01 February, 2019

২৫ বছর


কিভাবে শুরু করব আর কোথায় শেষ করব বুঝতে পারছি না। এখনও মনে হচ্ছে একটা স্বপ্নের মধ্যে আছি, একটা ঘোরের মধ্যে আছি। এমন একটা দিন, যে দিন এর আগে আমাদের জীবনে আসে নি, যে দিনের স্মৃতি নিয়ে চলা যায় বাকি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত।

আমাদের ২৫ বছরের বিবাহবার্ষিকীএই দিনের কথা ভাবতে শুরু করেছিলাম অন্তত ৫ বছর আগে থেকে। আমাদের ২৫ বছরের বিবাহবার্ষিকী হবে এমন একটি অনুষ্ঠান, যেখানে আমাদের আত্মীয় – স্বজন, দুজনের বন্ধুরা এবং আমার অফিসের সহকর্মীরা একসাথে মিলে আনন্দ করতে পারব। একটি চিন্তা ছিল, যে আমাদের লোক বল সেরকম নেই, কি করে সুন্দর ভাবে সম্পূর্ণ করতে পারব? তারপর মনে হল, আমার জীবনের চলার পথে একটা মজার বিষয় আছে। যে কোন কাজেই প্রথমে একটু অসুবিধা হয়, তারপর কি করে যেন সব ঠিক হয়ে যায়। সেই ভরসা সাহস যোগাল মনে। তখন ২০১৪ সাল, বদলী হয়ে এলাম রাজডাঙ্গা বিল্ডিং এ। পোস্টিং সার্ভিস ট্যাক্স ওয়ান কমিশনারেট বি বি ডি বাগ টু ডিভিশন, রেঞ্জ থ্রি তে। পরিচয় হল SUPERINTENDENT শ্রী সুনীল দাশ এর সাথে। আস্তে আস্তে ডিভিশনের অন্য অফিসারদের সাথে পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা বাড়তে শুরু করল। মনের ইচ্ছাও ডানা মেলতে শুরু করল একই সাথে। সজল, কাকলি, গৌরব, প্রসাদ সাহেব, সতীশ স্যার, মল্লিক সাহেব – ২৪৯ নাম্বার ঘর টা তখন যেন রুক্ষ মরুভূমির মধ্যে এক চিলতে সবুজ মরুদ্যান। অফিসের কাজের সাথে হাসি, ঠাট্টা, সিরিয়াস আলোচনা, আড্ডা, লেগ পুলিং – কি নেই সে মরুদ্যানে! এবার যুক্ত হল খাওয়া – দাওয়া। (যাই হোক,  সার্ভিস ট্যাক্স ওয়ান কমিশনারেট, বি বি ডি বাগ টু ডিভিশন আর এক আলাদা অভিজ্ঞতা শেয়ার করার দাবী রাখে। শুধু বলি,
চারিদিক দেখে বেড়ায় পাঁচ জনা
মনের পথে ভেসে বেড়ায় পাঁচ জনা
মনের সাথী খুঁজে পায় রে এক জনা
চারিদিক খুঁজে বেড়ায় পাঁচ জনা)

মনের সাথী খুঁজে পেয়েছিলাম আমরা সব্বাই। অনেক গল্প আছে, আছে অনেক সুন্দর অভিজ্ঞতা। এখন না হয় থাক সে কথা।


একটা  সময় আমি সবার কাছে কালকের এই দিনের কথা বললাম। সকলেই হই হই করে উঠল। দিন – তারিখ মনে নেই, সকলে মিলে মাঝে মাঝেই আমার LEG PULLING  শুরু হল।সেই সময়, BBD BAG – II DIVISION এর SUPERINTENDENT, U. C. MALLIK এর প্রমোশন আসন্ন, একই সাথে প্রমোশন পাবেন শ্রী সুনীল দাস এবং আরও বেশ কিছু    SUPERINTENDENT,
ওরা ASSISTANT COMMISIONER হবেন এবং সেই খালি জায়গায় PROMOTION পাব আমি (SENIORITY LIST অনুযায়ী)! আর কে কাকে পায়! জুনিয়র দের মধ্যে সিনিয়র মোস্ট আমি, ফলে সব্বাই মিলে আমার পিছনে! তার সঙ্গে শুরু হল, আরও পিছনে লাগা, কবে আসবে সেই দিন। এই ভাবে চলছিল, ২০১র ৩১ শে মার্চ প্রমোশন পেলাম, তারপর GST. বদলী হয়ে ছড়িয়ে পড়লাম কিন্ত গ্রুপ ভাঙ্গলো না বরং জন্ম নিল BBD BAG – II WHAT’S APP গ্রুপ। আগের মতই মাঝে মাঝে খাওয়া – দাওয়া, আড্ডা চলতে থাকল। এল ২০১৭ র ডিসেম্বর। বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে একসাথে মিললাম বিবেক ভারতী শিশু শিক্ষা সদনের ১৯৭৮ পাশ আউট ব্যাচের বন্ধুরাদিনটা ছিল ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭প্রথম মিলনমেলায় আমাদের নিয়ে উৎসাহ টা বেশী ছিল (এবং এখনও আছে) কারণ বন্ধুদের মধ্যে আমরাই সেই বন্ধুকে চিরকালের সাথী করে নিয়েছি। হাসি – মজা – আড্ডার মাঝেই আমি জানালাম, ২০১৯ সালের ১৭ই জানুয়ারী আমাদের বিয়ের ২৫ বছর পূর্ণ হতে চলেছে এবং বন্ধুরা সব্বাই (তাদের পরিবার সহ) এই অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত। BBD BAG – II তে শুরু হয়েছিল সলতে পাকানোর কাজ এবার তাতে ঘি ঢালা হল। আর একটা WHAT’S APP গ্রুপ জন্ম নিল, “বিবেক ভারতী, ১৯৭৮”।

মাঝে মাঝেই দেখা হয়, গল্প হয় তার সাথে চলতে থাকে, ১৭র পরিকল্পনা। প্রথমেই বাড়ি দেখা। আমাদের ইচ্ছা ছিল আমাদের ফ্ল্যাটের কাছাকাছি কোন একটি জায়গায় অনুষ্ঠান করব। প্রথম পছন্দ ছিল কল্যাণ পরিষদ ক্লাবের কল্যাণ ভবন ও সংলগ্ন মাঠ। পার্থ পোদ্দার এবং বিমানের দৌলতে সে ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমাদের আর চিন্তা নেই কারণ এখন আমাদের পাশে এসে গেছে আমাদের ছোট্ট বেলার বন্ধুরা, সেই বন্ধুরা, যাদের ভালোবাসায় কোন খাদ নেই। উলটি গিনতি (COUNT DOWN) শুরু হয়ে গেছেতারপর  বয়ে গেল বেশ কিছু পল – অনুপলআচম্বিতেই বদলী। চলে গেলাম গ্যাংটক। এদিকের কাজের দায়িত্ব নিয়ে নিল বিবেক ভারতীর বন্ধুরা। এল ডিসেম্বর মাস। ০৩/১২/২০১৮ তারিখ থেকে শুরু হল নিমন্ত্রণ। প্রথমেই সুরিতার বাবা – মা। মা বললেন “তিনি অবশ্যই যাবেন ওই দিন”। কে জানত সেই সময়, হয়তো তিনি আমাদের উপর এক মারাত্মক অভিমানে ওই কথা বলেছিলেন। পরের দিন রাত যখন ১২টা ৩০ মিনিট, আমার ফোনে খবর এল তিনি চলে গেছেন এমন এক নিমন্ত্রণ রাখতে, যে নিমন্ত্রণ খেয়ে কেউ কোন দিন ফিরে আসে না। ০৫/১২/২০১৮ র দুপুরে তাঁকে চির বিদায় জানালাম আমরা। সেই সময় আমরা জানতে পারলাম, চলে যাওয়ার আগে তিনি আমাদের হয়ে আমাদের বেশ কিছু আত্মীয়কে জানিয়ে গেছেন ১৭/০১/২০১৯ র অনুষ্ঠানের কথা। ফিরে গেলাম ১৯/১২/২০১৮ তারিখে।

এল ০৪/০১/২০১৯। আগের দু দিন ধরে টেনশন যে পাকিয়ং (সিকিমের একমাত্র বিমান বন্দর) থেকে ফ্লাইট উড়বে কি না? গাড়ির ড্রাইভারের সাথে কথা হল যে ফ্লাইট না উড়লে আমরা সোজা শিলিগুড়ি চলে যাব, ০৭/০১/২০১৯ এ দার্জিলিং মেলের টিকিট কাটা ছিল। যাই হোক, তার দরকার হল না, নির্ধারিত সময়ে ফ্লাইট ছেড়ে কলকাতায় নামল সময়ের আগে। ব্যাগেজ কালেক্ট করে বাইরে এসে আর এক বিপত্তি, নেট কাজ করছে না, ফলে উবের বা ওলা কিছুই বুক করতে পারলাম না। কিছুক্ষণ বৃথা চেষ্টার পর, প্রি পেড বুথ থেকে ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি। গড়িয়াতে ঢোকার আগে বিমান কে ফোন করে বললাম, পেটের মধ্যে আগুন জ্বলছে কিছু খাবার নিয়ে আয়। যেহেতু ১৯ তারিখে যাওয়ার সময় ফ্রিজ চালু করে রেখে গেছিলাম এবং ঘর দোর মোটামুটি পরিষ্কার ছিল, তাই আমি বাড়িতে থাকলাম জিনিসপত্র আন লোড করার জন্য আর সুরিতা দৌড়াল ওদের বাড়ি থেকে রাতের খাবার আনার জন্য। এর মধ্যে বিমান চলে এসেছে, আমরা গল্প করতে করতেই সুরিতা চলে এল, তার একটু বাদে পার্থ। চার বন্ধুতে মিলে যেমন আড্ডা হল তেমনি ১৭ই জানুয়ারির ফাইনাল প্ল্যানিং ও হল। তারপরের দিন রান্নার গ্যাসের ব্যবস্থা হল পার্থর দৌলতে। ৫ তারিখ সকাল থেকেই লিস্ট মিলিয়ে ফোন করা (যাদের বলা হয় নি) শুরু। ৭ তারিখে দৌড়ানো অফিসে, কিছু টাকার ব্যবস্থা করার জন্য। আমাদের কো অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটির বন্ধুরা ভীষণই কো অপারেটিভ, তাই দু তিন ঘণ্টার মধ্যেই সব ব্যবস্থা হয়ে গেল০৮/০১/২০১৯ এবং ০৯/০১/২০১৯ গেল বন্ধ পালনে। যদিও আমি ছুটিতে ছিলাম তবুও নীতি গত ভাবে যেহেতু দাবী গুলোর সমর্থক তাই রাস্তায় বার হই নি শুধু বুধবার সন্ধ্যা বেলা এক পরিচিত দাদার সাথে একটু গল্প করতে গেছিলাম। ১১ তারিখ বিমান আর পোদ্দারের মাধ্যমে ডেকোরেশন আর ইলেকট্রিকের কাজ যারা করবেন তাঁদের সাথে কথা বলে ঠিক হল যে ১৩ তারিখ (রবিবার) সকালে ওদের সাথে দেখা করে সব কিছু ঠিকঠাক করা হবে। যেই কথা সেই কাজ। সব কিছু ঠিক হল। এর মধ্যে অনুষ্ঠানের জন্য কিছু নতুন পোশাক কেনা হয়েছে, এটাও ঠিক হয়েছে যে সুরিতাকে সাজানোর দায়িত্ব পার্থর গিন্নী বর্ণালীর। যত দিন এগোচ্ছে টেনশন বাড়ছে, সব কিছু ঠিকঠাক হবে তো! আসলে সমস্ত নিমন্ত্রিতকে চিনি একমাত্র আমরা দুজন। না ভুল হল কথাটা, আমাদের বন্ধুদের বেশীর ভাগের স্বামী / স্ত্রীর সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় হবে। সকলকে আপ্যায়ন করা খুব একটা সোজা কাজ নয়।

১৬ তারিখ রাতে মাত্র ঘণ্টা তিনেক ঘুমিয়েছি। সকাল বেলা উঠেই সাড়ে সাত টা নাগাদ একবার গিয়ে দেখে এলাম কত টা কাজ এগিয়েছে। ফিরে এসে স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে সুরিতাদের বাড়িতে। বাবা – মা কে প্রণাম করতে। মার ছবির সামনে গিয়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারি নি। বাবা সুরিতার হাতে তুলে দিলেন মায়ের আশীর্বাদী। আমরা বার বার করে অনুরোধ করাতেও উনি রাতে যেতে রাজি হলেন না। আমরাও আর জোরাজুরি না করে চলে এলাম কল্যাণ পরিষদের মাঠে। দেখলাম যে গাড়িটা বুক করেছিলাম তিনি একদম ঘড়ির কাঁটা ধরে ওখানে উপস্থিত। ড্রাইভার ভাইয়ের সাথে কথা বলে, গাড়িটা মাঠের ভিতরে পারকিং এর ব্যবস্থা করে ঢুকতে যাব, হঠাৎ দেখি মাথা থেকে হেলমেট খুলতে খুলতে একজন বলছে “কিরে চোখ তুলে তো দেখিস ও না!” অবাক হয়ে দেখলাম পার্থ – আমার ব্যাচমেট পার্থ মিত্র। ঘেরা জায়গার ভিতরে চেয়ার টেনে বসলাম তিনজনে। একটু বাদেই একে একে এল বিমান, পোদ্দার এবং পার্থ। তখন একেবারে তিন অর্জুনের সমাবেশ! পার্থ মিত্র উলিকটের ইনারের উপর একটা জ্যাকেট চাপিয়েই চলে এসেছে। ওকে টিফিন খেতে বললাম কিন্ত ও বলল বাড়ি থেকে খেয়েই এসেছে, তবুও একটা মিষ্টি খেয়ে আরও কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে চলে গেল। এর পরে এল আমার মেজ গিন্নী বাবুই, হাতে ২৫ টি গোলাপের তোড়া (ওর ও ১৫ তম বিবাহ বার্ষিকী) তারপর শ্রবণা আর দীপাতার আগেই মোবাইলে ছবি তোলা শুরু হয়ে গেছে এবং ফেসবুক আর WHAT’S APP এ পোস্ট হচ্ছে মজার মজার কমেন্ট সহ।  সঙ্গীতা আর  এল কিছু সময়  পরে  চলে এসেছেন আমার বড় কাকা – কাকিমা, দুই খুড়তুতো বোন রিম্পা এবং রিমি আর আমাদের সকলের আদরের হিয়া মা (রিম্পার মেয়ে)বড় কাকা, কাকিমা ঠিক ঠাক গুছিয়ে বসতে না বসতেই চলে এলেন নতুন কাকা – কাকিমা (আমার মেজ কাকা)। আমাদের বন্ধুদের সাথে আলাপ করিয়ে দিলাম সকলের। আমাদের আত্মীয়রা ক্লাব ঘরের দোতলা আর বন্ধুরা নিচে চেয়ার নিয়ে বসে আড্ডা মারছে। এর মধ্যে ফোন, আমার বউদিভাই এবং তাঁর বৌমা গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেছে আমার ফ্ল্যাট ছাড়িয়ে, তাঁদের আবার ফিরিয়ে আনা হল। এবার তো নরক গুলজার। কখনও এদিকে হা হা হা তো কখন ও অন্যদিকে হো হো হো। একদিকে চলছে রান্না, অন্যদিকে ডেকোরেশন আর ইলেকট্রিকের কাজ। এর মধ্যে দক্ষিণেশ্বর থেকে এসে পড়ল অদিতি। সুচরিতা কে ফোন করে বললাম, অদিতি এসে গেল দক্ষিণেশ্বর থেকে আর তুই পাশের পাড়ার লোক হয়ে এখনও আসতে পারলি না।  দুপুর দেড়টা বাজতে না বাজতে খাওয়ার তাড়া। নতুন কাকা – কাকিমা ফিরে যাবেন, রান্নার লোকদেরও ফ্রি করে দিতে হবেসব খেতে বসিয়ে দেওয়া হল। তাও সব মিটতে মিটতে প্রায় পৌনে তিনটে। এর মধ্যে একটা ছোট ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছিল, আমার অতিরিক্ত টেনশনের কারণে, মিটেও গেল তা। বড় কাকা সহ অন্যান্যরা গেল আমার ফ্ল্যাটে। অদিতি আর শ্রবণা বলল ওখানেই চেঞ্জ করে নেবে, বাকিরা গেল নিজেদের বাড়ি।  বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ সুরিতা বেরিয়ে গেল সাজু গুজু করতে। একটু বাদে আমিও ফ্ল্যাটে গিয়ে সকলের পিছনে তাড়া দিলাম। সবাইকে তৈরি করে নিজে তৈরি হয়ে ফিরে এলাম ঘড়িতে তখন ৫ টা ৪৫ মিনিট। একটু বাদে পার্থর ফোন, গাড়ি পাঠাতে হবে ম্যাডামকে আনার জন্য।

মিনিট ১০ পরে গাড়ি ফেরত এল। একি দেখছি! পিছনের সীটে যে বসে আছে সে কি সেই মেয়েটা, যার সাথে এতদিন ঘর করেছি! এতো একদম অন্য মহিলা! একেবারে রাজেন্দ্রাণী! নিজেকে একটু এSMART ভাবছিলাম, ইনি তো এক টুসকিতে আমাকে নেই করে দিলেন। ওকে দেখে সকলেই অবাক। এবার শুরু হল নিমন্ত্রিতদের আসা। দুই শালী ও ভায়রা মিলে কেক অর্ডার দিয়েছিল জানতাম কিন্ত বন্ধুদের মধ্যেও ফিস ফাস চলছে। বন্ধুদের মধ্যে যারা দেরী হবে বলেছিল তারাও অনেকে চলে এসেছে। আমার BBD BAG – II এর বন্ধুরাও (সিনিয়র স্যাররাও) প্রায় সব চলে এসেছে (কাকলী বাদে)হঠাৎ দেখি বিমান আর পোদ্দার মিলে কি সব ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে, চোখের পলকে একটা টেবিল পাতা হল, চলে এল কেক! সেই সময় হয়তো সবচেয়ে বেশী প্রিয়জন উপস্থিত। কেক কাটার পরেই বিমান আর পার্থ হাতে ধরিয়ে দিল মালা, মালা বদল করতে হবে।

লাজে রাঙা হল কনে বৌ গো
মালা বদল হবে এরাতে
তোরা উলু দে রাঙা বর এলো যে
মাথায় টোপর দিয়ে চতুর্দোলাতে
মালা বদল হবে এ রাতে
আজি মালা  বদল হবে এরাতে
না আজ  সুরিতা আর আমি দুজনের কেউই কনে বৌ বা রাঙা বর নই, লাজে রাঙাও হই নি,
আমরা রাঙা হয়েছিলাম ভালোবাসায়, আনন্দে! যে সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়
আমরা  বন্ধনে জড়িয়েছিলাম, সেই সন্ধ্যা সুন্দর স্বর্ণালী হয়ে আমাদের জীবনে ২৫ বছর আগে আসে নি। সে সন্ধ্যা ছিল এক বাধ্য হওয়া সন্ধ্যা, আমাদের দুজনের জেদের কাছে আপস করা এক সন্ধ্যা।  প্রথম মালা বদলের সময় আমরা যে আনন্দ পাব বলে ভেবেছিলাম, তার চেয়ে লক্ষ গুণ আনন্দ আমরা পেলাম আমাদের ২৫ তম বিবাহ বার্ষিকীতে।
এক বার নয়, তিন তিন বার মালা বদল করতে হল। শুধু তাই নয় সিঁদুর যতই পরাধীনতার প্রতীক হোক না কেন, মালা হোক শৃঙ্খলের,কবি লিখে গেছেন
   গান যেখানে সত্য
              অনন্ত গোধুলিলগ্নে
                    সেইখানে
                        বহি চলে ধলেশ্বরী,
              তীরে তমালের ঘন ছায়া
                    আঙিনাতে
              যে আছে অপেক্ষা রে, তার
       পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর
তাই তাকে “নতুন করে পাব বলে” পরিয়ে দিলাম _ _ _ _
কত হাসি, কত কত কথা, কত গান বেজে ওঠে – কত ক্যামেরার চোখ পরে আমাদের পরে
মনে হয় স্বপ্ন দেখছি না তো
এই দিনটাকে কল্পনা করেছিলাম যখন আমরা গেয়েছিলাম
কে প্রথম কাছে এসেছি কে প্রথম চেয়ে দেখেছি
কিছুতেই পাই না ভেবে কে প্রথম ভালবেসেছি
তুমি না অমি
ডেকেছি কে আগে কে দিয়েছে সাড়া
কার অনুরাগে কে গো দিশাহারা
কে প্রথম মন জাগানো সুখে হেসেছি
তুমি না অমি
কে প্রথম কথা দিয়েছি
দুজনার দুটি হৃদয় একাকার করে নিয়েছি
শুরু হল কবে এত  চাওয়া পাওয়া
একই  অনুভবে একই  গান গাওয়া
কে প্রথম মন হারানোর স্রোতে ভেসেছি
তুমি না আমি
২৫ বছর পরে তা দেখলাম নিজেদের জীবনে
পূর্ণ হল সে গান!
তারপর! তারপর হারিয়ে গেলাম মানুষের মাঝে! ভয় ছিল সকলকে ঠিক ঠাক আপ্যায়ন করতে পারব তো? দেখলাম সকলেই কেমন ভাবে যেন নিজেরাই নিজেদের আপ্যায়িত করে নিচ্ছেন।

কেক কাটা এবং মালা বদলের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে কি হয় নি, চলে এলেন লপিতাদি সাথে দাদা। একমাত্র শিক্ষক যিনি উপস্থিত হয়েছিলেন আমাদের আশীর্বাদ করতে (লপিতাদি এমন এক মানুষ তাঁকে নিয়ে আলাদা করে লিখতে হবে) তাঁদের আশীর্বাদে পূর্ণ হলাম আমরা। অনেক আগে চলে এসেছে ভুটান দা সাথে ঈশিতা, খারাপ লাগল পুঁচকে টার পরীক্ষা তাই সে আসতে পারে নি। ভুটানদা, তার তুলনা বোধ হয় সে নিজেই। নিজের দিকে নজর নেই, সব মানুষের পাশে দাঁড়ানো যেন তার জীবনের একমাত্র ব্রত।

কত মানুষ এসেছেন –কার নাম লিখতে গিয়ে কার নাম লিখব? ভয় হয় যদি কারো নাম বাদ পড়ে যায়। তাই আলাদা করে আর কারো নাম লিখছি না।

চলে এসেছে বিবেক ভারতী শিশু শিক্ষা সদনের এবং হরিমতী গার্লসের বন্ধুরা, যারা বেশীর ভাগ আমাদের কমন ফ্রেন্ড। হরিমতীর বন্ধুরা তো আরও আপ্লুত কারণ তারা তাদের লপিতাদির  দেখা পেয়েছে।

এ তো আমাদের ২৫ বছরের বিবাহবার্ষিকী নয়, এ যেন এক মিলন মেলা। দুই বান্ধবী একে অন্যের WORST HALF কে পরিচয় করিয়ে দিল, দেখা গেল তারা দুজনে একই কলেজের ছাত্র। ব্যস্‌ এবার দুজনে জমে গেল আড্ডায়। এক বান্ধবীর ছেলে আর মেয়ের সাথে অন্য এক বান্ধবীর মেয়ের ভাব হয়ে গেল, তিন জনে গল্প কথা, সেলফি তোলা, মায়ের বন্ধুদের ফটো তোলা – এই সবে মেতে উঠল। এক বন্ধুর বৌ বলে উঠল, তোমরা এই রকম ভাবে প্রতি মাসে একবার আড্ডা মার না কেন? এবার ওদের সকলকে আমাদের বাড়িতে ডাক! কে বলবে এদের বেশীর ভাগ মানুষ, এর আগে একে অন্যকে চিনত না।

শেষ হয়ে হয় নাকো শেষ। শেষের স্বাদ বড় মিষ্টি। তারক দা আগেই এসেছিল, এবার দেখলাম নন্দনকে। সাথে মৌমিতা, সুধীরদা আর মৌমিতার ভাই এবং আমাদের মৌলী। নন্দন আসাতে এই অনুষ্ঠান একদম পূর্ণ হয়ে উঠল। এল কল্যাণ, দোলা এবং ওদের পুঁচকে টা। সুদীপ্ত এবং ঋজু এল সব শেষে। ২৫ বছর আগের এই দিনটায় আমার ও সুরিতার যে দুজন বন্ধু আমাদের পাশে ছিল তার মধ্যে সবচেয়ে কাছের ছিল নন্দন ও দীপান্বিতা। দীপা তো সকাল থেকেই ছিল, নন্দন আসাতে এই অনুষ্ঠান প্রায় সম্পূর্ণ হল। শুধু তরুণ দা থাকল অনুপস্থিত। তরুণ দা – তরুণ মুখোপাধ্যায়। আমার নিজের দাদা র চেয়েও বড়! তরুণ দা আমার FRIEND – PHILOSOPHER AND GUIDE. জীবনের সমস্ত বিপদের মুহূর্তে – দুঃখের মুহূর্তে – সংকটের মুহূর্তে এই মানুষটা “মধুসূদন দাদা” হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই অনুষ্ঠানে তরুণ দার না থাকতে পারা, আমাদের কাছে বড় দুঃখের।

কত সুন্দর মুহূর্ত তৈরি হল, কত হাসি – কত গান, এ কলমে তা লিখব কি করে? সব মুহূর্তের সাক্ষী তো এই কলমচি নয়। সে শুধু দেখল আর সাক্ষী থাকল তাদের স্বপ্নের সত্যি হয়ে ওঠা এক সন্ধ্যার। তারা দুজনে চেয়েছিল, তাদের বিয়েতে ডাকবে তাদের স্কুল – কলেজের বন্ধুদের, হই হই করবে, মেতে উঠবে আনন্দে, সেদিন তাদের সে চাওয়া পূর্ণ হয় নি। সুরিতা চেয়েছিল জীবনে একবার সিংহাসনে বসবে (বিয়ে এবং বৌভাতে যেমন অন্য মেয়েরা বসে) তার সে চাওয়া পূর্ণ হয় নি। নিজের পছন্দ মত শাড়িও সে তার নিজের বিয়েতে পরতে পারে নি।

“কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক
কে বলে তা বহুদূর
মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক
মানুষেতেই সুরাসুর”

যে আনন্দ থেকে কিছু মানুষ আমাদের বঞ্চিত করেছিল, আমরা ২৫ বছর পরে তার সহস্র গুণ আনন্দ পেলাম, আমাদের সমস্ত আত্মীয় সে অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে আমাদের শুভেচ্ছা জানালেন, আমাদের আশীর্বাদ দিলেন আর তারা (আমি দুঃখিত তারা আমার করুণা এবং ঘৃণার ও অযোগ্য) রইল “নিস্ফলের, হতাশের দলে”। আমার তাই মনে হয় তারা তো একথাও উচ্চারণ করতে পারবে না
শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে
জয়লোভে যশোলোভে রাজ্যলোভে, অয়ি,
বীরের সদ্গতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই
এ কামনা করার অধিকার তারা তাদের নিজেদের কর্ম গুণে হারিয়েছে।


আমি সুরিতাকে বলেছিলাম, তোমার যে যে চাওয়া সেদিন অপূর্ণ থেকে গেছিল, তুমি মন খুলে আমাকে বলবে, এই দিনে তোমার সব চাওয়া আমি পূর্ণ করে দেব, তাতে আমার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত যদি ধারে ডুবে যায় – যাবে। অন্য কোন মেয়ে হলে কি চাইত আমি জানি না, ও কিচ্ছু চায় নি। বিভিন্ন সময় ওর কথা থেকে আমি যা যা জানতে পেরেছিলাম, আমি ওকে তাই দিয়েছি – দিয়েছি কি! আসলে আমি ওর কাছ থেকে যা পেয়েছি, তাতে এ দেওয়া কিছুই নয়। আসলে আমাদের মধ্যে কোন দেনা – পাওনার সম্পর্ক নেই, আছে পরস্পরের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

সময় পার হয়ে গেল। ঘড়ি বলছে রাত ১২ টা ১৫ অর্থাৎ ইংরাজি মতে ১৮/০১/২০১৯। আমরা বাড়িতে। চোখে ঘুম নেই, দুজনেই বিভোর গল্প কথায়! হাসি আর গানে, কথায় ও সুরে সময় কেটে গেল। অবশেষে ঘুম নামে চোখে। এক সুন্দর দিন হল শেষ।

একাকী গায়কের নহে তো গান,   মিলিতে হবে দুই জনে--
গাহিবে একজন খুলিয়া গলা,   আরেক জন গাবে মনে
তটের বুকে লাগে জলের ঢেউ   তবে সে কলতান উঠে,
বাতাসে বনসভা শিহরি কাঁপে   তবে সে মর্মর ফুটে
জগতে যেথা যত রয়েছে ধ্বনি   যুগল মিলিয়াছে আগে--
যেখানে প্রেম নাই, বোবার সভা,   সেখানে গান নাহি জাগে
ঠিক তাই! একা গান গাওয়া যায় না। যাঁরা আমাদের এই মিলন মেলায় এসেছিলেন তাঁরা যদি না আসতেন, এই লেখা লিখতে পারতাম কি?
সলতে পাকানো থেকে প্রদীপ জ্বালানো পর্যন্ত যাঁরা পাশে ছিলেন, তাঁরা না থাকলে এই অনুষ্ঠান সুন্দর হত কি? সফল হত কি ?
কি বল বাবুই কুন্তল মিতে শান্ত সোনা মা আর কুট্টুস?
কি বলে আমার দুই কাকা কাকিমা, রিম্পা রিমি, হিয়া মা আর দেবার্ঘ্য?
দাদাভাই বউদিভাই পুম্পল রিমি বুয়াদা জয় কি বলিস তোরা?
মল্লিক সাহেব, দাস সাহেব, সজল , কাকলী সহ BBD BAG II এঁরা কি বলেন?
কি বলে আমার বিবেক ভারতীর বন্ধুরা? কি বলে হরিমতীর বন্ধুরা?
বিমান বাড়িতে প্রত্যেকে অসুস্থ। ওর নিজের গায়ে জ্বর! সারাদিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেল! আমি আর সুরিতা ওর কে? আমাদের পরিচয় আমরা ওর বন্ধু!
অদিতি নিজে ভালোভাবে হাঁটতে পারে না, দাঁড়ালে বসতে কষ্ট হয়, বসলে দাঁড়াতে কষ্ট হয়, দক্ষিণেশ্বর থেকে চলে এল সারা দিন থাকল! আমরা কে ওর? বন্ধু।
পার্থ সব সময় বুদ্ধি পরামর্শ নিয়ে পাশে, ওর স্ত্রী বর্ণালী সাজিয়ে দিল সুরিতা কে কেন? আমরা ওদের বন্ধু!
সুমিতা ওর বর (নাকি সমস্ত বরের মত বর্বর মানে আমরা তো worst HALF তাই) ববি ভুবনেশ্বর থেকে চলে এল। কেন? এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবে বলে। আমাদের সাথে ওদের সম্পর্ক কি? বন্ধু! কাকে ছেড়ে কার কথা বলব!
সুদুর সুরাট থেকে হাবু (দিব্যেন্দু) সারা দিনে তিনবার ভিডিও কল করল। কি জন্য? এটাই হচ্ছে ভালোবাসা নিখাদ বন্ধুত্ব।
(দুঃখিত সোমা তোকে এই তালিকায় রাখতে পারলাম না কারণ তুই নিজেও জানিস চেষ্টা করলে ৫ মিনিটের জন্য হলেও তুই এসে একবার দেখা করে যেতে পারতিস। তোর বাড়ি থেকে অনুষ্ঠান এর জায়গায় যেতে এরোপ্লেন, ট্রেন, ট্রাম, বাস, ওলা, উবের কিচ্ছু লাগে না, লাগে মনের ইচ্ছে। পোদ্দার, দীপা, শ্রবণা, সুচরিতা, সঙ্গীতা,মলি, রিন্টু, দেবী, শুভ, গৌতম, দেবাশিস, সব্য সব্বাই এল। অনি, কৌশিক আসতে পারে নি তার যথেষ্ট কারণ ছিল। আশিস কেন আসে নি, জানি না তবে কোন লেম এক্সকিউজ দেয় নি, যেটা তুই দিয়েছিস। তোর খারাপ লাগতে পারে, যে আমি ওপেন এই কথা গুলো লিখলাম কিন্ত এটাই আমি। সোজা কথা, মুখের উপর সোজা ভাবে বলি। আমাদের খারাপ লেগেছে কারণ আমরা জানি আমাদের নিমন্ত্রণে কোন ত্রুটি ছিল না।)
ও আর একজনের কথা না বললে তো এ লেখা শেষ হতেই পারে না। LAST BUT NOT THE LEAST বলতেও পারব না – কি বলব তাই বুঝতে পারছি না
শিশির দা (FRIENDS CATERER) – আজ তার সাথেও আমাদের সম্পর্কের ২৫ বছর পূর্ণ হল। আমাদের বিয়ের দিনেও শিশির দাই ছিলেন খাওয়া – দাওয়ার দায়িত্বে এবং আজকেও তাই।
তাই শিশির দার কথার মাধ্যমেই মধুরেণ সমাপয়েৎ
সব শেষে বলি সকলের ভালোবাসা এবং অংশগ্রহণে আমরা পূর্ণ হলাম
আমরা আমাদের মাথা নত করে আবার তোমাদের প্রণতি জানাই! জীবন সায়াহ্নে এসে এই উপহার পাব এ আমরা কল্পনাও করি নি। 

মূল লেখার মধ্যে সোমার কথা অন্য ভাবে লিখেছিলাম এক ভীষণ অভিমানে। গতকাল সেই অভিমান মুছে গেল। মুছিয়ে দিল সোমা নিজেই। কাল সন্ধ্যা বেলা দীপার সাথে এসে দেখা করে গেল আর বলল সেদিন ও সত্যিই ব্যস্ত ছিল, ওর ভীষণ খারাপ লেগেছিল সেই জন্য ও ফোন করতে পারে নি। আমাদের আর কোন অভিমান রইল না। এটাই বন্ধুত্ব! কালকে সোমার আসায় আমার এ অনুষ্ঠান সত্যিকারের পূর্ণতা পেল।

তিন কুকুরের কাহিনী

পূর্ব কথন
ভেবেছিলাম অন্য কোন এক সময়ে লিখব যখন অন্য কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা চলবে তখন লিখব - লিখব ৩ টে কুকুরের কাহিনী
আমি বাধ্য হলাম আজ
আমি তাই লিখছি সেই তিন কুকুরের কাহিনী
সেই তিন কুকুর
যারা হয়তো মানুষের চেয়ে অনেক বড়
(দেবশ্রী এবং দেবলীনার চেয়ে ছোট
কারণ ওই তিন কুকুর দেব শ্রী এবং দেবলীনার মত বিষয় ভেদে “ঘেঊ ঘেউ” করে না)
প্রথম কুকুর –
সেই কুকুর টাকে আমরা কালু বলে ডাকতাম। যদিও তাকে “কালী” বলা উচিত ছিল কারণ সে তো মহিলা কুকুর ছিল। কালু অবশ্য পুরুষ মহিলা নিয়ে ভাবত না, কালু কারো কাছে খাবার চাইত না।
তখন ১৯৭৮ – আমার বয়স ১০
আমাদের নতুন বাড়ি হচ্ছে – রামকৃষ্ণ নগরে, নিরালার (মল্লিক বাড়ির) পাশে। “কালুয়া” নামটা বোধ হয় আমিই দিয়েছিলাম রং কালো বলে, লিঙ্গ ভেদ বুঝতে শিখি নি সেই প্রাচীন কালে। আমার শরীরে পক্স, জানলা দিয়ে দেখি বাড়ির কাজ চলছে, আর দেখি একটা কালো কুকুর করে ঘেউ ঘেউ (তখন জানতাম না ভবিস্যতে লেখা হবে কাব্য “মা কোথায় – ঘেউ ঘেউ”)! কালো রং বড় পছন্দ করি আমি, তাই নাম দিলাম “কালুয়া”
জানতাম না, আমার দেওয়া ওই নাম মেনে নেবেন মল্লিক দাদু, বড় মামা এবং পাড়ার অন্য সব্বাই।
কালুয়া – একটা রাস্তার কুকুর ছিল অথবা রাস্তার কুকুর ছিল না!
কালুয়া ঘুরে বেড়াত রামকৃষ্ণ নগরের কয়েক টা বাড়ির মাঝে
সেই সব বাড়ি থেকে যা খাবার পাওয়া যায় অথবা খাবার পাওয়া যেত না
তা দিয়ে কালুয়ার পেট চলত
কালুয়া কিন্ত বোস জেঠুর কথা সবচেয়ে বেশী মেনে চলত
একটা দিনের না সে এক রাত্রি র কথা বড় মনে পরে
কোন এক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত আমরা সবাই
কালুয়াকে কেউ নিমন্ত্রণ দেয় নি
(পথ কুকুর কে কেউ নিমন্ত্রণ দেয় নাকি
পথ কুকুর তো জন্মেছে উচ্ছিষ্ট খাওয়ার জন্য)
সেদিন রাতে এঁটো পাত পড়ছিল
পাড়ার অন্য কুকুর গুলো ভুখা পেটে
খাবার ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য লাফাচ্ছিল
ঘেউ ঘেউ করছিল
কালুয়া ও ছুটে ছুটে যাচ্ছিল
কিন্ত খাবারে মুখ দেয় নি
যতক্ষণ পর্যন্ত বোস জেঠু ওর মুখে
নিজের হাতে খাবার তুলে দেয় নি
ততক্ষণ পর্যন্ত কালুয়া খাবারে মুখ দেয় নি।
১৯৮৪ সাল –
কালুয়া তখনও জীবিত
আমি গড়িয়া ছাড়লাম
১৯৮৭ সালে ফিরে এসে কালুয়াকে দেখতে পাই নি
শুনলাম কেউ নাকি ওকে বিষ দিয়ে খুন করেছে।
না ১৯৮৭ সালে ফেসবুক ছিল না
তখন কুকুর প্রেমীদের কেউ চিনত না
২০১৯ এ মরলে কালুয়া সেলিব্রিটি হয়ে যেত
ফিল্ম আর টি ভির নায়িকাদের চোখের জলে বালতি ভরে যেত
তারপর যে জল অবশিষ্ট থাকত তা শুষে নিতে
সাহারায় শিহরণ জাগত
অভাগী কালুয়া – দুর্ভাগী কালুয়া
এল ১৯৯৬ আমি তখন বোলপুরে পোস্টিং, এক বছর ভাড়া বাড়িতে থাকার পর চলে এলাম সিয়ান অফিস আবাসনে। দু চারদিনের মধ্যেই পরিচয় হয়ে গেল আর এক “কালু”র সাথে। মজার কথা, সেও কিন্তু “কালী”। সকালে দুটো বিস্কুট, দুপুরে এবং রাতে আমাদের উচ্ছিস্ট এই ছিল তার বরাদ্দ। বিনিময়ে ল্যাজ নাড়ত, পায়ে পায়ে ঘুরত। অবলা জীব, কথা বলতে পারে না, (নিজের দাবী চেঁচিয়ে বললেও কুকুর প্রেমী বাদে অন্য কেউ বোঝে না) মানুষ আমি তবুও আনন্দ পেতাম না আসলে আমি ওর কাছে ঋণী আমি কৃতজ্ঞ থাকতাম। কেন ঋণী ছিলাম?
অফিসের কাজে আমাকে মাঝে মাঝে কলকাতা যেতে হত। বিশ্ব ভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ধরে যেতাম – ফিরতাম সেই গাড়িতেই। কখনো কখনো পরের দিন শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ধরে ফিরতাম। এরকম একটা পরের দিন বাড়ি ফিরেছি।
সুরিতা মানে Surita Banerjee বলল “জানো কাল এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। সন্ধ্যা বেলা লোডশেডিং – আমি “বিপদ” এর দোকান ছাড়িয়ে পাশের মুদি দোকানে পাঁউরুটি নিতে যাচ্ছি হঠাৎ পায়ের কাছে খস খস শব্দ। চমকে তাকিয়ে দেখি দুটো চোখ জ্বলছে। আমাকে দাঁড়াতে দেখেই একটা ছোট্ট আওয়াজ এল ভৌ! বুঝলাম কালু। সে দেখেছে তুমি বাড়ি নেই, তাই আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে এসেছে এবং বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে”।
এত এক রাত্রের কথা। আসলে আমি তো হিপোক্রিট কুকুরের মনের কথা বুঝতে পারি না, তাই রাস্তার কুকুর রা ও মানুষের চেয়ে বেশী আমাকে ঘৃণা করে। আমরা মর্নিং ওয়াকে বার হতাম। সবচেয়ে সমস্যা ছিল “কালু” কে নিয়ে। ও বেচারী মর্নিং ওয়াক কাকে বলে জানে না, ও জানে ওই দুটো দো পেয়ের পিছনে ওকে ন্যাজ নাড়িয়ে চলতে হবে, যাতে এই লেখক দো পেয়ের ইগো পরিতৃপ্ত হয় (সেদিন এভাবে ভাবি নি এখনও ভাবি না – সন্তান ছাড়া এই মানুষ দুটো ওদের নিজের সন্তান বলে ভাবে – সেন্টু দিলাম না) কিন্ত বে পাড়ার কুকুর গুলো তো কুকুরাধিকার (মানে এলাকার অধিকার) খুব ভালো করেই জানত (ফলে তারা তাড়া করত)। নিরীহ নারীর উপরে পুরুষের অত্যাচার! নারী কে কোন কোন দিন আমাদের মর্নিং ওয়াক অসমাপ্ত রাখতে হত। পরের দিকে হাত ভর্তি ঢিল নিয়ে বার হতাম। সীমান্ত পার হওয়ার পরে যদি দেখতাম বিপক্ষ সেনা নেই তাহলে নীরবে পথ চলতাম, যেই দেখতাম বিপক্ষ সেনা, চার হাতে ঢিল চলত ৩ ফুট দূর দিয়ে! প্রথমত কালুকে ভাগানো – দ্বিতীয়ত কালুকে বাঁচান। হতচ্ছাড়ি পরে বুঝে গেছিল আমরা ওকে মারব না, তাই ঢিল ছুঁড়লেও আমাদের পিছু পিছু আসত। আমি এবং সুরিতা চূড়ান্ত হিপোক্রিট তাই ওর গায়ে কোন দিন ঢিল মারতে পারি নি। আসলে কুকুর তো মানুষের মত কথা বলতে পারে না তাই আমরা ওর কথা বুঝতেও পারি নি।
এবার আসি “রাজা”র কথায়। চেহারা – আচার – আচরণে একদম রাজা সে। সঙ্গে দেওয়া ছবি দেখলেই বোঝা যাবে কেন ওর নাম দিয়েছিলাম “রাজা”। প্রথমে “রাজা”র সাথে আলাপ ছিল না, কালু কে দুপুর বেলা খেতে দেওয়ার সময় মাঝে মাঝে দেখতাম ও তাকিয়ে আছে। একদিন কি মনে হল, কালুকে খাবার দেওয়ার সময় ওকেও ডেকে নিলাম। একটু খাবার ওকেও দিলাম। বন্য জন্ত আমি, মানুষ নাম, মানুষের কথাই বুঝতে পারি না, অবলা জীবের কথা বুঝব কি করে? অবলা জীবের কথা বোঝে বড় বড় মানুষের দল। তবুও ওর চোখ দেখে কেন জানি মায়া পড়ে গেল। তারপর থেকে একের জায়গায় দুই হল। কি দিতাম ওদের? একটু খানি ভাত, মাছ বা মাংসের ঝোল, আর কাঁটা চোপড়া। ওরা বড় তৃপ্তি করে খেত। রাজা নিজের টা খেয়ে আবার কালুর খাবারে ভাগ বসাতে চাইত, তাই একটা লাঠি হাতে রাখতে হত। ঠক্‌ ঠক্‌ করে ভয় দেখাতাম। যেহেতু হিপোক্রিট তাই কোনও দিন আঘাত করতে পারি নি। কালু দিনে আর রাতে খেত, রাতে দিতাম দুটো শুকনো রুটি। রাজা রাতে খেতে আসত না।
সবচেয়ে মজার কথা, দুপুর বেলা আমি যখন অফিস থেকে বার হয়ে বাড়িতে খেতে আসতাম রাজা আর কালু সেই সময়েই আমার বাড়ির (মানে OFFICE QUARTERS) এর সামনে চলে আসত (আগে পরে নয়)। আমার ফ্ল্যাট ছিল গ্রাউণ্ড ফ্লোরে। QUARTERS কমিটির একটি সামান্য দায়িত্বে ছিলাম বলে মাঝে মাঝে রাতে ব্যালকনি টপকে বার হতাম – দেখতাম নাইট গার্ড রা ঠিক ঠাক পাহারা দিচ্ছে কিনা। সব সময় আমার সাথে থাকত কালু আর রাজা – মেরা সাথী।
এ তো না হয় হল। প্রায় ২০ দিনের ছুটি নিয়ে বেড়াতে গেলাম দক্ষিণ ভারত। এক দুপুর বেলা ফিরলাম। দেখি ফ্ল্যাটের একদিকে কালু আর অন্যদিকে রাজা। তারপর যা শুনলাম তা শুনে চোখের জল ধরে রাখতে পারি নি আমরা দুজনেই। প্রতি রাত্রে ওরা দুজন গোটা ক্যাম্পাসে র কোথাও যায় নি, আমাদের ফ্ল্যাটের দু পাশে বসে থেকেছে আর ঘুরে বেড়িয়েছে। রাতে নাইট গার্ড রা ও সে কথাই বললেন।
আর এক সন্ধ্যা! ফ্ল্যাট থেকে বার হচ্ছি হঠাৎ করে রাজা – মুখে একটা শুয়োর ছানা। এনে আমার পায়ের সামনে নামিয়ে রাখল। আমি অবাক! পাশে আরও দু একজন ছিল, তারা ও চুপ। উনি বেশ ল্যাজ নাড়ছেন, খুব আনন্দ আর কি! আমি বুঝলাম, উনি পাশের জঙ্গল থেকে ওটা শিকার করে আমাকে ভেট দিতে এসেছেন। এক ধমক দিলাম। মাথা নিচু করে বসে থাকল। তারপর ওটা মুখে করে নিয়ে চলে গেল। পরের দিন দুপুর বেলা খেতে এল না। মহারাজার রাগ হয়েছে। অনেক সাধ্য – সাধনা করে খাওয়াতে হয়েছিল।
২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চলে এলাম বোলপুর থেকে। মাস ছয়েক বাদে কোন একটা কাজে আবার গেলাম এক রাতের জন্য। উঠেছিলাম Sumit Senguptaর QUARTERS এ। সকাল বেলা মর্নিং ওয়াকে বার হয়েছি, দেখলাম কালু। আমার সাথে হাঁটল। ফিরে এসে সুমিত কে বললাম কালুর কথা। সুমিত বলে তুই ওকে খেতে দিতিস না, তাই ও তোকে ভোলে নি। আমার চোখে তখন জল।
হিপোক্রিট আমি তাই এ লেখা লিখতে লিখতে বার বার চোখে জল এল। তবু ধন্যবাদ কোন এক মানুষকে তিনি আমাকে “হিপোক্রিট” বলে আমার হাত থেকে এ স্মরণিকা বার করে নিলেন।
আপনাকে প্রণাম।

25 January, 2019

গল্প হলেও সত্যি অথবা সত্যি হলেও গল্প।


(প্রথমেই বলে রাখি এ ঘটনা বাস্তবের এবং এই ঘটনার মূল চরিত্রকে আমি নিজের চোখে দেখি নি, পুরো ঘটনা শুনেছি, এমন কিছু প্রিয় মানুষের কাছ থেকে, আমায় মিথ্যা বলে তাদের কোন লাভ নেই।)

ঘটনার সময়কাল ১৭/০১/২০১৯ তারিখ, আমাদের বিয়ের রজত জয়ন্তী পূর্ণ হওয়ার সন্ধ্যাবেলার। এই ঘটনা বলার আগে একটু পূর্ব কথন দরকার। আমার বন্ধু যারা ফেসবুকে আছেন, তাঁরা জানেন, গত ০৪/১২/২০১৮ তে সুরিতার মা শ্রীমতি গৌরী সেন অত্যন্ত আকস্মিক ভাবে প্রয়াত হন। তার আগের দিনই তাঁকে আমরা আমাদের বিবাহ বার্ষিকীর নিমন্ত্রণ জানাই এবং যে মানুষ বাড়ি থেকে বার হতে চাইতেন না, সেই মানুষ জানান যে তিনি অবশ্যই সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। তাঁর অকাল মৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাহত হলেও অনুষ্ঠান বন্ধ না করার সিদ্ধান্ত হয়, বিশেষত যখন জানা যায়, যে তিনি বেশ কিছু আত্মীয় পরিজন কে ১৭ তারিখের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন।

পরবর্তী ঘটনা আমার কানে আসে ১৭ তারিখের রাতে। তখন নিমন্ত্রিতরা সকলেই বিদায় নিয়েছেন, সুরিতা আমাদের ফ্ল্যাটে গেছে জিনিস পত্র রাখতে। আমি, আমার দুই শালি সুজাতা ও মিলিতা, দুই ভায়রা কুন্তল ও শান্ত এবং তাঁদের দুই ছেলে মেয়ে কস্তূরী ও সৌমিক (সোনা মা ও কুট্টুস) রয়েছি। টুকটাক আলোচনা চলছে, হঠাৎ করে সুজাতা আমাকে বলল, জানো আজকে অনুষ্ঠানের সময় একটি ঘটনা ঘটেছে। একজন বয়স্কা মহিলা সোনা মার কাছে কিছু খেতে চেয়েছিলেন, ও খাবার নিয়ে তাঁর হাতে দিয়েছে, তিনি খুব তৃপ্তি করে খেয়েছেন। আমি মনে মনে বললাম, “এই অনুষ্ঠান সার্থক হল” আর সোনা মার দিকে চেয়ে বললাম “এই মন টা সারা জীবন ধরে রাখিস মা”।

সেদিন রাতে ঘুম আসে নি দীর্ঘ ক্ষণ, রাত সাড়ে বারোটার পরেও ফোন বেজেছে। কথা হচ্ছিল মায়ের চলে যাওয়া নিয়ে। আমরা দুজনেই তাঁকে খুব ই মিস করেছি। হঠাৎ করে সুরিতা আমায় বলল “জানো বাবুই (সুজাতা) আমায় বলল দিদি তুমি কষ্ট পেও না, মা আজকে এসেছিল এবং সব কিছু খেয়ে গেছে”। তারপর বলল, সোনা মা, অনুষ্ঠানের জায়গা থেকে বার হয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল, হঠাৎ করে দেখে একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলা, গাছের নীচে একটি বেদিতে বসে আছেন। ও কৌতূহলী হয়ে ওনার কাছে যাওয়াতে উনি বলেন, “মা বড় খিদে পেয়েছে, আমাকে কিছু খেতে দেবে?” তখনও খাওয়া – দাওয়া শুরু হয় নি, সব পদ টেবিলে আসেও নি, সেই জন্য ও একটি প্লেটে চিকেন পকোড়া আর বেবি কর্ণ এনে ওনার হাতে দেয়। উনি তৃপ্তি করে সব খান। তারপর উনি ওকে জিজ্ঞাসা করেন “মা আর কিছু নেই?” । ও তখন বলে “আপনি একটু বসুন, কোথাও যাবেন না, আমি একটু পরে সব নিয়ে আসছি”। তারপর কেক কাটা, মালা বদল এই সবের মধ্যে বেচারি ভুলে গেছিল। যখন খেয়াল হয়েছে, তখন ও ওর বাবা – মাকে সব বলে। ওরা বেরিয়ে এসে দেখে যে সেই ভদ্রমহিলা তখনও বসে আছেন। এবার ওরা গিয়ে প্লেটে করে সব খাবার সাজিয়ে আনে, উনি তৃপ্তি করে সব খাবার খান। তারপর জিজ্ঞাসা করেন “মিস্টি কিছু নেই?” মিষ্টির একটাই পদ ছিল ওরা সেটা এনেছিল, ওরা বলে “ওই তো মিষ্টি”। উনি সেটাও তৃপ্তি করে খান। ওরা তারপর প্লেট নিয়ে চলে যায় আইসক্রিম আনতে কিন্ত একটু দূরে যাওয়ার পরে ফিরে তাকিয়ে তাঁকে আর দেখতে পায় নি। অবাক ঘটনা এটাই যে আমার বন্ধু গৌতম, সে ও ওই ভদ্র মহিলাকে দেখে পার্থ সেনগুপ্ত কে বলেছিল কিছু খাবার নিয়ে ওনাকে খাওয়াতে। পার্থ বলেছিল যাচ্ছে কিন্ত ও গিয়ে কাউকে দেখতে পায় নি। সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা এটাই যে, ওই ভদ্রমহিলা ঠিক সেই খাবার গুলিই চেয়ে চেয়ে খেয়েছিলেন যেগুলি আমার শাশুড়ি মায়ের সবচেয়ে প্রিয় খাবার ছিল (মানে অনুষ্ঠানে যে পদ গুলি হয়েছিল তার মধ্যে)। আরও অবাক করা ঘটনা, পার্থ এবং আমার শালী – ভগ্নীপতিরা ওনাকে যখন খোঁজ করছে তখন ওখানে যে সব গাড়ি গুলি পার্ক করা ছিল (নিমন্ত্রিতদের) তার ড্রাইভারদের জিজ্ঞাসা করে, ওই মহিলা কোথায় গেলেন, তাঁরা বলেন যে, তাঁরা ওই রকম কোন মহিলাকে দেখে নি। ওনাকে যখন ওরা দেখতে পেল না, তখন ওরা মাঠের গেটে এসে রাস্তার দু পাশে চোখ বোলায়। ওরকম কোন মহিলা হেঁটে যাচ্ছেন তাও ওরা দেখে নি। সুরিতা ওদের বলেছিল, তোরা আমাদের ডাকিস নি কেন? ওরা বলেছিল, তোমরা তখন এত ব্যস্ত যে তোমাদের বিরক্ত করতে চাই নি। এটা একদমই সত্যি কথা।

আমার যুক্তিবাদী মন বলছে, এটা একান্তই কাকতালীয় ঘটনা। কারণ ১) ভদ্র মহিলা মাঠের গেটের উল্টোদিকের গলি পথে যদি চলে যান, তাহলে রাস্তায় ওনাকে দেখা যেতেই পারে না। ২) ড্রাইভাররা সচরাচর নিজেদের মধ্যে গল্পে ব্যস্ত থাকে, কে এল কে গেল তার দিকে নজর না থাকাই স্বাভাবিক এবং ৩) অনেক মানুষের খাবারের পছন্দ অন্যের সাথে মিলে যায়।

একই সঙ্গে এটাও মনে হচ্ছে যে সুরিতা এবং তার দুই বোন যদি এই বিশ্বাস নিয়ে শান্তি পেতে চায়, যে তাঁদের মা এই অনুষ্ঠানে এসে আমাদের আশীর্বাদ করে গেছেন তাতে আমার তো কোন ক্ষতি নেই।
আমি জানি না পাঠক কোন মতে বিশ্বাসী হবেন, কোন মত গ্রহণ করবেন – সে স্বাধীনতা আপনাদের উপর থাক। আমি শুধু তৃপ্তি পেয়েছি একটি বিষয়ে, আজকের প্রজন্মের মধ্যেও এমন সুন্দর মন আছে, যারা আনন্দ অন্যের সাথে ভাগ করে নিতে পারে।

শেষ করছি এই কটি কথা বলে
“এই মনটা সারা জীবন ধরে রাখিস মা”