আজ মন চলে যাচ্ছে আজ থেকে ২৯ বছর আগে – ১৫ই জুলাই, ১৯৯১। হ্যাঁ, আজ থেকে ২৯ বছর আগে এক ২১ শের কিশোর পা রেখেছিল গঙ্গা পারের ওই বাড়িটার ভিতরে, লোকে যাকে চেনে কাস্টমস্ হাউস বলে। সেদিন তার দু চোখে ছিল স্বপ্ন আর বুকের ভিতরে ছিল এক গর্ব – এক লড়াই জেতার গর্ব। সে যখন ওই বাড়িটার ভিতর পা রাখছে, তখন তার মনে পড়ে যাচ্ছিল ১৯৯০ সালের ২৭ শে অক্টোবরের সকালের কথা। হ্যাঁ, সেই দিন সকালে সেই ছেলেটি তার প্রেমিকার বাবার সামনে দৃপ্ত ঔদ্ধত্যে বলেছিল “এক বছরের মধ্যে আমি নিজের ক্ষমতায় সরকারী চাকরী জোগাড় করব এবং জোগাড় করব কোন অসৎ পথ অবলম্বন না করে বা কোন ব্যাকিং এর সাহায্য না নিয়ে”। তারপরের দিন গুলো কেটে গেছিল কেমন ভাবে – সকাল ৪ টেয় দিন শুরু হয়ে রাত ১১ – ১২ টায় শেষ হত দিন। না, একবারের জন্যও তার মনে হয় নি সে কোন রকম পরিশ্রম করছে, তার মনে হত সে মন দিয়ে নিজের কাজ করছে। এর মধ্যেও সে আড্ডা মেরেছে, সিনেমা দেখেছে, টিউশনি করেছে – একটি সেই বয়সী মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান যা যা করে, সব কিছু করেছে। আর করেছে চেষ্টা। এই চেষ্টার পিছনে শুধু ভালোবাসা ছিল কি? ছিল অবশ্যই কিন্তু তার সঙ্গে ছিল আরও কিছু শব্দ।
ছেলেটির বাবা সেন্ট্রাল এক্সাইজ দপ্তরে ইন্সপেক্টর পদে চাকরী করতেন। স্বাভাবিক ভাবেই অনেক মানুষের সাথে পরিচিতি। সেই পরিচিতি আরও বেড়েছিল কারণ মানুষটি ছিলেন আদ্যন্ত পরোপকারী। অফিসের সহকর্মী দের যে কোন বিপদে তিনি সদা হাজির। একদিন ছেলেটি শুনল তার মা তার বাবা কে বলছেনঃ
“তোমার তো এত জানাশোনা, দাও না ওকে কোন চাকরীতে ঢুকিয়ে”
বাবার উত্তরঃ
“আমাদের ছেলেকে চাকরীতে ঢুকিয়ে দিতে হবে না, সে চাকরী জোগাড় করে নেবে তার নিজের ক্ষমতায়। ওর সে যোগ্যতা আছে এবং ওর উপর আমার সে বিশ্বাস আছে”।
আজ এতদিন পরেও সেই শব্দগুলো আজও তার কানে বাজে।
নিজের প্রতিজ্ঞা আর তার উপর তার বাবার বিশ্বাস – এই দুইয়ের মর্যাদা রক্ষিত হয়েছিল সেইদিন। আরও মজার কথা, সে কাস্টমস্ হাউসে ঢুকেছিল তার বাবার হাত ধরেই – ওই একই দপ্তরে লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক হয়ে। এস এস সি পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরী – অন্য যে কোন দপ্তরেই হতে পারত কিন্তু ঘটনার এক আশ্চর্য সমাপতনে সে হয়ে উঠল এক ফ্ল্যাগ বেয়ারার।
কবি লিখেছেন “তোমার পতাকা যারে দাও / তারে বহিবারে দাও শকতি”। সে জানে না তার শক্তি ছিল না কি নেই, শুধু এটা জানে তার বাবা সেই বিভাগের যে পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন, এই মুহূর্তে সে তার থেকে এক ধাপ উঁচু পদে বসে আছে।
আজ আরও একটা কথা ছেলেটির মনে পড়ে যাচ্ছে। দপ্তরে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পরে একজন সিনিয়র অফিসার (ডেপুটি অফিস সুপারিন্টেনডেন্ট) তাকে বলেছিলেন
“আজ এত কাজের উৎসাহ, আমাদের বয়েসে এলে দেখব কাজের সেই উৎসাহ কোথায় থাকে?”
আজ বিনীত ভাবে সেদিনের সেই ছেলেটি বলছে,
“কাজের সেই উৎসাহ, কাজের প্রতি সেই নিষ্ঠা এবং ভালোবাসা ও দায়িত্ব বোধ আজ ২৯ বছর পরে ও একই আছে। যোগ হয়েছে অভিজ্ঞতা। সে এখন যে জায়গায় কর্মরত সেখানে যোগ দেওয়ার পর থেকে একই সাথে একাধিক দায়িত্ব ভার নিয়ে তাকে চলতে হচ্ছে যার মধ্যে অন্যতম প্রধান দায়িত্ব “অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার” এর। এই লক ডাউন পিরিয়ডে গত তিন মাস ধরে মাত্র একজন জুনিয়র অফিসারের সাহায্য নিয়ে সে ডিভিশনে কর্মরত সমস্ত অফিসার যাতে সময়ে তাঁদের মাসিক বেতন পান, তা নিশ্চিত করে গেছে এবং এখনও করছে এবং সে বিশাল বড় কোন কিছু করছে না, প্রশংসা পাওয়ার মত কোন কাজও করছে না বড়বাবু, সে শুধু নিজের কাজ করছে, যে কাজ করার জন্য সরকার তাকে মাইনে দেয়।“
সেদিনের সেই একমাথা চুল ওয়ালা ছেলেটার মাথায় পড়েছে টাক, দাড়ি গেছে পেকে, সে আজ চাকরী জীবনের ২৯ বছর পার করে এসে পা দিল ৩০ তম বছরে (মনে হয় যেন সেদিনের কথা)। সেদিনের সেই ছেলেটার নাম হল প্রয়াত প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বড় ছেলে শ্রীতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
২৯ বছর আগের ১৫ – ১৯ই জুলাইয়ে তার সাথে একই সাথে যোগ দিয়েছিল আরও কিছু বন্ধু। বুলবুল চক্রবর্তী, গৌতম সরকার, পার্থ মিত্র, শেহনাজ আখতার, পীযূষ ঘোষ, প্রবীর ঘটক, সৌভিত গোস্বামী (এক দুজনের নাম কি বাদ পড়ে গেল)। এর মধ্যে বুলবুল ১৫ তারিখেই যোগ দিয়েছিল, পার্থ – গৌতম – শেহনাজ যোগ দিয়েছিল ১৬ তারিখে (বাকিদের তারিখ মনে নেই)। এঁদের সব্বাই কে জানাই কর্মজীবনের ৩০ বছরে পা দেওয়ার শুভেচ্ছা। আরও বেশ কিছু বন্ধু আছে যেমন রজত বিশ্বাস, অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদিরা এঁরাও এই জুলাই মাসেই পা দিচ্ছে চাকরী জীবনের ৩০ তম বছরে। সব্বাইকে জানাই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।
একটি দুঃখের স্মৃতিও জড়িয়ে আছে আজকের দিনটির সাথে। (খুব সম্ভবত ১৯৭০ সালে) আজকের দিনেই প্রয়াত হন আমার "ভাইয়া" (দাদু) ঁসুধীর মুখোপাধ্যায় (যাকে আমি জ্ঞানের চোখে দেখিনি, শুধু ছবিতে দেখেছি আর জেনেছি নাতিদের মধ্যে একমাত্র আমিই তাঁর কোলে ওঠার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম)। যদি সন ঠিক হয় তাহলে ৫০ বছর হয়ে গেল এই মর জগতের মায়া কাটিয়ে তাঁর চলে যাওয়া।