11 September, 2018

পরবাসী জীবনের কথকতা।


অবশেষে শুরু। আশা করি কাল গ্যাস সংযোগ পেয়ে যাব এবং গ্যাংটক পরবাস পর্ব সম্পূর্ণ ভাবে শুরু হবে।জীবন যে এক ভাঙ্গা – গড়ার খেলা তা কত সুন্দর ভাবে বুঝেছি আমরা ভেঙ্গেছি আর গড়েছি আবার দিয়েছি ভেঙে

নিজেদের প্রথম স্বাধীন সংসার গড়ে উঠল ১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে বোলপুরের কাছারিপট্টির বাড়িতে সে সংসার ভেঙে দিয়ে নতুন সংসার গড়া সিয়ান আবাসনের টাইপ ৩ এর ১৭ নম্বরে, যার স্থায়িত্ব মাত্র ৩ টি মাস তারপর টাইপ ২ এর ২২ নাম্বার সুখে – দুঃখে সে সংসার চলল ২০০১ এর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ২০০১ এর ফেব্রুয়ারি পরবর্তী ৩ টে মাস কেটে গেল আর / ১১৭ তে এবার ৭৪ নম্বর আর কে নগর ভাবলাম এই বুঝি শেষ তা কি হয়? পথ বেঁধে দিল বন্ধন হীন গ্রন্থী / আমরা দুজনে চলতি হাওয়ার পন্থী ফলে সযতনে গড়া সে সংসার ভেঙে চিরকালের জন্য ওই বাড়ি ছেড়ে ভেসে পড়লাম নীল সমুদ্রে কালাপানি পার হয়ে তাল – তমাল, নীল আকাশ আর সমুদ্র যেখানে এক হয়ে যায় সেই পোর্ট ব্লেয়ারে বাঁধলাম জীবন তরণী সে ঘাটে থাকলাম বাঁধা ২০০৫ এর মে মাস পর্যন্ত আবার ভাঙ্গা, এবার ফেরা আর / ১১৭ তে মনে ইচ্ছা ছিল এমন একটা বাসা গড়ি যে বাসা গড়ে উঠবে আমাদের দুজনের ভালোবাসা যেখান থেকে কেউ আমাদের বের করে দেওয়ার সাহস করবে না
স্বপ্ন সফল হল ২০০৬ এর জুলাই মাসে নিজেদের ভালোবাসা দিয়ে গড়া সে বাসার নাম দিলাম “ভালোবাসা” পায়ে যাদের সর্ষে, খেলছে যারা  ভাঙ্গা – গড়ার খেলা, তারা তো স্থির থাকতে পারে না তাই ভালো বাসা টি ছেড়ে ২০০৭ এর জুনে পাড়ি রানাঘাট, নিজেদের জীবনের সবচেয়ে অন্ধকারের কাল কাটাতে ২০০৮ সালের নভেম্বরে আবার ফেরা নিজেদের ভালোবাসায় ১০ বছর কাটানোর পর এবার পাড়ি গ্যাংটকে

আসলে ভাঙ্গা – গড়ার খেলা খেলতে এত বেশী অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে ভাঙতে গিয়ে গড়ি আবার গড়তে গিয়ে ভেঙে ফেলি সব জীবন নাটকের মঞ্চে বয়ে চলেছে আমাদের এই ভাঙ্গা – গড়ার খেলা জানি,  যেদিন শেষ হাসি হেসে উইংসের অন্ধকারে হারিয়ে যাব আমরা দুজনে সেদিন শেষ হবে এই ভাঙ্গা – গড়ার খেলা তার আগে পর্যন্ত
চলতে থাকুক – চলতে থাকুক – চরৈবেতি - চরৈবেতি

পরবাসী জীবনের কথকতা।
অবশেষে গ্যাংটক বাস (অথবা প্রবাস) নিশ্চিত হল। গত ১৪ দিনে শহর টার সাথে প্রাথমিক পরিচয় সম্পন্ন। এখানকার বাজার, জিনিসপত্রের দাম, ইত্যাদি সম্পর্কেও প্রাথমিক পরিচয় সম্পন্ন। এবার ভালো করে চেনা - জানার পালা। সেই প্রাথমিক পরিচয়ের ভিত্তিতে কটি কথাঃ
১) এখানকার মানুষ জন ভীষণ ডিসিপ্লিনড এবং এ কথা রাস্তায় চলা সমস্ত যান - বাহনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ওভারটেক, অকারণে হর্ন বাজানো, সিগন্যাল না মেনে রাস্তা পার হওয়া জাতীয় গুণ (যা কলকাতায় দেখে অভ্যস্ত) এখানে অমিল। ফলে একটা প্রাথমিক তফাত আছেই;
২) লাল বাজার যা এখানকার দৈনন্দিন জিনিসপত্রের সবচেয়ে বড় বাজার, সেখানে এত সাজানো যে আমার চোখে ধাক্কা লেগেছিল। একদিকে সবজি অন্যদিকে চাল - ডাল ইত্যাদি। ওপরের ফ্লোরে আছে জামা - কাপড় ও বাসন পত্র, তার উপরে এক অংশ জুড়ে রয়েছে টেলারিং শপ এবং আরও কিছু জামা - কাপড়ের দোকান। কোথাও কোন হই হল্লা নেই। ক্রেতা - বিক্রেতার মধ্যে অহেতুক দরাদরি নেই, দাদা / দিদি দেখে যান জাতীয় হাঁক ডাক অমিল। বিক্রেতা জানেন যে ক্রেতার যে জিনিসের প্রয়োজন তিনি তার কাছেই যাবেন এবং বাজারে প্রতিটি জিনিসের দাম নির্দিষ্ট। একজনের কাছে যে দামে যে জিনিস পাবেন গোটা বাজারে সেই কোয়ালিটির জিনিস আপনি একই দামে পাবেন। সবজি এবং মুদি বাজারের থেকে মাছ - মাংস (মাটন, চিকেন, বিফ, পর্ক) এর দোকান সম্পূর্ণ আলাদা বাড়িতে এবং বেশ তফাতে;
৩) এখানকার মানুষ উর্দি ধারীদের একটা আলাদা সম্মানের চোখে দেখে;
৪) এখানে কাজের জায়গায় সিনিয়র অফিসারদের আলাদা দৃষ্টি তে দেখা হয় এবং তাঁরা আলাদা সম্মান পান যেটা পশ্চিমবঙ্গে অমিল আবার অফিস টাইমের পরে আর সিনিয়র - জুনিয়র ভেদ থাকে না, সেখানে সবাই সাধারণ মানুষ;
৫) যেটা সবচেয়ে খারাপ লেগেছে তা হল ভূমিকম্প প্রবণ এ অঞ্চলে অবাধে বহুতল বাড়ি বানিয়ে চলা হচ্ছে। আসার আগে একটা আলাদা ধারণা ছিল। নিশ্চিত ছিলাম যে এখানে কটেজ ধরনের কাঠের বাড়ির সংখ্যা বেশী থাকবে কিন্ত এ শহরের পথে যতটা পথ চলেছি তাতে একটাও কাঠের বাড়ি বা কটেজ দেখতে পাই নি।
আপাতত এইটুকু থাক।
পরবাসী জীবনের কথকতা। ২য় পর্ব

এ পর্বের শুরু এক অতৃপ্তি দিয়ে এখানে কোন বাংলা বই পাওয়া যায় নামোতি মহলবলে একটি দোকান আছে সেখানে বাংলা ম্যাগাজিন আর খবরের কাগজ পাওয়া যায় কলকাতা ছাড়ার পর খাবার দাবার ছাড়া দুটো জিনিস কিনেছি ১) শারদীয়া আনন্দ মেলা এবং ২) শারদীয়া আনন্দলোক একটা শিলিগুড়ি এবং দ্বিতীয় টা গ্যাংটক থেকে 
ধীরে ধীরে এখানকার জীবন যাত্রার সাথে অভ্যস্ত হচ্ছি এখানকার ট্যাক্সি গুলোর মধ্যে একটা মজা আছে না এরা পুরোপুরি হলুদকালো, না নীল -সাদা এখানকার ট্যাক্সি গুলোর মজা এইটাই যে এই গাড়ি গুলোর কোন না কোন একটা জায়গায় হলুদ রং করা থাকে, সেটা ছাদ, বনেট বা পিছন যেখানেই হোক না কেন এবং নাম্বার প্লেট হলুদের উপর কালো রং দিয়ে লেখা
সিকিম সরকার পরিবেশ রক্ষাকে প্রাধান্য দেয় তাই এখানকার সরকারী ভবন গুলোতে হালকা এবং গভীর সবুজ রং করা অথচ রাস্তার ফুটপাথ বা রেলিং এ কিন্ত সেই রং নেই অর্থাৎ কিনা কোন বিশেষ মানুষের / ডিলারের স্বার্থ রক্ষার ঠিকাদারি সরকার মানে শাসক দল নিয়ে রাখে নি
এম জি রোড মানে এখানকার ম্যালে ঘুরতে ঘুরতে একটা বিষয় নজরে এসেছে যে এখানকার মানুষ আইসক্রিম খেতে বড় ভালবাসে রাস্তায় বা ম্যালে প্রতি ২৫ জনের মধ্যে ১ জনের হাতে আইসক্রিম থাকবেই
এখানকার প্রায় প্রতিটি রেস্তোরাঁ র সাথেবারশব্দ যুক্ত আছে এমনকি না নিরামিষ (ভেজ) রেস্তোরাঁ হলেও তবু এখানে কোন মাতাল দেখি নি আসলে পাহাড়ি রাস্তায় মাতলামো করলেপপাত চ এর সাথেমমার চহওয়া একদম স্বাভাবিক ঘটনা

এই মাসের ২৪ তারিখে পোস্টিং অর্ডার বার হয়েছে এবং আমি ২৭ তারিখে অফিসে জয়েন করেছি পরিস্থিতি বুঝে মনে হচ্ছে আমাকে ADMINISTRATIVE OFFICER এর দায়িত্ব নিতে হতে পারেআগামী সোমবার সে বিষয়ে নিশ্চিত হব

আমি এখানে থাকার মত একটা আস্তানা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম ঠিক ওই গানটির মত
দো দিওয়ানে শহর মে
রাত মে ইয়া দো পহর মে
এক -----
এক আশিয়ানা ঢুঁড়তে হ্যায়

আমার কত বন্ধু এইআশিয়ানাখোঁজার জন্য  আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আমার সাধ্য কি তাঁদের সকলের নাম বলি তবুও একটু চেষ্টা করিঃ
সবার আগে নাম সুরিতার বান্ধবী তটিনীর বন্ধু (Worst Half, সুরিতার কাছে আমিও সেই পর্যায় ভুক্ত) দেবব্রত;
তারপর এলেন কমল রায় যিনি আমাকে আমারই ফেসবুক বন্ধু প্রণব গুহ ঠাকুরতার সাথে পরিচয় করালেন প্রণব দা পরিচয় করালেন SBI ZERO POINT BRANCH OFFICER RINCHEN DORJI BHUTIA র সাথে তিনি আমাকে একটি ফ্ল্যাট দেখালেন যার প্রতিমাসের ভাড়া ১৫০০০/- টাকা ৩ টে ঘর সহযোগে রান্নাঘর এবং ইউরোপিয়ান স্টাইল টয়লেট এবং ল্যাট্রিন সময় চেয়ে নিলাম
তারপর কাল অফিসে যাচ্ছি হঠাৎ করে এক ম্যাডামের ফোন সেই ম্যাডাম (আসলে চিংড়ি) একটি বিউটি পার্লারে কাজ করেন, যেখানে আমি দাড়ি ট্রিম করতে গেছিলাম উনি আমাকে সিলাল নামক এক ম্যাডামের ফোন নাম্বার দিলেন আজ সকালে  সাড়ে আট টা নাগাদ ফোন করলাম এক পুরুষ কণ্ঠের কথা, আপলোগ থোড়া জলদি আইয়ে কজ বহুত আদমি ফোন কর রহে হ্যায়
আমরা দুজন চটি জুতো গলিয়ে দৌড় যাওয়ার সময় এতটাই  ভিতরে বলে মনে হচ্ছিল যে আমি বলেই ফেললাম যেএত দূরে আসব না পরবর্তী চমক, আমাদের যে ড্রয়িং রুমে বসতে দেওয়া হল, তাই দেখে আমার বেটার হাফ বলেই ফেললচল আমরা চলে যাই আমরা ওনার বাড়িতে ঢোকার পর যে ড্রয়িং রুমে আমাদের বসতে দেওয়া হল, তা দেখে আমরা আরও বেশী সঙ্কুচিত তারপরে আমাদের ডেকে নেওয়া হল তার উপরের আর একটি ঘরে একজন সাধারণ চেহারার মানুষ বসে আছেন একটি সোফায় এরপরেই ঘটে গেল ম্যাজিক  যিনি আমাদের একটুও সময় দিতে পারবেন না বলেছিলেন, তিনি আমাদের সাথে গল্প করলেন প্রায় দু ঘণ্টার কাছাকাছি সময় ভাড়ার কথা জিজ্ঞাসা করতে কেমন যেন দ্বিধা লাগছিল এবং তার সঙ্গে আমরা দু জন যে ঘরে থাকব তা কিরকম সেটা বুঝে নেওয়াও বাকি ছিল  
তারপরে যা হল তা বিশদে লিখব ৩য় পর্বে
অলমিতি


25 August, 2018

১৯৯১ সালের ১৫ ই জুলাই থেকে শুরু আমার কর্মজীবন (সরকারী কর্মচারী হিসাবে) সেন্ট্রাল এক্সাইজ অ্যান্ড ল্যান্ড কাস্টমস্‌ বিভাগে লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক পদে। বাবা তখন একই বিভাগে ইন্সপেক্টর। সেদিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কেটে গেছে ২৫ বছরের বেশী সময়। বলা যেতে পারে জীবনের অর্ধেকের বেশী সময় দিয়ে জড়িয়ে আছি এই বিভাগের সঙ্গে। তারই কিছু স্মৃতি তুলে আনতে চাইছি এই লেখার মধ্যে দিয়ে। এ লেখা উৎসর্গ করলাম আমার ব্যাচমেট, আমার সিনিয়র দাদা – দিদি, অফিসার এবং অন্যান্য প্রতিটি কর্মচারীকে, যারা ভালোবাসা দিয়ে, উপদেশ দিয়ে, শাসন করে আমাকে সাহায্য করেছেন, আমাকে এই বিভাগের কাজ কর্মের সাথে পরিচিত করিয়েছেন এবং এখনও করিয়ে চলেছেন সেই সব প্রতিটি মানুষকে। এ লেখা উৎসর্গ করলাম তাদেরও যাদের স্বার্থপর, দায় এড়িয়ে যাওয়া, জুনিয়রের উপর নিজের দায়িত্ব অন্যায় ভাবে চাপিয়ে দেওয়া সেই সব মানুষকেও যারা আমাকে তাদের মত মানুষদের সম্পর্কে সচেতন হতে সাহায্য করেছেন এবং এখনও করে চলেছেন। যে কোন দপ্তরে এই দুই শ্রেণীর মানুষ থাকেন, যাদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর মানুষেরা সংখ্যায় বেশী এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষরা সংখ্যায় কম।

আমাদের চাকরী বদলীর চাকরী। করণিক বা মিনিস্ট্রিয়াল পদে বদলী তুলনা মূলক ভাবে কম কারণ বিভাগে এই ধরনের পদের সংখ্যা কম। সেন্ট্রাল এক্সাইজ অ্যান্ড ল্যান্ড কাস্টমস্‌ (পরবর্তীতে যোগ হল সার্ভিস ট্যাক্স। বর্তমানে পুরো বিভাগের নাম CGST & CX) দপ্তর মূলত এক্সিকিউটিভ ওরিয়েন্টেড দপ্তর। এক্সিকিউটিভ পদের অফিসারদের সংখ্যা এবং মর্যাদা দুই ই বেশী। সম পদের মিনিস্ট্রিয়াল অফিসারের সাথে এক্সিকিউটিভ পদের বেতন বৈষম্য আজও বর্তমান। আমি নিজে মিনিস্ট্রিয়াল পদ থেকে প্রমোশনের মাধ্যমে এক্সিকিউটিভ হয়েছি, হয়েছে আমার মত অনেকেই তাই বোধ হয় এই বৈষম্য আমাদের অনেককেই পীড়া দেয়। যাই হোক, আসল প্রসঙ্গে আসি। যেহেতু এক্সিকিউটিভ অফিসারের সংখ্যা বেশী এবং তাঁদের এক বড় অংশকে ফিল্ড ফর্মেশনে কাজ করতে হয় সেই জন্যই এঁদের একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর বদলী করা হয়। প্রাথমিক ভাবে এটাই নিয়ম প্রতি ৪ বছর একটি জোনে, তার মধ্যে প্রতি ২ বছর এক একটি ইউনিটে। এছাড়া ল্যান্ড কাস্টমসে এবং অন্য কিছু বিশেষ জায়গায় বদলী হওয়ার জন্য আলাদা করে অপশন দিতে হয়। আর একটি নিয়ম আছে তা হল প্রতিটি গ্রেডেই একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর নন সি সি এ এলাকায় বদলী হতে হয়। মিনিস্ট্রিয়ালদের ক্ষেত্রে সময় সীমা ১ বছর (প্রতি দফা), ইন্সপেক্টরদের ২ বছর এবং সুপারিন্টেন্ডেন্টদের ক্ষেত্রে দেড় বছর। এত কথা লিখলাম, এই কারণে যে বিভাগীয় বন্ধুরা ছাড়া এ লেখা যারা পড়বেন তাঁদের আমাদের বদলী নীতি বুঝে নিতে সুবিধা হবে ।

সেন্ট্রাল এক্সাইজে আমার প্রথম পোস্টিং কলকাতা ১ কালেক্টরেটের (আজ যার পরিচয় কমিশনারেট নামে) অ্যাকাউন্টস ব্রাঞ্চে। ওখানে ছিলাম ৪ বছর। ১৯৯১ এর ২৩ শে জুলাই থেকে ১৯৯৪ সালের মে মাস পর্যন্ত। ১৯৯৪ এর জুন মাসে প্রথম বদলীর স্বাদ পেলাম। যেতে হল কলকাতা “বি” ডিভিশন যা তখন ব্যাম্বুভিলাতে। কলকাতা ১ এর অডিট ব্রাঞ্চ ছিল ব্যাম্বু ভিলাতে যেখানে প্রতি মাসে মাইনে দিতে যেতে হত এছাড়াও অ্যাসোসিয়েশন করার সুবাদে ওখানকার মানুষ জনের সাথে পরিচয় ছিলই তাই কোন অসুবিধা হয় নি। তবে অবশ্যই খারাপ লেগেছিল কারণ অ্যাকাউন্টসে থাকাকালীন তৎকালীন অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার শ্রী হরিসাধন নন্দী (আমার বাবার খুব ঘনিস্ট বন্ধু ছিলেন) র শাসন ও ভালবাসায় আমার কর্মজীবন বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছিল। আমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করতেন সেই সময়ের ডেপুটি অফিস সুপারিন্টেন্ডেন্ট শ্রী জোসেফ মিঞ্জ (এখন চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার), আপার ডিভিশন ক্লার্ক (পরে ইন্সপেক্টর) প্রয়াত সঞ্জিত মুখোপাধ্যায় প্রসঙ্গত আমাদের দুজনের জন্মদিন একই – ১১ই নভেম্বর) এবং শ্রী রঞ্জিত বিশ্বাস। এঁদের সকলের কাছে আমি চির ঋণী হয়ে আছি। আমার ট্র্যান্সফার হওয়ার আগেই সঞ্জিতদা প্রমোশন পেয়ে আপীল এ চলে গিয়েছিলেন তবু স্নেহের বন্ধন ছিল অটুট। হঠাৎ করেই বসন্তের দামাল বাতাসের মত সঞ্জিতদা হাজির, “শ্রীতোষ নাটক দেখতে যাবি?” হ্যাঁ বলার আগে সামনের কাগজপত্র গোছানো শুরু। ক্যাশিয়ার সমর দা (সমর চক্রবর্তী) জানতেন সেই সময় আমাকে দিয়ে কোন কাজ করানো যাবেই না। দুজনে মিলে বার হলাম, এলেন কল্যাণ দা ও মিঞ্জদা। বাসে ওঠার আগে জানি না কোন নাটক দেখতে যাচ্ছি এবং আমার পকেটে খুব বেশী হলে ১০ টাকা আছে। জিজ্ঞাসা করতে শুনলাম অ্যাকাডেমি চত্বরে তো যাই তারপর দেখা যাবে, যদি টিকিট না পাই, নিউ এম্পায়ার, লাইট হাউস বা গ্লোব তো আছেই। আর টাকা – টাকার কথা তোমাকে কে ভাবতে বলেছে? গেলাম। দেখা হল “টিকটিকি”। সেদিন ২য় শো। মুগ্ধ হয়েছিলাম সৌমিত্র এবং কৌশিকের অভিনয় দেখে। আর একটি মজার কথা পরদিন নন্দনে মুক্তি পাবে ধনুষ বা ওই জাতীয় নামের কোন একটি সিনেমা। ওঁদের কাছ থেকেই টাকা নিয়ে সে সিনেমার টিকিট কাটলাম। এমনকি আমার বিয়ের পিছনেও এই তিন জনের কিছু অবদান ছিল। ফলে এদের ছেড়ে চলে যেতে মনে কষ্ট তো হয়েইছিল।

এল “বি” ডিভিশন। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার শ্রী বরুণ ঘোষ (বর্তমানে প্রয়াত)। আমি ক্যাশিয়ার। ভালো ভাবেই কাজ চলছিল। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল চঞ্চল (এখন ইন্সপেক্টর)। ১ বছর পরেই বদলী, এবার নন সিসি এর পালা। ততদিনে নিজের বাড়ির পরিবেশ অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। ছুটির দিন গুলোতে আরও বেশী। মনে পড়ে তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও আমি ও আমার স্ত্রী ছাতা হাতে বাইরে বার হয়ে পড়তাম (সৌজন্য আমার মা। মা ই বটে! জীবনে অনেক মায়ের কথা শুনেছি এবং অনেক মাকে দেখেছি এই রকম এক জনকেও চোখে পড়ে নি – এমনকি বাংলা সিরিয়ালের অসাধারণ মহিলা ভিলেন দের মধ্যেও না) ফলে এই বদলী ছিল আমার কাছে আশীর্বাদ। জুন মাসের ১ তারিখ যোগ দিলাম বোলপুরে। বাড়ি খুঁজে নিতে একটা মাস দেরী হয়েছিল, ওই সময় আমার নিজের বাড়ির পরিস্থিতির সাথে নরকের কোন ফারাক ছিল বলে আমার মনে হয় না। ঠিক ১ মাস বাদে ১লা জুলাই মুক্তি পেলাম, জিনিসপত্র নিয়ে বার হচ্ছি, দেখলাম নিচের তলা ভাড়া দেওয়া হবে বলে লোক ঢুকছে। বাড়ির বড় ছেলে বার হয়ে যাচ্ছে মায়ের মনে কোন কষ্ট নেই বরং আনন্দ, উপরি রোজগারের রাস্তা খুলে গেল।
বোলপুরে পোস্টিং ১ বছরের – থাকলাম ৫ বছর। আমার চাকরী জীবনের অন্যতম সেরা সময় এই ৫ বছর। প্রথম বছর খুব কষ্ট করতে হয়েছিল। যে বাড়িতে ছিলাম, সে বাড়িতে জলের কোন লাইন ছিল না, রাস্তার কল থেকে প্রয়োজনীয় জল আনতে হত, কাচাকাচি রাস্তার কলে। দুজনের কেউ ই এ অভ্যাসে অভ্যস্ত ছিলাম না। প্রথম ৬ মাস গ্যাস ছিল না, স্টোভের আগুনে রান্না। মাইনে গেছে কমে। তবু মনে আনন্দ ছিল, দুজনে একটু বসে গল্প করলে কেউ দাঁত খিঁচাবে না, বাইরে ঘুরতে বেরিয়ে দেরী হলে গালাগালি খেতে হবে না, ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরী হলে দরজায় দুম দাম ধাক্কা পড়বে না। আর ছিলেন রায়দা। শ্রী দিলীপ রায় (জানি না আজ বেঁচে আছেন কিনা)। অকৃতদার মানুষটি বাবার মত – বড় দাদার মত আমাদের দুজনকে আগলে রেখেছিলেন। রায়দার কাছ থেকে দুজনে অনেক কিছু শিখেছি। এক সময় দণ্ডকারন্য প্রজেক্টে ছিলেন। সেই সময়ের গল্প শুনেছি অনেক। আরও একটি কথা, আমার বদলী হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা থেকে আমার ব্যাচমেট এবং আরও কিছু ঘনিস্ট মানুষ বোলপুরে বদলী হন, ফলে মনেই হয় নি কলকাতার বাইরে আছি। ১ বছর ভাড়া বাড়িতে থাকার পর সিয়ানে অফিস আবাসন। এত সুন্দর এ সময় কেটেছিল ভাবা যায় না। আবাসনে দুর্গা পুজো হত না কারণ বেশীর ভাগ আবাসিক বাড়ি চলে যেত। হত কালী পুজো আর সরস্বতী পুজো। কত হইচই – মজা আনন্দ! আর ছিল বিশ্ব কর্মা পুজো। আজও চোখ বুজলেই দেখতে পাই আবাসনের ভিতরের মাঠটায় সার দিয়ে টু হুইলার দাঁড় করানো (আমারটা বাদে)। মজার কথা, এ পুজোর সেক্রেটারি ছিলেন আমাদের সানা দা – সানাউল্লা খান। সেদিন অফিসের ড্রাইভার অ্যাসোসিয়েশন ব্যবস্থা করত খিচুড়ি খাওয়ানোর। সব্বাই মিলে পাশাপাশি বসে তৃপ্তি করে খেতাম। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটত কালী পুজো এবং সরস্বতী পুজোতেও। সরস্বতী পুজোতে অতিরিক্ত পাওনা ছিল নাটক। আবাসনের বাচ্চাদের দিয়ে নাটক করানো হত। একবার শ্রী গৌতম দে প্রস্তাব দিলেন নিজেরাই মণ্ডপ বানাব। সে বারের আনন্দ শুধু আমরাই জানি। আবাসনের প্রতিটি সক্ষম লোক এই কাজে অংশ গ্রহণ করেছিল। যে যেমন ভাবে পেরেছে সাহায্য করেছে। কেউ বানিয়েছে ছাদ, একটা বড় দল শর গাছ চেঁছে কাণ্ড বের করে দিয়েছে। কেউ দায়িত্ব নিয়েছে বেড়া বাঁধার। এরকম অজস্র ঘটনার স্মৃতিতে ভরপুর আমার বোলপুর প্রবাস। আলাদা করে পৌষ মেলা আর বসন্ত উৎসবের কথা বললাম না কারণ ওই দুটো অনুষ্ঠান ছাড়া বোলপুর সম্পূর্ণ নয়।

বাবার একান্ত অনুরোধে ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে বোলপুর থেকে বদলী নিলাম এই শর্তে যে সাংসারিক শান্তি বজায় রাখার প্রয়োজনে (বিশেষত আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে আমার মাতৃদেবীর অপ্রয়োজনীয় প্রবেশ আটকাতে) প্রতিদিনকার জীবনে আমরা একে অন্যের পাশে থাকলেও একে অন্যের জীবনে প্রবেশ করব না এবং তার প্রথম অংশ হিসাবে থাকব দুটো আলাদা ফ্লোরে এবং রান্নাঘর হবে আলাদা। অফিসিয়াল পোস্টিং কনফিডেন্সিয়াল ইউনিট, কলকাতা ১। ২০০২ সালে প্রমোশন পেয়ে হলাম ইন্সপেক্টর।
এরপর পরবর্তী পর্বে।

কর্ম জীবনের চলছবি - দ্বিতীয় পর্ব


২০০২ এর ডিসেম্বর মাসে প্রমোশন পাওয়ার পর ২০০৩ এর এপ্রিল মাস পর্যন্ত পুরনো জায়গাতেই থাকলাম। মে মাসে যোগ দিলাম হলদিয়া কমিশনারেটে। পোস্টিং হল স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইউনিটে। যোগ – বিয়োগ – গুণ – ভাগ – শতাংশ – ব্যাক ক্যালকুলেশন (মানে পাটি গণিতের পাটি চিবিয়ে) নিয়ে চলতে লাগল দিন – মাস – বছর। প্রসঙ্গত যাঁরা আমাকে ছোট বেলা থেকে চেনেন তাঁরা (এবং আরও কিছু একান্ত ঘনিষ্ঠ মানুষ) জানেন যে অংক চিরকালই আমার কাছে আতঙ্ক। আমার সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ইতিহাস এবং সাহিত্য। তবু আমার জীবন তরণী বয়ে চলেছে অংক নদীর পথে। ২৭ বছরের চাকরী জীবনে ১৯৯৮ – ২০০৩ এর এপ্রিল এই সময় বাদ দিলে প্রতিটি পোস্টিং এমন জায়গায় হয়েছে যেখানে অংক বাদ দিয়ে কাজ করা যায় না। জানি বাকি দিন গুলোও এই ভাবেই কাটবে। আমার জীবনের সবচেয়ে মজার বিষয় হল এইটাই। যখনি চিন্তা করি তখনি হাসি পায়। আবার এক দিক থেকে করলে মানুষের জীবন তো অঙ্কের মধ্যেই চলে। এক অন্য অঙ্ক। জীবন নাটকের এক অভিনেতা আমি, একটি উইংস দিয়ে ঢুকেছি – অন্য একটি উইংস দিয়ে বার হয়ে চলে যাব। মঞ্চে যে চরিত্র হয়ে ঢুকেছি, বিভিন্ন অঙ্কে সেই চরিত্রের অভিনয় করে যাব। দর্শক জানে না আমি আগে কোথায় ছিলাম – জানে না কোথায় যাব। অভিনয় যদি ভালো করতে পারি তবে হয়তো কিছু দর্শক কিছু দিন চরিত্রটাকে মনে রাখবে। নচেৎ নয়।

২০০৪ সালে একটা সুযোগ এল রেঞ্জ লেভেলে কাজ করার তবে যেতে হবে পোর্ট ব্লেয়ার। ভাবলাম রথ দেখা – কলা বেচা দুই ই হবে। ১ বছরের পোস্টিং। ওখানে যারা পোস্টিং তাদের সাথে কথা বলে জানলাম, যে শুধু মাত্র জামা কাপড় আর বিছানার চাদর – বালিশ নিয়ে গেলেই হবে, আর নিয়ে যেতে হবে আমার এম ৮০। ভালোই হল। তবুও ফাইনাল করার আগে একবার বাবা – মার সাথে কথা বলে অনুমতি নেওয়া উচিত বলে মনে হল। ফোনে কথা বলে অনুমতি নিয়ে নিলাম এবং নিয়ম মত অর্ডার বার হয়ে গেল। এবার যাওয়ার পালা। স্বাভাবিক ভাবেই বেশীর ভাগ জিনিস পত্র যেহেতু বাড়িতেই থাকবে এবং বাড়ির বাকি দুজন সদস্যের মধ্যে একজন ৭০ এর কাছে – অন্যজন ৬০, তাই নিজের জিনিস পত্র একটি ঘরে এবং রান্নার বাসন পত্র, গ্যাস ওভেন রান্না ঘরে রেখে এই দুটো ঘর কে তালাবন্ধ করে রাখাটাই বাস্তব সিদ্ধান্ত। সেই ভাবেই ঠিক হল। না ঠিক থাকল না বেশী দিন, আদেশ হল সব ঘর খোলা রেখে যেতে হবে, সমস্ত ঘরে (অর্থাৎ আমাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আমাদের অবর্তমানে অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবে, আমাদের শোয়ার খাটে আমাদের অনুমতি ছাড়া যে কেউ শুতে পারবে, টি ভি – সাউন্ড সিস্টেম ইত্যাদি যা যা ব্যবহারিক জিনিস পত্র অবলীলায় ব্যবহার করতে পারবে। এর জন্য সেই সব জিনিসের কোন ক্ষতি হলে? হতেই পারে। কোন সুস্থ – স্বাভাবিক – ভদ্র মানুষ এই দাবী মেনে নিতে পারে বলে আমার মনে হয় না। ফলত পরিষ্কার জানিয়ে দিলাম এই শর্ত আমি মানব না। তাহলে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। আমি বলে দিলাম দরকার হলে বাড়ি ছেড়েই চলে যাব কিন্ত একটা কথা আজকেই বলে দিলাম, এবার বাড়ি ছাড়লে ওই দরজা দিয়ে জীবনে প্রবেশ করব না। তোমাদের বয়স হচ্ছে, বুঝে সিদ্ধান্ত নাও। দু – চারদিন পরে একদিন দুজনে একটু রাত করে বাড়ি ফিরেছি – শুনলাম পরামর্শ দেওয়া – নানা উসকানো হচ্ছে যে বাবা যেন বলেন যে তিনি আমার কোন কথা শুনবেন না (আসলে আমার বাবা আমার প্রতি যথেষ্ট স্নেহশীল ছিলেন)। আমি সুরিতাকে বললাম – তৈরি থাক, সারা জীবনের মত এ বাড়ি ছাড়তে হবে। পরের দিন সকালেই বাবা ডেকে আমার জানা কথা গুলো বললেন (একদম আমার মায়ের শব্দ গুলো গুণে গুণে ব্যবহার করে)। আমিও আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। তার সাথে এটাও বললাম, “যে মুহূর্তে আমি দরজা পার করব, সেই মুহূর্ত থেকে তোমরা দুজনে আমার কাছে মৃত। তোমাদের পার্থিব শরীর থাকবে কিন্ত আমার জীবনে তোমরা নেই হয়ে যাবে। কোন উপলক্ষে কোন কারণে আমাদের সাথে কোন রকম যোগাযোগ করবে না কারণ আমি কিন্ত তোমাদের স্বীকার করব না”। তার পরের কিছু দিন আমার জীবনের সব চেয়ে কঠিন সময় পার করেছি। নিজের প্রাণের থেকে প্রিয় প্রায় ২০০/৩০০ বই স্থানীয় পাঠাগারে দান করে দিলাম। ১৯৮৪ সাল থেকে নিয়মিত ডায়েরি লিখতাম। নিজের হাতে সমস্ত ডায়েরি আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিলাম (আসলে ছাই করে দিলাম নিজের অতীতের একটি বড় অংশ। নিজেদের বিয়ের খাট বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলাম, বাধ্য হলাম এই রকম আরও অনেক কিছু করতে। যেতে হবে জাহাজে, ফলে জাহাজ না আসা পর্যন্ত তো বাড়ি ছাড়তে পারছি না, তাই নিয়েও কত কথা। একজন মা তার ছেলে কে উদ্দেশ্য করে এ সব কথা বলতে পারে, তা আগে ভাবি নি।


যাই হোক, ১৫ই এপ্রিল জাহাজ ছাড়ার দিন। ১৪ই এপ্রিল, ২০০৪ রামকৃষ্ণ নগরের ওই বাড়ির দরজা পার হয়ে (যে বাড়ি আমার নিজের চোখের সামনে তৈরি হয়েছে – আমার বাল্যকাল, কৈশোর এবং তরুণ জীবনের এক অংশ জুড়ে আছে, যে বাড়িতে আমার স্ত্রী নতুন জীবন গড়ার স্বপ্ন নিয়ে পা রেখেছিল, অনেক হাসি – কান্না, সুখ – দুঃখের স্মৃতি জড়ানো সেই বাড়ি) গেলাম। আজ এই মুহূর্ত পর্যন্ত সে বাড়ির দরজা দ্বিতীয় বার পার করি নি। এর মধ্যে ২০১৫ সালে বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছি, আমার স্ত্রী বলেছে, তোমার শ্মশানে যাওয়া উচিত, আমি বলেছি আমার বাবা মারা গেছেন ২০০৪ সালের ১৪ই এপ্রিল, এটা কি তুমি ভুলে গেছ? সেদিন একটা নাটক করে ফিরছিলাম। কেউ কেউ আমার সাথে থাকতে চেয়েছিল, আমি তাদের বলেছিলাম, যা চোখের জল ২০১৪ সালে ফেলেছিলাম তারপরে অপচয় করার মত চোখের জল আমার আর নেই। যাই হোক, ফিরে যাই ২০০৪ সালে। আকবর জাহাজে ওঠার সিঁড়ি যে মুহূর্তে জেটি থেকে বিচ্ছিন্ন হল আমার চোখের জল আর বাধা মানল না। মনে হল সমস্ত বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল – পাড়ি দিলাম এক অজানার উদ্দেশ্যে। এক নতুন জীবনের পথ চলা শুরু হল। আমি দ্বিজ হলাম। জন্মের সময় শিশু কাঁদে – আমার দ্বিজত্ব লাভে আমি কাঁদলাম। আজ ২০১৮ সালে বসে যখন লিখছি, তখন এত সহজ ছিল না, নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, নতুন রীতিনীতি।
চারদিনের সমুদ্র যাত্রা শেষে এসে পৌঁছালাম পোর্ট ব্লেয়ার। বিদ্যুৎ গাড়ি নিয়ে এসেছিল। সমস্ত মালপত্র তুলে সুরিতাকে সাথে নিয়ে ও চলে গেল, আমি এম ৮০ নিয়ে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেট্রল নিয়ে চলে এল। এবার অফিস আবাসন। দেখি একজন ভদ্রলোক খালি গায়ে লুঙ্গি পড়া, হাতে ঝাঁটা আর জeলের বালতি, যে ঘরে আমরা থাকব, সেই ঘরের মেঝে থেকে চুনের দাগ পরিষ্কার করছেন। পরিচয় জানতে চাইলে হেসে বললেন “আমি এই অফিসের একজন স্টাফ।“ ৫ মিনিটের মধ্যে জানতে পারলাম আমি ওনার অধস্তন কর্মচারী অর্থাৎ উনি হলেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট শ্রী অজিত কিসপোট্টা। এক অদ্ভুত ভালো লাগায় এবং শান্তিতে মন ভরে উঠল। বুঝলাম এমন কিছু মানুষের মধ্যে এসে পড়েছি, যারা মানুষের দুঃখ কষ্ট ভাগ করে নিতে পরেন। ক্রমে পরিচয় হল শেখর, গীতেশ এবং ওদের স্ত্রী দের সাথে। আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার শ্রী প্রদীপ সুমন সাহেব তখন কলকাতায়। পোর্ট ব্লেয়ারে থাকাকালীন প্রচুর অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী উল্লেখ্য অবশ্যই সুনামি।


 এ নিয়ে আগে লিখেছি – পরে আবার লিখব। ২০০৫ সালের মে মাসে চলে এলাম কলকাতায়। পোস্টিং হল বারাসত সেন্ট্রাল এক্সাইজ ডিভিশনে। অফিস পোদ্দার কোর্ট।
পরবর্তী ৩য় পর্বে।
অলমিতি