18 August, 2018

সঞ্জয় মল্লিক - আমার বড় মামা

Sanjoy Mallick কাল আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এ চলে যাওয়া আমার এক ব্যক্তিগত ক্ষতি। তাঁর সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক ছিল না ঠিকই কিন্ত যে সম্পর্ক ছিল তা তার চেয়ে অনেক গভীর। আমি তাঁকে "বড়মামা" বলেই চিরকাল ডেকে এসেছি এবং চিরকাল সেই সম্মান দিয়ে এসেছি।
কাল সকালে ৯ টা নাগাদ তাঁর কমেন্ট দেখি
"প্যারাসিটামল খাচ্ছি জ্বরটা কম খূব দূর্বল"।
এটাই তাঁর জীবনের শেষ লেখা হয়ে থাকল।
তারপর কেন জানি না সারাদিন ধরে বারবার মনে হচ্ছিল, একবার ফোন করে খবর নিই। সে খবর আর নেওয়া হল না বরং বিকাল সাড়ে চারটেয় খবর এল বড়মামা আমাদের ছেড়ে, তাঁর প্রিয় "নিরালা" ছেড়ে চিরকালের মত চলে গেছেন।
বড়মামার কাছ থেকে জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি। ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত উদারচেতা, অকৃতদার, রবীন্দ্র প্রেমী এই মানুষটি আজীবন বামপন্থী ছিলেন। রাজ্য সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মচারী থাকা এই মানুষটি সরাসরি রাজনীতি হয়তো করেন নি কিন্ত বাম আদর্শের প্রতি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস তাঁর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পরেই বোঝা যেত। তাঁর কাছ থেকে আমি জেনেছিলাম ছোটদের বই - বড়দের বই বলে আলাদা কিছু হয় না, সব বইই পড়ার বই। সেই সময় এমন অনেক বই পড়েছি যার ভিতরে সেই সময় ঢুকতে পারি নি কিন্ত বড়মামা সব সময় বলত - "পড় বাবুরাম পড়"। নিজের পাঠ্য বিষয়ের বাইরে গিয়ে অন্য বিষয় সম্পর্কে পড়ার - জানার ইচ্ছা আমি তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছি।
উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ ছিল, আগ্রহ ছিল অন্য গানের উপরেও। আমার গান শোনার কান - ভালো সিনেমা দেখার আগ্রহ সব কিছুর পিছনেই বড়মামার অবদান আছে। মানুষটি খেলাধূলাও বড় ভালবাসত। যদিও বড়মামা মোহনবাগান আর আমি ইস্টবেঙ্গল সমর্থক তাতে কোনদিন কোন দূরত্ব তৈরি হয় নি। ভারতের প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয় বড়মামার পাশে বসেই দেখেছিলাম। বড়মামার পাশে বসেই প্রথম দেখা উইম্বলডন কাপ। খেলোয়াড় নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে যে সব ত্রুটি - বিচ্যুতি হত বড়মামা সেই সবও ঠিক করে দিত। বামপন্থার প্রতি আমার আকর্ষণ যে সব বই পড়ে তৈরি হয়েছিল তাও পেয়েছিলাম বড়মামার কাছ থেকেই। সেই অর্থে আমার বামপন্থী মানসিকতা তৈরি হওয়ার পিছনে বড়মামার অবদান অনস্বীকার্য। ও বাড়ির সকলের কাছ থেকেই আমি এবং আমার ভাই অকৃত্রিম স্নেহ ও ভালোবাসা পেয়েছি কিন্ত বড়মামা এবং বড়মাসীর আমার প্রতি একটা আলাদা টান ছিল যা আজও বর্তমান।

আসলে সেই সময় "নিরালা" আর আমার বাবার বাড়ি পাশাপাশি ছিল তবুও দুটো বাড়ির মানুষ জনের মধ্যে কোন ফারাক ছিল না। আমরা একে অন্যের দুঃখ - আনন্দ সমান ভাবে ভাগ করে নিতাম। তারপর কালক্রমে আমি বাবার বাড়ি ছেড়ে নিজের ফ্ল্যাটে যখন চলে এলাম বড়মামা এবং বড়মাসী দুজনেই আমার ফ্ল্যাটে আসা উপলক্ষে যে মিলন উৎসবের আয়োজন করেছিলাম সেখানে অংশ নিয়েছিল, তবে একটা ভুল আজ স্বীকার করে নিই যে মুন্নি মাসী ও মিঠু মাসী কে ডাকতে ভুলে গিয়েছিলাম। তোমরা যদি পার আমায় ক্ষমা করে দিও।
যে ফতুয়া পড়ে বড়মামা দাঁড়িয়ে আছে - শেষ যাত্রায় তার পরনে ছিল ওই ফতুয়াটাই। কাল রাতে চিরাচরিত নিয়ম মেনে যখন "আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে" গানের মাধ্যমে তাঁকে শেষ বিদায় দেওয়া হচ্ছে তখন সেখানে উপস্থিত কারোর চোখ শুকনো ছিল না, এমনকি এ লেখা লিখতে লিখতে আমার চোখও শুকনো নেই। অনেক ব্যক্তিগত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে - স্মৃতির পর্দায় প্রতি মুহূর্তে ফুটে উঠছে ভুলতে না পারা অনেক মুহূর্ত।
ঈশ্বর বা আত্মায় আমার কোন বিশ্বাস নেই - আমার বড়মামা চিরকাল বেঁচে থাকবে আমার চেতনায় - তাঁর ভালবাসায়।

No comments:

Post a Comment