23 October, 2018

চারখোল – যেখানে প্রকৃতি কথা বলে।

পরবাসী জীবনের কথকতা – চারখোল ভ্রমণ
চারখোল – যেখানে প্রকৃতি কথা বলে।
চারখোলের নাম প্রথম পড়ি @Tushar Kanti Bapi Chakrabarty এর পোষ্টে। আমাদের @Kunal Harmad Guhaসেখানে একটি নতুন হোটেল খুলেছে। পোষ্টের সাথে যা ছবি ছিল তা আমাকে আকর্ষণ করার পক্ষে যথেষ্টরও বেশী ছিল। ফলত গ্যাংটক পোস্টিং হওয়ার সাথে সাথেই বাপীদার সাথে যোগাযোগ করি এবং তারপরেই যোগাযোগ হয় কুণালের সাথে। ঠিক হয় পুজোর ৪ দিন ওখানেই কাটাব। হোয়াটস্‌ অ্যাপ এবং মেসেজের সহায়তায় বাকি ফর্মালিটি শেষ হয় এবং ১৬/১০/২০১৮ তে গ্যাংটক থেকে যাত্রা শুরু চারখোলের পথে। গ্যাংটক থেকে কালিংপং সময় লাগল প্রায় ৩ ঘণ্টা। কালিংপং এ কুণালের থাকার কথা, ওর সঙ্গে ফোনে কথাও হল কিন্ত ও কিছু কাজে আটকে গেছে, ফলে অপেক্ষার পালা শুরু। অস্বীকার করব না একটু বিরক্ত লাগছিল কারণ এর আগে দু – একটি ক্ষেত্রের বাজে অভিজ্ঞতা মনে পড়ে যাচ্ছিল, তবুও কোথাও একটা ভরসা ছিল যার দুটো কারণঃ প্রথমত বাপীদার রেফারেন্স এবং দ্বিতীয়ত কুণালের সাথে ফোনে যে টুকু কথা হয়েছিল তাতে ওকে দায়িত্ব বোধ সম্পন্ন বলেই মনে হয়েছিল। ও কিন্ত ফোনে জেনে নিয়েছিল যে আমরা কোথায় অপেক্ষা করছি এবং ওর কথায় ওটা কালিংপং এর অন্যতম সেরা একটি হোটেল (নাম কলস – ঠিক কালিংপং এস বি আই এর বিপরীতে) যার মধ্যে কোন রকম অত্যুক্তি ছিল না। একটা সুবিধে হয়েছিল, হোটেলের জানলা দিয়ে কালিংপং এর স্টেডিয়াম দেখা যাচ্ছিল এবং সেখানে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিল, ফলে সময় কাটাতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না। অনুষ্ঠান দেখায় মগ্ন, হঠাৎ করেই আওয়াজ “স্যরি দাদা, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল”, ফিরে তাকিয়ে দেখি কুণাল। দু মিনিটের মধ্যে এমন পরিস্থিতি দাঁড়াল যে মনে হল আমরা যেন কত দিনের চেনা। আসলে ওর কিছু কেনাকাটা ছিল এবং ওর এক ভাইয়ের ছেলে কলকাতা থেকে আসছিল, যে আমাদের সাথেই চারখোল যাবে – এর জন্যই দেরী, তাছাড়াও সেদিন ওখানকার হাট বার তাই গাড়ি পাওয়াও মুস্কিল ছিল। সব মিলিয়ে এই দেরী। যাই হোক, আমরা কালিংপং ছাড়লাম প্রায় ৩ টে নাগাদ। রাস্তার দু পাশের সৌন্দর্য এবং গল্প কথায় পথ কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। গাড়ি এসে পৌঁছাল চারখোল, পাকা রাস্তা ছেড়ে এবার পাহাড়ে পাথুরে রাস্তা ধরল আমাদের চতুঃচক্র যান। অনেক দিন পরে এই রকম পাথুরে রাস্তার পথে চলা, আরও কিছু সময়, গাড়ি এসে থামল একটি ছাদের পাশে – হোটেল ক্রাউন ইম্পিরিয়াল। আমাদের থাকার ঘর অবশ্য মূল হোটেলে নয় তার চেয়ে আর এক ধাপ উঁচুতে আর একটি বাড়ির দোতলায়। মালপত্র চলে গেল সেখানে আর আমরা দুজনে নিচে নেমে এলাম। হোটেল ছোট কিন্ত তার বারান্দার ঠিক সামনে থেকে শুরু হয়েছে ঘন জঙ্গল যা ক্রমশ নিচের দিকে নেমে গেছে। মূল হোটেলে চারটি ঘর এবং অন্য বাড়িটিতে দুটি। খাওয়ার জায়গা এবং রান্না ঘর একই সাথে এবং দুটিই কাঠের তৈরি। জেনে ভালো লাগল, আমরা দুজন ওই হোটেলের প্রথম অতিথি। হোটেলে ঢোকার সাথে সাথে হাতে এল হোটেলের নাম, ই মেল এবং ওয়েব সাইটের পরিচয় দেওয়া এক সুদৃশ্য ব্যাগ যার মধ্যে ঘরের চাবি ছাড়াও রয়েছে একটি সাবান, নেল পালিশ এবং দুটি চুলের ব্যান্ড। আলাপ হল কুণালের মায়ের সাথে, রান্না ঘরের মূল দায়িত্ব ওনার হাতে। অত দেরী হয়ে গেছিল, তাই ভাতের বদলে চাউমিন দিয়ে সাময়িক ক্ষুধা নিবৃত্তি হল। তখন সন্ধ্যা নেমেছে।
ডাইনিং স্পেসের আলো নিভিয়ে দিতে বললাম, সাথে সাথেই এক অন্যরকম সৌন্দর্যের মধ্যে হারিয়ে গেলাম আমরা। ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ, মাঝে মাঝে দু একটি রাত চরা পাখির ডাক – আমরা চুপ করে শুনতে লাগলাম জঙ্গলের কথা। হঠাৎ করে অন্য রকম একটি শব্দ কানে এল, খুব ক্ষীণ ভাবে। কুণালের দিকে তাকাতে ও ফিস ফিস করে বলল বারকিং ডিয়ার এর ডাক। ভালো করে শোনার চেষ্টা করে বুঝলাম একটি নয় দুটি হরিণ ডাকছে। একটু বাদে আওয়াজ বেশ স্পষ্ট হল। তার কিছুক্ষণ বাদে আবার ক্ষীণ হতে হতে মিলিয়ে গেল। আমরা তখন মেঘের মাঝে বসে। এবার নিজেদের ঘরে যাওয়ার পালা। থ্রি বেডেড রুম, অ্যাটাচড বাথ, বাথরুমে ব্যবহারের জন্য একটি বাথরুম স্লিপার – এক কথায় সুন্দর সাজানো ব্যবস্থা। জার্নি করে ক্লান্ত ছিলাম তাই একটু বিশ্রাম নিতে গিয়েও মনে হল সামনের ব্যালকনিতে বসলে কেমন হয়? এর মধ্যে চলে এসেছে টিফিন – গরম মুড়ি বাদাম দিয়ে ভাজা সাথে পেঁয়াজি। শীতের জায়গায় যাচ্ছি তাই গরম পানীয় সঙ্গে নিয়েই গেছিলাম। অতএব আর দেরী না করে ব্যালকনিতেই বসলাম দুজনে। নিজেদের মধ্যে কোন কথা নেই, মাঝে মাঝে পানীয়তে চুমুক আর মেঘের খেলা দেখা। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হচ্ছে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে আর জঙ্গলের মধ্যে বয়ে চলা বাতাসের সরসর শব্দে। কতটা সময় চলে গেছে খেয়াল নেই, হঠাৎ কুণালের ডাকে সম্বিত ফিরল। রাতের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। খাওয়ার জায়গায় গেলাম। মাসিমা আগেই বলেছিলেন চমক থাকবে। ছিল চমক। গরম ভাতে ঘি দিয়ে শুরু – আহা সে ঘিয়ের গন্ধ কি! পাশে দেখি কিছু একটা মাখা রাখা আছে। জিজ্ঞাসা করতে মাসিমা বললেন “খেয়ে বলতে হবে”। মুখে নিতেই স্বাদ যন্ত্র বাহা বাহা বলে উঠল। মাসিমা জিজ্ঞাসা করলেন “ভালো লাগছে? কি বলত?” আমি উত্তর দিতে পারলাম না, সুরিতা বলল “কচু বাটা”। মাসিমা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন। আমি অবাক, জীবনে কোনদিন কচু বাটা খাই নি, তার স্বাদ এত অপূর্ব হতে পারে তা আমার চিন্তার বাইরে ছিল। সুরিতা বলল, “কি কচু বাটা খেয়ে নিলে তো?” আমি বললাম “এই রকম রান্না হলে আর তো কিছু করার থাকে না, আমি তো এইটা দিয়েই পুরো ভাত খেয়ে নিতে পারি”। চমকের বাকি ছিল আরও – পোস্ত দিয়ে কাতলা মাছ! সেও দারুণ খেতে। এরপর চাটনি। একদম প্ল্যাস্টিক চাটনির মত স্বাদ। হায় রে, সে নাকি স্কোয়াশ দিয়ে তৈরি। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি এর মধ্যেই মাসিমার কাছে কাছে আমি ছেলে আর সুরিতা মেয়ে হয়ে গেছে। খাওয়া শেষ হলে মনে হল পুরো অজগর। রাতে এত বেশী কখনও খাই নি।
বাকি কথা পরের পর্বে।

No comments:

Post a Comment