথে প্রাথমিক পরিচয় সম্পন্ন। এখানকার বাজার, জিনিসপত্রের দাম, ইত্যাদি সম্পর্কেও প্রাথমিক পরিচয় সম্পন্ন। এবার ভালো করে চেনা - জানার পালা। সেই প্রাথমিক পরিচয়ের ভিত্তিতে কটি কথাঃ
১) এখানকার মানুষ জন ভীষণ ডিসিপ্লিনড এবং এ কথা রাস্তায় চলা সমস্ত যান - বাহনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ওভারটেক, অকারণে হর্ন বাজানো, সিগন্যাল না মেনে রাস্তা পার হওয়া জাতীয় গুণ (যা কলকাতায় দেখে অভ্যস্ত) এখানে অমিল। ফলে একটা প্রাথমিক তফাত আছেই;
২) লাল বাজার যা এখানকার দৈনন্দিন জিনিসপত্রের সবচেয়ে বড় বাজার, সেখানে এত সাজানো যে আমার চোখে ধাক্কা লেগেছিল। একদিকে সবজি অন্যদিকে চাল - ডাল ইত্যাদি। ওপরের ফ্লোরে আছে জামা - কাপড় ও বাসন পত্র, তার উপরে এক অংশ জুড়ে রয়েছে টেলারিং শপ এবং আরও কিছু জামা - কাপড়ের দোকান। কোথাও কোন হই হল্লা নেই। ক্রেতা - বিক্রেতার মধ্যে অহেতুক দরাদরি নেই, দাদা / দিদি দেখে যান জাতীয় হাঁক ডাক অমিল। বিক্রেতা জানেন যে ক্রেতার যে জিনিসের প্রয়োজন তিনি তার কাছেই যাবেন এবং বাজারে প্রতিটি জিনিসের দাম নির্দিষ্ট। একজনের কাছে যে দামে যে জিনিস পাবেন গোটা বাজারে সেই কোয়ালিটির জিনিস আপনি একই দামে পাবেন। সবজি এবং মুদি বাজারের থেকে মাছ - মাংস (মাটন, চিকেন, বিফ, পর্ক) এর দোকান সম্পূর্ণ আলাদা বাড়িতে এবং বেশ তফাতে;
৩) এখানকার মানুষ উর্দি ধারীদের একটা আলাদা সম্মানের চোখে দেখে;
৪) এখানে কাজের জায়গায় সিনিয়র অফিসারদের আলাদা দৃষ্টি তে দেখা হয় এবং তাঁরা আলাদা সম্মান পান যেটা পশ্চিমবঙ্গে অমিল আবার অফিস টাইমের পরে আর সিনিয়র - জুনিয়র ভেদ থাকে না, সেখানে সবাই সাধারণ মানুষ;
৫) যেটা সবচেয়ে খারাপ লেগেছে তা হল ভূমিকম্প প্রবণ এ অঞ্চলে অবাধে বহুতল বাড়ি বানিয়ে চলা হচ্ছে। আসার আগে একটা আলাদা ধারণা ছিল। নিশ্চিত ছিলাম যে এখানে কটেজ ধরনের কাঠের বাড়ির সংখ্যা বেশী থাকবে কিন্ত এ শহরের পথে যতটা পথ চলেছি তাতে একটাও কাঠের বাড়ি বা কটেজ দেখতে পাই নি।
আপাতত এইটুকু থাক।
পরবাসী জীবনের কথকতা। ২য় পর্ব
এ পর্বের শুরু এক অতৃপ্তি দিয়ে। এখানে কোন বাংলা বই পাওয়া যায় না। “মোতি মহল” বলে একটি দোকান আছে সেখানে বাংলা ম্যাগাজিন আর খবরের কাগজ পাওয়া যায়। কলকাতা ছাড়ার পর খাবার দাবার ছাড়া দুটো জিনিস কিনেছি ১) শারদীয়া আনন্দ মেলা এবং ২) শারদীয়া আনন্দলোক। একটা শিলিগুড়ি এবং দ্বিতীয় টা গ্যাংটক থেকে।
ধীরে ধীরে এখানকার জীবন যাত্রার সাথে অভ্যস্ত হচ্ছি। এখানকার ট্যাক্সি গুলোর মধ্যে একটা মজা আছে। না এরা পুরোপুরি হলুদ – কালো, না নীল -সাদা। এখানকার ট্যাক্সি গুলোর মজা এইটাই যে এই গাড়ি গুলোর কোন না কোন একটা জায়গায় হলুদ রং করা থাকে, সেটা ছাদ, বনেট বা পিছন যেখানেই হোক না কেন এবং নাম্বার প্লেট হলুদের উপর কালো রং দিয়ে লেখা।
সিকিম সরকার পরিবেশ রক্ষাকে প্রাধান্য দেয় তাই এখানকার সরকারী ভবন গুলোতে হালকা এবং গভীর সবুজ রং করা। অথচ রাস্তার ফুটপাথ বা রেলিং এ কিন্ত সেই রং নেই অর্থাৎ কিনা কোন বিশেষ মানুষের / ডিলারের স্বার্থ রক্ষার ঠিকাদারি সরকার মানে শাসক দল নিয়ে রাখে নি।
এম জি রোড মানে এখানকার ম্যালে ঘুরতে ঘুরতে একটা বিষয় নজরে এসেছে যে এখানকার মানুষ আইসক্রিম খেতে বড় ভালবাসে। রাস্তায় বা ম্যালে প্রতি ২৫ জনের মধ্যে ১ জনের হাতে আইসক্রিম থাকবেই।
এখানকার প্রায় প্রতিটি রেস্তোরাঁ র সাথে “বার” শব্দ যুক্ত আছে এমনকি না নিরামিষ (ভেজ) রেস্তোরাঁ হলেও তবু এখানে কোন মাতাল দেখি নি। আসলে পাহাড়ি রাস্তায় মাতলামো করলে “পপাত চ এর সাথে “মমার চ” হওয়া একদম স্বাভাবিক ঘটনা।
এই মাসের ২৪ তারিখে পোস্টিং অর্ডার বার হয়েছে এবং আমি ২৭ তারিখে অফিসে জয়েন করেছি। পরিস্থিতি বুঝে মনে হচ্ছে আমাকে ADMINISTRATIVE OFFICER এর দায়িত্ব নিতে হতে পারে। আগামী সোমবার সে বিষয়ে নিশ্চিত হব।
আমি এখানে থাকার মত একটা আস্তানা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম ঠিক ওই গানটির মত
“দো দিওয়ানে শহর মে
রাত মে ইয়া দো পহর মে
এক -----
এক আশিয়ানা ঢুঁড়তে হ্যায়
আমার কত বন্ধু এই “আশিয়ানা” খোঁজার জন্য আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আমার সাধ্য কি তাঁদের সকলের নাম বলি। তবুও একটু চেষ্টা করিঃ
সবার আগে নাম সুরিতার বান্ধবী তটিনীর বন্ধু (Worst Half, সুরিতার কাছে আমিও সেই পর্যায় ভুক্ত) দেবব্রত;
তারপর এলেন কমল রায় যিনি আমাকে আমারই ফেসবুক বন্ধু প্রণব গুহ ঠাকুরতার সাথে পরিচয় করালেন। প্রণব দা পরিচয় করালেন SBI ZERO POINT BRANCH OFFICER RINCHEN DORJI BHUTIA র সাথে। তিনি আমাকে একটি ফ্ল্যাট দেখালেন যার প্রতিমাসের ভাড়া ১৫০০০/- টাকা। ৩ টে ঘর সহযোগে রান্নাঘর এবং ইউরোপিয়ান স্টাইল টয়লেট এবং ল্যাট্রিন। সময় চেয়ে নিলাম।
তারপর কাল অফিসে যাচ্ছি হঠাৎ করে এক ম্যাডামের ফোন। সেই ম্যাডাম (আসলে চিংড়ি) একটি বিউটি পার্লারে কাজ করেন, যেখানে আমি দাড়ি ট্রিম করতে গেছিলাম। উনি আমাকে সিলাল নামক এক ম্যাডামের ফোন নাম্বার দিলেন। আজ সকালে সাড়ে আট টা নাগাদ ফোন করলাম। এক পুরুষ কণ্ঠের কথা, আপলোগ থোড়া জলদি আইয়ে কজ বহুত আদমি ফোন কর রহে হ্যায়
আমরা দুজন চটি জুতো গলিয়ে দৌড়। যাওয়ার সময় এতটাই ভিতরে বলে মনে হচ্ছিল যে আমি বলেই ফেললাম যে “এত দূরে আসব না”। পরবর্তী চমক, আমাদের যে ড্রয়িং রুমে বসতে দেওয়া হল, তাই দেখে আমার বেটার হাফ বলেই ফেলল “চল আমরা চলে যাই”। আমরা ওনার বাড়িতে ঢোকার পর যে ড্রয়িং রুমে আমাদের বসতে দেওয়া হল, তা দেখে আমরা আরও বেশী সঙ্কুচিত। তারপরে আমাদের ডেকে নেওয়া হল তার উপরের আর একটি ঘরে। একজন সাধারণ চেহারার মানুষ বসে আছেন একটি সোফায়। এরপরেই ঘটে গেল ম্যাজিক। যিনি আমাদের একটুও সময় দিতে পারবেন না বলেছিলেন, তিনি আমাদের সাথে গল্প করলেন প্রায় দু ঘণ্টার কাছাকাছি সময়। ভাড়ার কথা জিজ্ঞাসা করতে কেমন যেন দ্বিধা লাগছিল এবং তার সঙ্গে আমরা দু জন যে ঘরে থাকব তা কিরকম সেটা বুঝে নেওয়াও বাকি ছিল।
তারপরে যা হল তা বিশদে লিখব ৩য় পর্বে
অলমিতি
No comments:
Post a Comment