22 February, 2020

পথিক।


আমি পথ ভোলা এক পথিক। পথ চলি মনের খুশিতে। পথ চলতে আলাপ হয়, সঙ্গ পাই মানুষের। এইরকম কিছু মানুষকে নিয়েই আমার এ রচনা। মহাকালের – মহাসময়ের স্মৃতিতে এঁরা হারিয়ে যাবেন, তবে যতদিন বাঁচব (নাম হয়তো থাকবে না মনে) এঁরা চির উজ্জ্বল থাকবেন স্মৃতিতে আমার।

বাটালাকুণ্ডু! নাম শুনেছেন পাঠক? তামিলনাড়ুর একটি ছোট্ট গঞ্জ। সেখানে আমি দেখেছিলাম মানুষ। কল্পনা করুন কোন একটি ছোট্ট গঞ্জে আপনি দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষায়, সঙ্গে স্ত্রী এবং কিছু মালপত্র। সেখানে কোন মানুষ আপনার কথা বোঝে না, আপনিও বোঝেন না তাদের কথা, আপনি শুধু যেখানে যাবেন তার নাম টা বোঝাতে পারছেন।  আমরা যাব কোদাই রোড স্টেশনে। কোদাইকানালের বাস আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেছে। একটি মানুষ আমাকে ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন – “তুমি দাঁড়াও, বাস আসবে এখানেই”। শুধু কি তাই, বাস যখন ঢুকল, কোথা থেকে ছুটে এসে আওয়াজ – “বাস, বাস”! বুঝে নিতে এতটুকু কষ্ট হল না, এই বাস টিই আমাদের নিয়ে যাবে আমাদের অভীষ্ট গন্তব্যে। নাম জানা হয় নি কিন্তু কি করে ভুলব সেই হাসি মুখের মানুষটিকে – লুঙ্গি পরা, খালি গা।

কি করে ভুলব, কোদাইকানালের সেই বাস ড্রাইভারকে, বাস স্টার্ট করার পরেও চায়ের দোকান থেকে এক বিদেশী (ইংরাজী) ভাষা জানা ভদ্রলোককে দিয়ে দোভাষীর কাজ করান এবং আমাকে জানিয়ে দেন কিভাবে আমি পৌঁছাতে পারি কোদাইকানাল থেকে কোদাই রোড স্টেশনে।

ভুলতে পারি না বাটালাকুণ্ডুর সেই বাস কন্ডাক্টারকে – ভুলতে পারি না তার শিশুর মত হাসি, যখন আমি জানতে চাইছিলাম এবং সে বলতে চাইছিল বাটালাকুন্ডু থেকে কোদাই রোড যাওয়ার ভাড়া। বাংলার মাটিতে আমার জন্ম – এ মাটির রসে, ভালোবাসায় আমি পুষ্ট। এ মাটি আমার মা কিন্তু আমার এই মাটিতে – এই বাংলায় অনেক সময় আমি সে সম্মান পাই নি, যা আমাকে দিয়েছিলেন সেই মানুষটি। অপরিচিত স্থান – ভাষা অপরিচিত। বাসে বসে আমরা দুজন জানলা দিয়ে নজর রাখছি রাস্তার মাইল পোষ্টের দিকে। হঠাৎ করে দেখি সামনের গেটের দিকে টিকিট কাটা বন্ধ রেখে এসে দাঁড়ালেন আমাদের সীটের সামনে, ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন পরের স্টপেজই হল আমার অভীষ্ট গন্তব্য। শুধু তাই নয়, গেটে দাঁড়িয়ে যারা বাসে উঠবেন (মনে রাখবেন লোক্যাল বাস) তাঁদের আটকে রেখে প্রথমে আমার স্ত্রী কে নামতে দিলেন – তারপর আমাকে এবং আমাদের শত আপত্তি সত্ত্বেও বাস থেকে নামার সময় আমার স্ত্রীকে কোন মাল বহন করতে হয় নি। বাস ছেড়ে চলে গেল, কালো ধোঁয়ার মাঝে উজ্জ্বল হয়ে রইল সেই কালো মানুষ টির হাসি মুখ, যার আছে মান আর আছে হুঁশ।
এরকম ভারতেরই পথে পথে ঘুরেছি আমি। গেছি মূল ভূখণ্ডের বাইরেও দেখেছি মানুষ। আবারও বলি মানুষ! যার আছে মান আর আছে হুঁশ। মানুষ দেখেছি আমি পৃথিবীর পথে! বলিরেখাঙ্কিত জীর্ণ মানুষ তার সহজ সরল চিন্তাভাবনা দিয়ে ভালোবাসে মানুষকে। ভালোবাসে – ভালবাসবে বলে – ভালোবাসার আর এক নাম জীবন বলে।

চানু শেখ – মুর্শিদাবাদের এক সহিস। তার ঘোড়ার নাম টি বড় সুন্দর – শিবানী। নাগপুরের নাগেরা যতই বিষ ঢালতে চান, জেনে রাখুন – এটাই আমার ভারত, এটাই আমার বাংলা, এই আমাদের দেশ। এই দেশেতে চলতে গেলে পায়ে কাঁটা বেঁধে না, এই দেশেতে চলতে গেলে “দলতে হয় রে দূর্বা কোমল”। সে যাক, এ সব কথা আপনারা বুঝবেন না কারণ মনে আপনাদের বিষ, সহজ – সরল সুন্দর মনই তো হারিয়ে গেছে আপনাদের। আমি বলি চানু শেখের কথা। কোন এক শীতের সকালে (কালী পুজোর সময়)  মুর্শিদাবাদের বাস স্ট্যান্ডে যখন এসে দাঁড়ালাম নবাবী আমলের ইতিহাসের গন্ধ গায়ে মেখে নেব বলে, দেখলাম তার টাঙ্গা। আরও অনেকের মাঝে যে বিষয় টা আমার চোখ আর  মনকে টেনে নিয়েছিল, তা হল তার মুখের হাসি। দেখা হল, কথা হল – বললাম, না আমি বলিনি সেই বলল –
“বাবু ঘুরতে এইসেছেন তো, চলেন”।
আমি বলি “কত নেবে”?
“বাবু দেওয়ার নেওয়ার মালিক যিনি, তিনিই ঠিক কইরে দিবেন, আপনি কত দিবেন, আর আমিই বা কত নিব। চলেন তো ঘুইরে দেখেন, ভালো লাগলে যা পারেন, যা আপনার মনে লাগে, দিয়েন। আসেন গো মা জননী, বসেন”। শেষ কথা গুলি সুরিতাকে উদ্দেশ্য করে।
শহুরে মন, সন্দেহবাতিক গ্রস্ত মন, মানুষকে বিশ্বাস না করতে চাওয়া মনের কথা মুখে এল – “ও সব কথা ছাড়ো, কত নেবে তাই বল”।
“বাবু আপনি আজ এইসেছেন, সারাটা দিন ঘুইরবেন, ফিইরবেন, সাঁজবেলায় চইলে যাবেন। আর হয়তো আইসবেন না কোনোদিন, আমি তো এখানেই থাইকব, দুটা বেশি পয়সার জন্য আপনারে ঠকায়ে আমার লাভ কি বলেন? ওঠেন, ওঠেন, ঘুইরে দেখেন, নামার সময় দশ জনারে শুধায়ে যা ল্যায্য মনে হয় দিয়েন। দাঁড়া রে বেটী ছটফট করিস না।“

শুরু হল আমাদের পথ চলা, টাঙ্গা চলার সাথে সাথে মুখ ও চলল চানু শেখের। কত গল্প – কিছুটা সত্যি, অনেকটাই হয় তো কল্পনা। তবুও মনে ছুটে চলল সুবে বাংলার গৌরবোজ্জ্বল অথবা কালিমালিপ্ত ইতিহাসের পথে প্রান্তরে। সকাল আটটায় জলখাবার খেয়ে বহরমপুর থেকে বার হয়েছিলাম, বড় কাটরা মসজিদ দেখে যখন বার হলাম তখন বেলা তিনটে। চানু শেখ বললে
“বাবু কিছু খাবেন না, বেটীর মুখটা যে শুকায়ে গেছে”।
কি অবিচার বলুন তো – আমি হলাম বাবু আর তিনি হয়ে গেছেন বেটী। ওই সময় ওখানে যে দোকান গুলো ছিল তাতে খাবার বলতে সেঁকা পাউরুটি আর চা। চানু শেখের তাতে মন ভরল না, আমাদের শত বারণ সত্ত্বেও সে দৌড়াল তার টাঙ্গা নিয়ে, দশ মিনিটের মধ্যে হাজির  চারখানা ডিম নিয়ে। এসেই হাঁক, এই বাবুকে আর বেটি কে ফেনচ টোস্ট করে দে। মা জননী বেটি হয়ে গেল আর আমি বাবুই পাখির মত “বাবুই” থেকে গেলাম। আমাদের শত অনুরোধেও  এক কাপ চায়ের বেশী কিছু খেল না, আর ডিমের দাম দেওয়ার কথা বলতে তার চোখ যা বলল তার বর্ণনায় নিজের ভাষা হারিয়ে যায়, তাই বাঙালী যাঁকে অন্তরে নিয়ে বাঁচে তাঁর ভাষায় বলি
“সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে
আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার তলে”
দোকানদার বলল “বাবু চানু দা অমনই”। তখন বুঝি নি মাথা নত হওয়ার বাকি আছে আরও।

দিনের শেষে যখন সময় এল হিসাব নিকাশের – তার কথা, যা মনে হয় দেন। কি জ্বালা, এত সুন্দর করে সব ঘুরিয়ে দেখাল, আমাদের সঙ্গে যারা বার হয়েছিল তারা ফিরে এসেছে অনেক আগেই। অনেক ক্ষণ ধরে বলার পর বলল
“বাবু, আমার শিবানীর খোরাকি ১০০ টাকা, আপনি আমায় ১২০ টাকা দেন”।
আমি ওর আড়ালে আশেপাশের লোকেদের জিজ্ঞাসা করে জানলাম  ও যেভাবে আমাদের ঘুরিয়ে দেখিয়েছে, তাতে কম করে ১৭৫ টাকা ওর ভাড়া  হওয়া উচিত। ২০০ যখন ওর হাতে তুলে দিলাম, আমি নয় ও যাকে বেটী বলেছে সে – বুঝল, আর তাই ওর হাত উঠল কেঁপে, আমি বললাম “বেটী বলেছ”। আমার হাত জড়িয়ে ধরল।
আবার তাকে দেখেছিলাম কলজে খাকীর কবরের সামনে, তার শিবানীর সাথে। সেদিন আমরা ছিলাম টাটা সুমোতে আমাদের  আত্মীয়দের সাথে। দেখেই একমুখ হাসি। জিজ্ঞাসা করলাম “কেমন আছো গো”? হেসে বলল “বাবু ভালো আছি, বেটী ভালো আছে তো?” মনটা খারাপ হয়ে গেল, বাবুই হয়ে থাকলাম, বেটা হতে পারলাম না।

এরকম আরও কত মুখ ভিড় করে  আসে চোখের সামনে।  হ্যাভ্লকের ডলফিন নেস্টের আস্তানায় রাত্রিবাস। খানা-পিনা দুইই হবে। আসর বসবে বাগানে – সুন্দর করে সাজানো একটি ছাতার তলায়। দেরী তখনও একটু। সমুদ্রের পাশের পাঁচিলে বসে ছিলাম,  জোয়ারের জল এসে ধুইয়ে দিচ্ছিল পা, হঠাৎ বাঁশিতে ভাটিয়ালি সুর। খুব একটা অবাক হই নি কারণ হ্যাভ্লকের ৯০% অধিবাসী বাঙালী (২০০৪ এর কথা লিখছি)। তবুও স্বাভাবিক কৌতূহলে চোখ খুঁজে নিল মানুষটিকে। চমকানোর পালা এইবার। একটি পিভিসি পাইপ বাজিয়ে সুর ছড়িয়ে চলে যাচ্ছে এক রোগা শরীর। হালকা চাঁদের আলো বাগানের মধ্যে যে আলোছায়ার খেলা দেখাচ্ছিল তার মাঝেতে তার চলে যাওয়া যেন ভেসে যাওয়া সুরের সাথী হয়ে – সঙ্গী হয়ে সঙ্গীতের – সঙ্গতে সমুদ্র তার। আর বসে না থেকে উঠলাম সুরের টানে। দ্রুত সচল পা, মানুষটির সামনে দাঁড় করালো আমায়, জানলাম নাম তার সনাতন। সারাদিন সমুদ্দুরে মাছ ধরে – তারপর এই তার নেশা। আগে নাকি পেঁপের ডালে (!) সুর ছড়াত – এখন সাথী এই পাইপ। বাড়িতে বউ ছেলে আছে সবাই, তবু সন্ধ্যে নামলে মন কেমন কেমন করে – একটু সুর ছড়াতে না পারলে “ঘুম হয় না রাতে, সকাল বেলা শরীরটা কেমন আনচান আনচান করে”।
সেই সন্ধ্যা আমার জীবনের এক অন্যতম স্মরণীয় সন্ধ্যা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ১২৬০ কিমি দূরে আমার মাটির গান – আমার লোক সঙ্গীতের সুর ভুলিয়ে দিয়েছিল প্রবাস জীবনের যাতনা। খানা – পিনা ভুলে সনাতনের সনাতন সুরে মাতোয়ারা আমরা। সেই সুরের নেশার চেয়ে বড় নেশা পাই নি আজও। সনাতন – হ্যাভ্লকের সেই সন্ধ্যা আমাদের এক ইটার্নিটি, প্রবাসী বাঙালী নাকি বাংলা ভুলে যায় – ভোলে না যদি সে সনাতনের মতন হয়। মাটি মায়ের গন্ধ গায়ে মাখা সনাতন।

বলতে গেলে বলতে হবে, বলার শেষ নাহি হবে। তবুও থামতে হয়। থামার আগে বলে যাই – জীবনের চলার এ পথে আবার আসব ফিরে ফিরে, আমায় যদি নাও বা চাও বারে বারে যাব তোমাদেরই কাছে – অন্য কোন রূপে, অন্য কোন নামে। বলে যাব আমি তোমাদেরই কথা – কথা মানুষের।
(লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়  সংবাদ গড়িয়া পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ, উনবিংশ সংখ্যা, মাঘ ১৪১৪, জানুয়ারি – ফেব্রুয়ারি মাসে)

No comments:

Post a Comment