25 August, 2018

১৯৯১ সালের ১৫ ই জুলাই থেকে শুরু আমার কর্মজীবন (সরকারী কর্মচারী হিসাবে) সেন্ট্রাল এক্সাইজ অ্যান্ড ল্যান্ড কাস্টমস্‌ বিভাগে লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক পদে। বাবা তখন একই বিভাগে ইন্সপেক্টর। সেদিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কেটে গেছে ২৫ বছরের বেশী সময়। বলা যেতে পারে জীবনের অর্ধেকের বেশী সময় দিয়ে জড়িয়ে আছি এই বিভাগের সঙ্গে। তারই কিছু স্মৃতি তুলে আনতে চাইছি এই লেখার মধ্যে দিয়ে। এ লেখা উৎসর্গ করলাম আমার ব্যাচমেট, আমার সিনিয়র দাদা – দিদি, অফিসার এবং অন্যান্য প্রতিটি কর্মচারীকে, যারা ভালোবাসা দিয়ে, উপদেশ দিয়ে, শাসন করে আমাকে সাহায্য করেছেন, আমাকে এই বিভাগের কাজ কর্মের সাথে পরিচিত করিয়েছেন এবং এখনও করিয়ে চলেছেন সেই সব প্রতিটি মানুষকে। এ লেখা উৎসর্গ করলাম তাদেরও যাদের স্বার্থপর, দায় এড়িয়ে যাওয়া, জুনিয়রের উপর নিজের দায়িত্ব অন্যায় ভাবে চাপিয়ে দেওয়া সেই সব মানুষকেও যারা আমাকে তাদের মত মানুষদের সম্পর্কে সচেতন হতে সাহায্য করেছেন এবং এখনও করে চলেছেন। যে কোন দপ্তরে এই দুই শ্রেণীর মানুষ থাকেন, যাদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর মানুষেরা সংখ্যায় বেশী এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষরা সংখ্যায় কম।

আমাদের চাকরী বদলীর চাকরী। করণিক বা মিনিস্ট্রিয়াল পদে বদলী তুলনা মূলক ভাবে কম কারণ বিভাগে এই ধরনের পদের সংখ্যা কম। সেন্ট্রাল এক্সাইজ অ্যান্ড ল্যান্ড কাস্টমস্‌ (পরবর্তীতে যোগ হল সার্ভিস ট্যাক্স। বর্তমানে পুরো বিভাগের নাম CGST & CX) দপ্তর মূলত এক্সিকিউটিভ ওরিয়েন্টেড দপ্তর। এক্সিকিউটিভ পদের অফিসারদের সংখ্যা এবং মর্যাদা দুই ই বেশী। সম পদের মিনিস্ট্রিয়াল অফিসারের সাথে এক্সিকিউটিভ পদের বেতন বৈষম্য আজও বর্তমান। আমি নিজে মিনিস্ট্রিয়াল পদ থেকে প্রমোশনের মাধ্যমে এক্সিকিউটিভ হয়েছি, হয়েছে আমার মত অনেকেই তাই বোধ হয় এই বৈষম্য আমাদের অনেককেই পীড়া দেয়। যাই হোক, আসল প্রসঙ্গে আসি। যেহেতু এক্সিকিউটিভ অফিসারের সংখ্যা বেশী এবং তাঁদের এক বড় অংশকে ফিল্ড ফর্মেশনে কাজ করতে হয় সেই জন্যই এঁদের একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর বদলী করা হয়। প্রাথমিক ভাবে এটাই নিয়ম প্রতি ৪ বছর একটি জোনে, তার মধ্যে প্রতি ২ বছর এক একটি ইউনিটে। এছাড়া ল্যান্ড কাস্টমসে এবং অন্য কিছু বিশেষ জায়গায় বদলী হওয়ার জন্য আলাদা করে অপশন দিতে হয়। আর একটি নিয়ম আছে তা হল প্রতিটি গ্রেডেই একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর নন সি সি এ এলাকায় বদলী হতে হয়। মিনিস্ট্রিয়ালদের ক্ষেত্রে সময় সীমা ১ বছর (প্রতি দফা), ইন্সপেক্টরদের ২ বছর এবং সুপারিন্টেন্ডেন্টদের ক্ষেত্রে দেড় বছর। এত কথা লিখলাম, এই কারণে যে বিভাগীয় বন্ধুরা ছাড়া এ লেখা যারা পড়বেন তাঁদের আমাদের বদলী নীতি বুঝে নিতে সুবিধা হবে ।

সেন্ট্রাল এক্সাইজে আমার প্রথম পোস্টিং কলকাতা ১ কালেক্টরেটের (আজ যার পরিচয় কমিশনারেট নামে) অ্যাকাউন্টস ব্রাঞ্চে। ওখানে ছিলাম ৪ বছর। ১৯৯১ এর ২৩ শে জুলাই থেকে ১৯৯৪ সালের মে মাস পর্যন্ত। ১৯৯৪ এর জুন মাসে প্রথম বদলীর স্বাদ পেলাম। যেতে হল কলকাতা “বি” ডিভিশন যা তখন ব্যাম্বুভিলাতে। কলকাতা ১ এর অডিট ব্রাঞ্চ ছিল ব্যাম্বু ভিলাতে যেখানে প্রতি মাসে মাইনে দিতে যেতে হত এছাড়াও অ্যাসোসিয়েশন করার সুবাদে ওখানকার মানুষ জনের সাথে পরিচয় ছিলই তাই কোন অসুবিধা হয় নি। তবে অবশ্যই খারাপ লেগেছিল কারণ অ্যাকাউন্টসে থাকাকালীন তৎকালীন অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার শ্রী হরিসাধন নন্দী (আমার বাবার খুব ঘনিস্ট বন্ধু ছিলেন) র শাসন ও ভালবাসায় আমার কর্মজীবন বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছিল। আমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করতেন সেই সময়ের ডেপুটি অফিস সুপারিন্টেন্ডেন্ট শ্রী জোসেফ মিঞ্জ (এখন চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার), আপার ডিভিশন ক্লার্ক (পরে ইন্সপেক্টর) প্রয়াত সঞ্জিত মুখোপাধ্যায় প্রসঙ্গত আমাদের দুজনের জন্মদিন একই – ১১ই নভেম্বর) এবং শ্রী রঞ্জিত বিশ্বাস। এঁদের সকলের কাছে আমি চির ঋণী হয়ে আছি। আমার ট্র্যান্সফার হওয়ার আগেই সঞ্জিতদা প্রমোশন পেয়ে আপীল এ চলে গিয়েছিলেন তবু স্নেহের বন্ধন ছিল অটুট। হঠাৎ করেই বসন্তের দামাল বাতাসের মত সঞ্জিতদা হাজির, “শ্রীতোষ নাটক দেখতে যাবি?” হ্যাঁ বলার আগে সামনের কাগজপত্র গোছানো শুরু। ক্যাশিয়ার সমর দা (সমর চক্রবর্তী) জানতেন সেই সময় আমাকে দিয়ে কোন কাজ করানো যাবেই না। দুজনে মিলে বার হলাম, এলেন কল্যাণ দা ও মিঞ্জদা। বাসে ওঠার আগে জানি না কোন নাটক দেখতে যাচ্ছি এবং আমার পকেটে খুব বেশী হলে ১০ টাকা আছে। জিজ্ঞাসা করতে শুনলাম অ্যাকাডেমি চত্বরে তো যাই তারপর দেখা যাবে, যদি টিকিট না পাই, নিউ এম্পায়ার, লাইট হাউস বা গ্লোব তো আছেই। আর টাকা – টাকার কথা তোমাকে কে ভাবতে বলেছে? গেলাম। দেখা হল “টিকটিকি”। সেদিন ২য় শো। মুগ্ধ হয়েছিলাম সৌমিত্র এবং কৌশিকের অভিনয় দেখে। আর একটি মজার কথা পরদিন নন্দনে মুক্তি পাবে ধনুষ বা ওই জাতীয় নামের কোন একটি সিনেমা। ওঁদের কাছ থেকেই টাকা নিয়ে সে সিনেমার টিকিট কাটলাম। এমনকি আমার বিয়ের পিছনেও এই তিন জনের কিছু অবদান ছিল। ফলে এদের ছেড়ে চলে যেতে মনে কষ্ট তো হয়েইছিল।

এল “বি” ডিভিশন। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার শ্রী বরুণ ঘোষ (বর্তমানে প্রয়াত)। আমি ক্যাশিয়ার। ভালো ভাবেই কাজ চলছিল। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল চঞ্চল (এখন ইন্সপেক্টর)। ১ বছর পরেই বদলী, এবার নন সিসি এর পালা। ততদিনে নিজের বাড়ির পরিবেশ অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। ছুটির দিন গুলোতে আরও বেশী। মনে পড়ে তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও আমি ও আমার স্ত্রী ছাতা হাতে বাইরে বার হয়ে পড়তাম (সৌজন্য আমার মা। মা ই বটে! জীবনে অনেক মায়ের কথা শুনেছি এবং অনেক মাকে দেখেছি এই রকম এক জনকেও চোখে পড়ে নি – এমনকি বাংলা সিরিয়ালের অসাধারণ মহিলা ভিলেন দের মধ্যেও না) ফলে এই বদলী ছিল আমার কাছে আশীর্বাদ। জুন মাসের ১ তারিখ যোগ দিলাম বোলপুরে। বাড়ি খুঁজে নিতে একটা মাস দেরী হয়েছিল, ওই সময় আমার নিজের বাড়ির পরিস্থিতির সাথে নরকের কোন ফারাক ছিল বলে আমার মনে হয় না। ঠিক ১ মাস বাদে ১লা জুলাই মুক্তি পেলাম, জিনিসপত্র নিয়ে বার হচ্ছি, দেখলাম নিচের তলা ভাড়া দেওয়া হবে বলে লোক ঢুকছে। বাড়ির বড় ছেলে বার হয়ে যাচ্ছে মায়ের মনে কোন কষ্ট নেই বরং আনন্দ, উপরি রোজগারের রাস্তা খুলে গেল।
বোলপুরে পোস্টিং ১ বছরের – থাকলাম ৫ বছর। আমার চাকরী জীবনের অন্যতম সেরা সময় এই ৫ বছর। প্রথম বছর খুব কষ্ট করতে হয়েছিল। যে বাড়িতে ছিলাম, সে বাড়িতে জলের কোন লাইন ছিল না, রাস্তার কল থেকে প্রয়োজনীয় জল আনতে হত, কাচাকাচি রাস্তার কলে। দুজনের কেউ ই এ অভ্যাসে অভ্যস্ত ছিলাম না। প্রথম ৬ মাস গ্যাস ছিল না, স্টোভের আগুনে রান্না। মাইনে গেছে কমে। তবু মনে আনন্দ ছিল, দুজনে একটু বসে গল্প করলে কেউ দাঁত খিঁচাবে না, বাইরে ঘুরতে বেরিয়ে দেরী হলে গালাগালি খেতে হবে না, ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরী হলে দরজায় দুম দাম ধাক্কা পড়বে না। আর ছিলেন রায়দা। শ্রী দিলীপ রায় (জানি না আজ বেঁচে আছেন কিনা)। অকৃতদার মানুষটি বাবার মত – বড় দাদার মত আমাদের দুজনকে আগলে রেখেছিলেন। রায়দার কাছ থেকে দুজনে অনেক কিছু শিখেছি। এক সময় দণ্ডকারন্য প্রজেক্টে ছিলেন। সেই সময়ের গল্প শুনেছি অনেক। আরও একটি কথা, আমার বদলী হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা থেকে আমার ব্যাচমেট এবং আরও কিছু ঘনিস্ট মানুষ বোলপুরে বদলী হন, ফলে মনেই হয় নি কলকাতার বাইরে আছি। ১ বছর ভাড়া বাড়িতে থাকার পর সিয়ানে অফিস আবাসন। এত সুন্দর এ সময় কেটেছিল ভাবা যায় না। আবাসনে দুর্গা পুজো হত না কারণ বেশীর ভাগ আবাসিক বাড়ি চলে যেত। হত কালী পুজো আর সরস্বতী পুজো। কত হইচই – মজা আনন্দ! আর ছিল বিশ্ব কর্মা পুজো। আজও চোখ বুজলেই দেখতে পাই আবাসনের ভিতরের মাঠটায় সার দিয়ে টু হুইলার দাঁড় করানো (আমারটা বাদে)। মজার কথা, এ পুজোর সেক্রেটারি ছিলেন আমাদের সানা দা – সানাউল্লা খান। সেদিন অফিসের ড্রাইভার অ্যাসোসিয়েশন ব্যবস্থা করত খিচুড়ি খাওয়ানোর। সব্বাই মিলে পাশাপাশি বসে তৃপ্তি করে খেতাম। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটত কালী পুজো এবং সরস্বতী পুজোতেও। সরস্বতী পুজোতে অতিরিক্ত পাওনা ছিল নাটক। আবাসনের বাচ্চাদের দিয়ে নাটক করানো হত। একবার শ্রী গৌতম দে প্রস্তাব দিলেন নিজেরাই মণ্ডপ বানাব। সে বারের আনন্দ শুধু আমরাই জানি। আবাসনের প্রতিটি সক্ষম লোক এই কাজে অংশ গ্রহণ করেছিল। যে যেমন ভাবে পেরেছে সাহায্য করেছে। কেউ বানিয়েছে ছাদ, একটা বড় দল শর গাছ চেঁছে কাণ্ড বের করে দিয়েছে। কেউ দায়িত্ব নিয়েছে বেড়া বাঁধার। এরকম অজস্র ঘটনার স্মৃতিতে ভরপুর আমার বোলপুর প্রবাস। আলাদা করে পৌষ মেলা আর বসন্ত উৎসবের কথা বললাম না কারণ ওই দুটো অনুষ্ঠান ছাড়া বোলপুর সম্পূর্ণ নয়।

বাবার একান্ত অনুরোধে ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে বোলপুর থেকে বদলী নিলাম এই শর্তে যে সাংসারিক শান্তি বজায় রাখার প্রয়োজনে (বিশেষত আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে আমার মাতৃদেবীর অপ্রয়োজনীয় প্রবেশ আটকাতে) প্রতিদিনকার জীবনে আমরা একে অন্যের পাশে থাকলেও একে অন্যের জীবনে প্রবেশ করব না এবং তার প্রথম অংশ হিসাবে থাকব দুটো আলাদা ফ্লোরে এবং রান্নাঘর হবে আলাদা। অফিসিয়াল পোস্টিং কনফিডেন্সিয়াল ইউনিট, কলকাতা ১। ২০০২ সালে প্রমোশন পেয়ে হলাম ইন্সপেক্টর।
এরপর পরবর্তী পর্বে।

No comments:

Post a Comment