25 August, 2018

কর্ম জীবনের চলছবি - দ্বিতীয় পর্ব


২০০২ এর ডিসেম্বর মাসে প্রমোশন পাওয়ার পর ২০০৩ এর এপ্রিল মাস পর্যন্ত পুরনো জায়গাতেই থাকলাম। মে মাসে যোগ দিলাম হলদিয়া কমিশনারেটে। পোস্টিং হল স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইউনিটে। যোগ – বিয়োগ – গুণ – ভাগ – শতাংশ – ব্যাক ক্যালকুলেশন (মানে পাটি গণিতের পাটি চিবিয়ে) নিয়ে চলতে লাগল দিন – মাস – বছর। প্রসঙ্গত যাঁরা আমাকে ছোট বেলা থেকে চেনেন তাঁরা (এবং আরও কিছু একান্ত ঘনিষ্ঠ মানুষ) জানেন যে অংক চিরকালই আমার কাছে আতঙ্ক। আমার সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ইতিহাস এবং সাহিত্য। তবু আমার জীবন তরণী বয়ে চলেছে অংক নদীর পথে। ২৭ বছরের চাকরী জীবনে ১৯৯৮ – ২০০৩ এর এপ্রিল এই সময় বাদ দিলে প্রতিটি পোস্টিং এমন জায়গায় হয়েছে যেখানে অংক বাদ দিয়ে কাজ করা যায় না। জানি বাকি দিন গুলোও এই ভাবেই কাটবে। আমার জীবনের সবচেয়ে মজার বিষয় হল এইটাই। যখনি চিন্তা করি তখনি হাসি পায়। আবার এক দিক থেকে করলে মানুষের জীবন তো অঙ্কের মধ্যেই চলে। এক অন্য অঙ্ক। জীবন নাটকের এক অভিনেতা আমি, একটি উইংস দিয়ে ঢুকেছি – অন্য একটি উইংস দিয়ে বার হয়ে চলে যাব। মঞ্চে যে চরিত্র হয়ে ঢুকেছি, বিভিন্ন অঙ্কে সেই চরিত্রের অভিনয় করে যাব। দর্শক জানে না আমি আগে কোথায় ছিলাম – জানে না কোথায় যাব। অভিনয় যদি ভালো করতে পারি তবে হয়তো কিছু দর্শক কিছু দিন চরিত্রটাকে মনে রাখবে। নচেৎ নয়।

২০০৪ সালে একটা সুযোগ এল রেঞ্জ লেভেলে কাজ করার তবে যেতে হবে পোর্ট ব্লেয়ার। ভাবলাম রথ দেখা – কলা বেচা দুই ই হবে। ১ বছরের পোস্টিং। ওখানে যারা পোস্টিং তাদের সাথে কথা বলে জানলাম, যে শুধু মাত্র জামা কাপড় আর বিছানার চাদর – বালিশ নিয়ে গেলেই হবে, আর নিয়ে যেতে হবে আমার এম ৮০। ভালোই হল। তবুও ফাইনাল করার আগে একবার বাবা – মার সাথে কথা বলে অনুমতি নেওয়া উচিত বলে মনে হল। ফোনে কথা বলে অনুমতি নিয়ে নিলাম এবং নিয়ম মত অর্ডার বার হয়ে গেল। এবার যাওয়ার পালা। স্বাভাবিক ভাবেই বেশীর ভাগ জিনিস পত্র যেহেতু বাড়িতেই থাকবে এবং বাড়ির বাকি দুজন সদস্যের মধ্যে একজন ৭০ এর কাছে – অন্যজন ৬০, তাই নিজের জিনিস পত্র একটি ঘরে এবং রান্নার বাসন পত্র, গ্যাস ওভেন রান্না ঘরে রেখে এই দুটো ঘর কে তালাবন্ধ করে রাখাটাই বাস্তব সিদ্ধান্ত। সেই ভাবেই ঠিক হল। না ঠিক থাকল না বেশী দিন, আদেশ হল সব ঘর খোলা রেখে যেতে হবে, সমস্ত ঘরে (অর্থাৎ আমাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আমাদের অবর্তমানে অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবে, আমাদের শোয়ার খাটে আমাদের অনুমতি ছাড়া যে কেউ শুতে পারবে, টি ভি – সাউন্ড সিস্টেম ইত্যাদি যা যা ব্যবহারিক জিনিস পত্র অবলীলায় ব্যবহার করতে পারবে। এর জন্য সেই সব জিনিসের কোন ক্ষতি হলে? হতেই পারে। কোন সুস্থ – স্বাভাবিক – ভদ্র মানুষ এই দাবী মেনে নিতে পারে বলে আমার মনে হয় না। ফলত পরিষ্কার জানিয়ে দিলাম এই শর্ত আমি মানব না। তাহলে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। আমি বলে দিলাম দরকার হলে বাড়ি ছেড়েই চলে যাব কিন্ত একটা কথা আজকেই বলে দিলাম, এবার বাড়ি ছাড়লে ওই দরজা দিয়ে জীবনে প্রবেশ করব না। তোমাদের বয়স হচ্ছে, বুঝে সিদ্ধান্ত নাও। দু – চারদিন পরে একদিন দুজনে একটু রাত করে বাড়ি ফিরেছি – শুনলাম পরামর্শ দেওয়া – নানা উসকানো হচ্ছে যে বাবা যেন বলেন যে তিনি আমার কোন কথা শুনবেন না (আসলে আমার বাবা আমার প্রতি যথেষ্ট স্নেহশীল ছিলেন)। আমি সুরিতাকে বললাম – তৈরি থাক, সারা জীবনের মত এ বাড়ি ছাড়তে হবে। পরের দিন সকালেই বাবা ডেকে আমার জানা কথা গুলো বললেন (একদম আমার মায়ের শব্দ গুলো গুণে গুণে ব্যবহার করে)। আমিও আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। তার সাথে এটাও বললাম, “যে মুহূর্তে আমি দরজা পার করব, সেই মুহূর্ত থেকে তোমরা দুজনে আমার কাছে মৃত। তোমাদের পার্থিব শরীর থাকবে কিন্ত আমার জীবনে তোমরা নেই হয়ে যাবে। কোন উপলক্ষে কোন কারণে আমাদের সাথে কোন রকম যোগাযোগ করবে না কারণ আমি কিন্ত তোমাদের স্বীকার করব না”। তার পরের কিছু দিন আমার জীবনের সব চেয়ে কঠিন সময় পার করেছি। নিজের প্রাণের থেকে প্রিয় প্রায় ২০০/৩০০ বই স্থানীয় পাঠাগারে দান করে দিলাম। ১৯৮৪ সাল থেকে নিয়মিত ডায়েরি লিখতাম। নিজের হাতে সমস্ত ডায়েরি আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিলাম (আসলে ছাই করে দিলাম নিজের অতীতের একটি বড় অংশ। নিজেদের বিয়ের খাট বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলাম, বাধ্য হলাম এই রকম আরও অনেক কিছু করতে। যেতে হবে জাহাজে, ফলে জাহাজ না আসা পর্যন্ত তো বাড়ি ছাড়তে পারছি না, তাই নিয়েও কত কথা। একজন মা তার ছেলে কে উদ্দেশ্য করে এ সব কথা বলতে পারে, তা আগে ভাবি নি।


যাই হোক, ১৫ই এপ্রিল জাহাজ ছাড়ার দিন। ১৪ই এপ্রিল, ২০০৪ রামকৃষ্ণ নগরের ওই বাড়ির দরজা পার হয়ে (যে বাড়ি আমার নিজের চোখের সামনে তৈরি হয়েছে – আমার বাল্যকাল, কৈশোর এবং তরুণ জীবনের এক অংশ জুড়ে আছে, যে বাড়িতে আমার স্ত্রী নতুন জীবন গড়ার স্বপ্ন নিয়ে পা রেখেছিল, অনেক হাসি – কান্না, সুখ – দুঃখের স্মৃতি জড়ানো সেই বাড়ি) গেলাম। আজ এই মুহূর্ত পর্যন্ত সে বাড়ির দরজা দ্বিতীয় বার পার করি নি। এর মধ্যে ২০১৫ সালে বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছি, আমার স্ত্রী বলেছে, তোমার শ্মশানে যাওয়া উচিত, আমি বলেছি আমার বাবা মারা গেছেন ২০০৪ সালের ১৪ই এপ্রিল, এটা কি তুমি ভুলে গেছ? সেদিন একটা নাটক করে ফিরছিলাম। কেউ কেউ আমার সাথে থাকতে চেয়েছিল, আমি তাদের বলেছিলাম, যা চোখের জল ২০১৪ সালে ফেলেছিলাম তারপরে অপচয় করার মত চোখের জল আমার আর নেই। যাই হোক, ফিরে যাই ২০০৪ সালে। আকবর জাহাজে ওঠার সিঁড়ি যে মুহূর্তে জেটি থেকে বিচ্ছিন্ন হল আমার চোখের জল আর বাধা মানল না। মনে হল সমস্ত বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল – পাড়ি দিলাম এক অজানার উদ্দেশ্যে। এক নতুন জীবনের পথ চলা শুরু হল। আমি দ্বিজ হলাম। জন্মের সময় শিশু কাঁদে – আমার দ্বিজত্ব লাভে আমি কাঁদলাম। আজ ২০১৮ সালে বসে যখন লিখছি, তখন এত সহজ ছিল না, নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, নতুন রীতিনীতি।
চারদিনের সমুদ্র যাত্রা শেষে এসে পৌঁছালাম পোর্ট ব্লেয়ার। বিদ্যুৎ গাড়ি নিয়ে এসেছিল। সমস্ত মালপত্র তুলে সুরিতাকে সাথে নিয়ে ও চলে গেল, আমি এম ৮০ নিয়ে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেট্রল নিয়ে চলে এল। এবার অফিস আবাসন। দেখি একজন ভদ্রলোক খালি গায়ে লুঙ্গি পড়া, হাতে ঝাঁটা আর জeলের বালতি, যে ঘরে আমরা থাকব, সেই ঘরের মেঝে থেকে চুনের দাগ পরিষ্কার করছেন। পরিচয় জানতে চাইলে হেসে বললেন “আমি এই অফিসের একজন স্টাফ।“ ৫ মিনিটের মধ্যে জানতে পারলাম আমি ওনার অধস্তন কর্মচারী অর্থাৎ উনি হলেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট শ্রী অজিত কিসপোট্টা। এক অদ্ভুত ভালো লাগায় এবং শান্তিতে মন ভরে উঠল। বুঝলাম এমন কিছু মানুষের মধ্যে এসে পড়েছি, যারা মানুষের দুঃখ কষ্ট ভাগ করে নিতে পরেন। ক্রমে পরিচয় হল শেখর, গীতেশ এবং ওদের স্ত্রী দের সাথে। আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার শ্রী প্রদীপ সুমন সাহেব তখন কলকাতায়। পোর্ট ব্লেয়ারে থাকাকালীন প্রচুর অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী উল্লেখ্য অবশ্যই সুনামি।


 এ নিয়ে আগে লিখেছি – পরে আবার লিখব। ২০০৫ সালের মে মাসে চলে এলাম কলকাতায়। পোস্টিং হল বারাসত সেন্ট্রাল এক্সাইজ ডিভিশনে। অফিস পোদ্দার কোর্ট।
পরবর্তী ৩য় পর্বে।
অলমিতি

No comments:

Post a Comment