28 October, 2019

প্রতিবাদী এক মানুষ ভিক্টর হারা

একটি স্টেডিয়ামে আটক পাঁচ হাজার মানুষ
মাঝখানে চেয়ারে বসে এক শিল্পী - গান বাঁধেন - গান গেয়ে চলেন তিনি। সামনে রাখা তাঁর প্রিয় গিটার আর গিটারের পিছনে উদ্যত রাইফেল - লক্ষ্য স্থির শিল্পীর শরীরের দিকে - রাইফেল ধরে থাকা মানুষ গুলোর চোখ হিংসার আফিমের প্রভাবে আগুন বর্ণ

শিল্পীর দু হাতের আঙুল গুলো একটু আগেই থেঁতলে দেওয়া দেওয়া হয়েছে রাইফেলের বাঁটের আঘাতে আঘাতে। প্রতিটি আঘাতে উল্লাস করেছে সেই মানুষ গুলোর সর্দার আর যারা আঘাত করছে তারা জানে শাসকের হুকুম না মানলে - সর্দারের হুকুম না মানলে তাদের সন্তান থাকবে অভুক্ত অথবা তার মেয়ে রঙ্ মেখে দাঁড়াবে পথে

সর্দার হেসে বলে - ওই তো গিটার,
দেখি কত গান গাইবি এবার।
শিল্পী উঠে দাঁড়ান, সারা শরীর আঘাতে কাতর
শিল্পী তুলে নেন তার গিটার
তাঁর কণ্ঠে জেগে ওঠে সেই শব্দ গুলি
যা তিনি লিখেছেন তাঁর সহ যোদ্ধাদের জন্য
সর্দার কে অবাক করে, তার অধীনস্থ মানুষগুলো কে চমকে দিয়ে
আরও ৫০০০ কণ্ঠ, কণ্ঠ মেলায় শিল্পীর সাথে
একটি মুহূর্ত বুঝি বা
গর্জে ওঠে রাইফেল
মাত্র ৪৬ টা বুলেট বিদ্ধ করে শিল্পীর শরীর
তারপর - তারপর তাঁর শরীর টানানো থাকে স্টেডিয়ামের মূল ফটকের সামনে যাতে গণতন্ত্রের বিরোধীরা শিক্ষা নিতে পারে
এবং শেষে তাঁর স্থান হয় এক গণ কবরে।

নাম তাঁর
ভিক্টর হারা - জন্ম - ২৮/০৯/১৯৩২ - মৃত্যু - ১৬/০৯/১৯৭৩
বাবা ও মায়ের নাম Manuel Jara এবং Amanda Martínez। বাবা ছিলেন এক অশিক্ষিত দরিদ্র চাষি যিনি চাইতেন তার ছেলে স্কুলে যাওয়ার বদলে মাঠে কাজ করুক। মাত্র ৬ বছর বয়স থেকেই ভিক্টর মাঠে কাজ করত। অন্যদিকে মা নিজে নিজেই লেখাপড়া শিখেছিলেন এবং তিনি চাইতেন তাঁর সন্তানরা শিক্ষা লাভ করুক। আমান্ডা নিজে পিয়ানো এবং গিটার বাজাতে জানতেন, তাছাড়া তিনি প্রচলিত লোক গীতির মাধ্যমে বিভিন্ন আনন্দ অনুষ্ঠান এবং শোক মিছিলে অংশ নিতেন। ভিক্টরের মাত্র ১৫ বছর বয়সে আমান্ডা মারা যান।

ভিক্টর অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসাবে শিক্ষা শুরু করলেও অচিরেই তিনি এক সেমিনারিতে গিয়ে পাদ্রী হওয়ার শিক্ষা নিতে থাকেন, যদিও কিছুদিন বাদেই ক্যাথলিক চার্চের সম্পর্কে তাঁর মোহ ভঙ্গ হয়। এরপর থেকে শুরু হয় এক ভ্রাম্যমাণ জীবন এবং একের পর এক চাকরী গ্রহণ এবং ছেড়ে দেওয়া। শেষ পর্যন্ত তিনি ফিরে আসেন নিজের শহর Lonquén এ এবং তখন থেকেই লোক গীতি এবং থিয়েটারের প্রতি তাঁর আগ্রহ জাগে।

ইউনিভার্সিটি অফ চিলির কয়ার এ যোগ দেন ভিক্টর এবং অচিরেই তিনি নাটকের কয়ার মেট হিসাবে যোগ দেন । এই সময়ে তিনি Maxim Gorky's The Lower Depths নাটকেও কাজ করেছিলেন। ১৯৫৭ সালে তাঁর সাথে পরিচয় হয় ভায়োলেটা পেরার যিনি তখন চিলির প্রাচীন লোক সঙ্গীতের সাথে বর্তমান সময়ের মেল বন্ধন ঘটানোর কাজ করে চলেছিলেন। এই ভায়োলেটা পেরার কাছ থেকে লোকগানে হাত পাকিয়েছিলেন হারা। শুরু হয় চিলি এবং অন্য ল্যাটিন আমেরিকান লোক সঙ্গীতের সাথে তাঁর পরিচয়। এই সময় তিনি অনুপ্রাণিত হন Parra, Atahualpa Yupanqui, and the poet Pablo Neruda র দ্বারা।

১৯৬০ সাল নাগাদ ভিক্টর জড়িয়ে পড়েন ল্যাটিন আমেরিকার লোকসঙ্গীত আন্দোলন Nueva Canción movement এর সাথে। সাল ১৯৬৬, প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম অ্যালবাম Canto a lo humano। ১৯৭০ সালে থিয়েটার কে সম্পূর্ণ রূপে বিদায় দিয়ে গানের মাধ্যমেই প্রকাশ করতে শুরু করেন মানুষের সুখ – দুঃখ আনন্দ – যন্ত্রণার কথা। এই সময় কালে তাঁর দুটি বিখ্যাত গান "Plegaria a un Labrador" ("Prayer to a Worker") and "Te Recuerdo Amanda" ("I Remember You Amanda").।
১৯৬০ সালে ঘটে গেছে ভিক্টরের জীবনের এক মহা গুরুত্ব পূর্ণ ঘটনা। কিউবা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে আসার পর ভিক্টর যোগ দিয়েছেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। জারার গান তখন ছড়িয়ে পড়েছে চিলির সীমানা পার হয়ে গোটা ল্যাটিন আমেরিকায়। যারা তখন গান বাঁধতেন, সুর করতেন, গাইতেন। ১৯৬৯ সালে তাঁর লেখা গান "Preguntas por Puerto Montt" ("Questions About Puerto Montt") সরাসরি আঘাত করল সেই সব সরকারী অফিসারদের যারা পুলিশ কে Puerto Montt. র বসতি স্থাপন কারীদের উপর আক্রমণ করার আদেশ দিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে জারা পপুলার ইউনিটি কোয়ালিশন প্রার্থী সাল্ভাডোর আইয়েন্দে কে সমর্থন করেন এবং রচনা করেন তাঁর আর এক বিখ্যাত গান "Venceremos" ("We Will Triumph")। সাল্ভাডোর আইয়েন্দে জয়ী হওয়ার পর ভিক্টর এবং তাঁর স্ত্রী জোয়ান চিলির সাংস্কৃতিক নব জাগরণে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭২ সালে মহান কবি পাবলো নেরুদার নোবেল জয়ের পর ভিক্টর একটি সঙ্গীত রচনা করেন তাঁর উদ্দেশ্যে।

সারা দুনিয়ার গণতন্ত্রের রক্ষক, পৃথিবীর মানুষের উপরে পারমাণবিক বোমা বর্ষণ কারী একমাত্র দেশের সহায়তায় পিনোসে নামক এক জীব গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত চিলি সরকারের বিরুদ্ধে ক্যুদেতা করে। সফল হয় তা। এরপর কি করতে হয়? প্রথমেই ধ্বংস করার চেষ্টা করতে হয় প্রতিবাদী কণ্ঠকে - যারা সুস্থ স্বাভাবিক চিন্তা ধারার প্রচার করে, তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করতে হয়। তখন তো সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না, থাকলেও অবশ্য ভিক্টরের পরিণতি একই হত কারণ ভিক্টরদের কণ্ঠ ওই ভাবে রুদ্ধ করা যায় না এবং যাবেও না কোনদিন। অতএব ১২/০৯/১৯৭৩ হারা বন্দী হন এবং ১৬/০৯/১৯৭৩ ঘটে সেই ঘটনা, যা দিয়ে শুরু করেছি এই কাহিনী।

এরপর - এরপরের কথা আরও চমকপ্রদ
চিলির রাস্তায় এখন যে ‘রাইট টু লিভ ইন পিস’ শোনা যাচ্ছে, সেই গান হারা লিখেছিলেন ভিয়েতনামের যোদ্ধাদের জন্য। যেখানকার যে আন্দোলনের জন্যই কলম ও গিটার ধরেছেন হারা, সেখান থেকেই আবার বাংলায় অনূদিত হয়ে এসেছে গান প্রতিবাদে শান দিতে।

কেন বাংলার কথা এল? এল গণ নাট্য সঙ্ঘের জন্য। হারার গান বাংলায় অনুবাদ করে গণনাট্য সঙ্ঘ বার করে একটি অ্যালবাম - নাম তার ‘খোলা জানালার গান’ । গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গীত বিভাগের দায়িত্বপ্পাপ্ত কঙ্কন ভট্টাচার্যের কথায় শোনা যাক— ‘‘ওঁর সব গান পিনোশের লোকজন নষ্ট করে ফেলত। কোনও ভাবে পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে হারার স্ত্রী জোয়ান ও কয়েক জন কিছু রেকর্ড সঙ্গে নিয়ে পালাতে পেরেছিলেন। জোয়ানআদতে ব্রিটিশ। ইংরেজি অনুবাদ করে তিনিই হারার গান ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তাঁর পাঠানো গান থেকেই আমরা ‘খোলা জানালার গান’ অ্যালবাম করতে পেরেছিলাম।’’

জোয়ান এখন ব্রিটেন এবং আমেরিকায় ঘুরে-ফিরে থাকেন। জোয়ান ও তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল কঙ্কনবাবুর। পরে ক্যাসেটও পাঠিয়েছিলেন কলকাতায়। কঙ্কনবাবুর কথায়, ‘‘কাছাকাছি তুলনা করলে বলা যায়, হারা অনেকটা আমাদের হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো। দুর্ধর্ষ গলা। গণসঙ্গীত, লোকসঙ্গীত যেমন গাইতেন, তেমনই আধুনিক রোমান্টিক গানেও স্বচ্ছন্দ।’’
তাই কঙ্কনবাবুরা বলছেন, প্রতিবাদের সুর কবে আর দেশ-কাল-ভাষার গণ্ডি মেনেছে!
সব শেষে বলতে চাই দুটি কথা, ভিক্টর হারার গান আজও চিলির (এবং গোটা পৃথিবীর) প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠে ঘোরে আরও পিনোশে - তার নাম মানুষ মনে রাখে তীব্র ঘৃণায়, পল রোবসন আছেন মানুষের ভালোবাসায় - হিটলার আছে মানুষের দুঃস্বপ্নে তার সেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বা মানুষ মারার কারখানার জন্য।

আপনি ভারতবাসী, ভাবুন আপনার পরবর্তী প্রজন্ম কার কথা মনে রাখবে - ডিটেনশন ক্যাম্পের আবিস্কারক দের কথা অথবা যাঁরা তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন তাঁদের কথা?

তথ্যসূত্রঃ আনন্দ বাজার পত্রিকা এবং উইকি পিডিয়া সহ আরও কটি ওয়েব সাইট
চিত্র সৌজন্যঃ আনন্দ বাজার পত্রিকা (ছবিতে ভিক্টর এবং তাঁর স্ত্রী জোয়ান)
শ্রীতোষ - ২৮/১০/২০১৯

No comments:

Post a Comment