25 September, 2024

“পুরানো সেই দিনের কথা” ঝালদা পুরুলিয়া ঝাড়খণ্ড

 

প্রস্তুতি ছাড়া কোন ঘটনা ঘটে না এটা প্রকৃতির নিয়ম। মানুষও প্রকৃতির এক অংশ। যেমন একটি প্রদীপ জ্বালাতে গেলে একটি পাত্র লাগে,লাগে তেল, লাগে সলতে এবং লাগে আগুন। সলতে পাকাতে লাগে তুলো বা কাপড়। আজ যে ঘটনার কথা বলতে চলেছি তার শিরোনাম হতেই পারে

“পুরানো সেই দিনের কথা”।

 

১৯৯০ সালে একজন কে নিজের সারা জীবনের সঙ্গী করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তার আগেও তার সাথে যখন প্রাক কথন চলছিল তখন তার সাথে শেয়ার করেছিলাম নিজের অনেক কথা। সেটাই ছিল তুলো বা কাপড়। তারপর জীবন সঙ্গী হলাম – শুরু হল সলতে পাকানো। সলতে পাকানো চলছে কিন্তু প্রদীপ খুঁজে পাচ্ছিলাম না, প্রদীপ খুঁজে পেলে তবেই না আগুনের খোঁজ এবং তারপরেই তো জ্বলবে আগুন। প্রদীপের খোঁজ এল ২০১৯ সালে। সে  অদ্ভুত এক সময়, প্রদীপের খোঁজ এল সেই সময়ে। সলতে আছে, আছে প্রদীপ কিন্তু প্রচণ্ড বাতাস, পৃথিবী ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। মানুষ অমানুষ হয়েছে মুখোশের আড়াল থেকে বেরিয়ে পড়েছে রক্ত মাখা লোভী শ্বাপদ মুখ। তাদের হিংস্র দাঁত আর নখরে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। রাস্তায় রাস্তায় হাহাকার – পড়ে আছে রক্তমাখা শরীর। এক সময় বাতাস শান্ত হল। সব কিছু ছিল তখন বাকি ছিল ইচ্ছা, আগুন হয়ে উঠল সে ইচ্ছা – জ্বলল প্রদীপ ২০২১ সালে।

 

১৯৮৪ সালে বাবা বদলী হলেন ঝালদায়। ফলে পরিবারের সকলের সাথে আমাকেও চলে আসতে হল। এসে ভর্তি হয়েছিলাম ঝালদা সত্যভামা বিদ্যাপীঠে – আমি তখন ক্লাস ১০। পুরানো নিয়ম অনুসারে পরের বছর মার্চ মাসে মাধ্যমিক পরীক্ষা। ঝালদা সত্যভামা বিদ্যাপীঠে ১০ বি সেকশনের রোল নাম্বার ৫২। প্রধান শিক্ষক ছিলেন শক্তিপদ মাহাতো, একই সাথে ছাত্র দরদী অন্যদিকে ভীষণ কড়া। মনে আছে, প্রথম দিন স্কুল শেষের পরে বাড়ি ফিরেছিলাম চোখের জল ফেলতে ফেলতে কারণ একমাত্র অঙ্ক এবং ইংরেজি ছাড়া আর কোন ক্লাসেই স্যারেরা কি পড়ালেন তার প্রায় কিছুই বুঝতে পারি নি। আসলে কলকাতার ভাষার সাথে মানভূম অঞ্চলের কথ্য ভাষার এক বিশাল ফারাক। ভাবছিলাম, সামনে মাধ্যমিক, স্যারেরা কি বলছেন সেটাই যদি ঠিকঠাক বুঝতে না পারি তাহলে ক্লাস করব কি করে আর পরীক্ষায় পাস করবই বা কি করে? বুঝতেও পেরেছিলাম এবং পরীক্ষায় পাশ ও করেছিলাম। ১৯৮৪ র জানুয়ারি থেকে ১৯৮৭ র জুলাই – দিনগুলো আজও আমার জীবনে স্বপ্নের মত। এক সোনালী সময় ছিল সেই দিন গুলো। আর যারা সেই দিনগুলো কে সোনালী বানিয়ে তুলেছিল তারা ছিল আমার বন্ধুরা। টুম্বা (দীপঙ্কর), অপু (পরাগ), জগু (মুকুল), শইক্ত্যা (শক্তি), মিঠু (সুমিত), কুন্তল, অজিত, অচিন্ত্য, অশোক, কাইজল্যা (কাজল), দেবেশ, জুরান, অনুপ, অসীম, মোধা (মধুসুদন) (এছাড়াও আরও বেশ কিছু নাম হারিয়ে গেছে স্মৃতির অতলে – আবছা চেহারা মনে পড়ে) – ক্লাস টেন এ এদের সাথেই ছিল বেশী ঘনিষ্ঠতা। টুম্বা (দীপঙ্কর), অপু (পরাগ), জগু (মুকুল), শইক্ত্যা (শক্তি), মিঠু (সুমিত), কুন্তল, অজিত, অচিন্ত্য, অশোক, কাইজল্যা (কাজল), দেবেশ – আমরা এই কজন একসাথে স্কুলে না গেলেও ফিরতাম মোটামুটি একসাথেই। বিকেলে ঝালদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আড্ডা মেরে চলে যেতাম প্রাইভেট পড়তে।  ইলেভেনে এসে যোগ দিল লক্ষ্মী, রুদ্রেন্দু সহ আরও কজন। পড়াশুনা, আড্ডা, খেলাধুলা – এই সব নিয়ে ঝড়ের গতিতে কেটে গেছিল দিনগুলো। ঝালদায় শেষ বার দেখা হয়েছিল টুম্বার সাথে ১৯৯০ সালে – মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট আনতে গেছিলাম। তারপর দীর্ঘ ২৩ বছর পরে আবার যোগাযোগ টুম্বার সাথেই। মাইথনে ওর কোয়ার্টাস এ কাটিয়ে এসেছিলাম ৩ – ৪ টে দিন। মুকুলের সাথে ফোনে কথা হত, বার বারই দেখা করার ইচ্ছা হত কিন্তু সে ইচ্ছা বাস্তব হয়ে উঠছিল না।

 

সুরিতাকে বার বারই বলতাম একদিন তোমাকে নিয়ে যাব, দেখাব ঝালদা, পরিচয় করিয়ে দেব বন্ধুদের সাথে কিন্তু একটি কারণেই যাওয়া হয় নি, তা হল থাকার জায়গার অভাব। ইচ্ছাটা মনেই থেকে যাচ্ছিল। একদিন গ্যাংটকে অফিসে বসে কাজ করছি হঠাৎ ফোন। “কি রে চিনতে পারছিস”? ট্রু কলার এর দৌলতে নাম ভেসে ওঠে। দেখলাম লক্ষ্মী কান্ত দত্ত, সন্ন্যাসী লজ, তুলিন। মনে পড়ে গেল, লক্ষ্মীর কথা। ওর বাড়ি তো তুলিনেই ছিল – ওই কি? বললাম, “লক্ষ্মী নাকি?” বলল “হ্যাঁ রে’ – কথায় সেই মানভূমি টান। জিজ্ঞাসা করলাম, “আমার নাম্বার পেলি কি করে?” বলে ফেসবুকে তোর ছবি দেখলাম তারপর জগুকে ফোন করে জানলাম তুই ই সেই শ্রীতোষ। ওর কাছ থেকেই নাম্বার পেলাম, আর তোকে ফোন কইরল্যাম। হু হু করে মন চলে গেল পিছনে, মনে হল ফিরে গেছি ঝালদায়। অফিসের কাজ – সে তো আছেই, সারা জীবন থাকবে। পুরানো বন্ধুকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দে চোখ তখন ভরে উঠেছে জলে। এবার এল ডাক। আমি তুলিনে লজ খুলেছি, থাকার কোন চিন্তা নেই, চলে আয়। সব্বাইকে বলছি। আমি তো রাজিই। মুকুলের সাথে কথা হল। ও ও রাজি কিন্তু ফাইনালি যাওয়া আর হয় না। ২০১৯ এর নভেম্বরে আমি ঘুরতে গেলাম দুয়ারস। ২০২০ র ডিসেম্বর – কালিংম্পং হয়ে লামাহাটা ইত্যাদি। মাঝে ঘোরা হয়ে গেল চারখোল, আরিটার, মূল খাড়কা, ঋষি খোলা, পেলিং – এই সব জায়গা। ঝালদা আর হয়ে ওঠে না। লক্ষ্মী মাঝে মাঝেই ডাক পাঠায় – যাওয়া আর হয় না। শেষে ২০২১ শে ঠিক করলাম না এবার যেতেই হবে। সেই ভাবেই এক শনিবার দুজনে উঠে বসলাম রাঁচি ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসে। দুপুরে ট্রেন ছাড়ল হাওড়া থেকে – ট্রেনের চেয়ে আগে চলে মন। মজার কথা হল, আমরা নামব মুরিতে আর ট্রেন যাবে ঝালদার উপর দিয়েই।   ঝালদার একটু আগে থেকেই ট্রেনের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলাম – ১ মিনিটের স্টপেজ তাই ওখানে নামি নি তবে অনেক দিন পরে দেখলাম সেই পুরানো প্ল্যাটফর্ম টা। মন তখন ফিরে গেছে সেই সে দিন গুলো তে। কথা ছিল লক্ষ্মী থাকবে মুরিতে। প্রায় ২০ মিনিট দেরীতে ট্রেন ঢুকল। বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে অঝোর ধারায়। মুরি প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দাঁড়ায় নি তখনও, দেখলাম লক্ষ্মী। প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে মালপত্র নিয়ে নিল। গাড়ি দাঁড়িয়ে বাইরে। ছাতা খোলার সময় নেই, বৃষ্টি ভিজেই উঠে পড়া গাড়িতে। ১০ মিনিটের মধ্যেই সন্ন্যাসী লজ। দোতলায় সুন্দর করে সাজানো রাস্তার ধারের এক ডবল বেড রুমে দুজনের থাকার ব্যবস্থা। লজের লোকই মাল পত্র তুলে দিল, আমরা বসে পড়লাম আড্ডায়। উল্টো দিকের হোটেল থেকে গরম চা আর স্ন্যাক্স চলে এল। সেদিন বেশী ক্ষণ কথা হল না, আমরা দুজনেই ক্লান্ত ছিলাম। রাতের খাবার খাওয়া ওই হোটেলেই। চমৎকার খাবার – ঘরের মত রান্না। খেয়ে দাম দিতে যাব – দাম নেবে না কারণ বন্ধু বারণ করে দিয়েছে। এমনিতেই আমার সাথে তর্ক চলছিল। যতদিন আমি তুলিনে থাকব, ঘর ভাড়া এক টাকাও নেবে না। তাও না হয় মানা যায় কিন্তু খাওয়া খরচাও নেবে না – এ কেমন কথা?

যাই হোক, পরের দিন আর কোথাও বের হওয়া ছিল না, ঘোরা শুরু হবে তার পরের দিন থেকে। লক্ষ্মীর সাথে আলোচনা করেই প্ল্যান করেছিলাম এই ভাবেঃ

পৌঁছানর পরের দিন রেস্ট (সম্ভব হলে ঝালদা যাওয়া)

৩য় এবং ৪র্থ দিন অযোধ্যা পাহাড় ও আশে পাশের জায়গা ঘোরা, ৩য় দিন অযোধ্যায় রাত্রিবাস।

৪র্থ দিন তুলিনে রাত কাটিয়ে ৫ম দিন জোনহা, হুড্রু দেখে পাত্রাতু ভ্যালি তে রাত কাটানো। ৬ষ্ঠ দিন পাত্রাতু থেকে বার হয়ে রাজারাপ্পা দেখে তুলিন এ রাত কাটানো।

৭ দিন ঝালদা যাওয়া – পুরানো বন্ধুদের সাথে দেখা করা।

৮ম দিন তুলিন থেকে বার হয়ে দশম ফলস দেখে নেতার হাট। ওখানে ২ রাত কাটিয়ে বেতলা। বেতলায় দুরাত কাটিয়ে রাঁচি থেকে রাত্রে রাঁচি – হাতিয়া এক্সপ্রেস ধরে কলকাতা ফেরা।

 

এবার কথা শুরু হোক “এ কেমন কথা থেকে”

পরের দিন সকালে লক্ষ্মীর সাথে আবার দেখা হল। ওর নিয়ম –

সকাল সাড়ে ৭ টায় সন্ন্যাসী লজে আসবে, লজের ব্যবস্থা পনা দেখবে এক দু কাপ চা খাবে সাথে দু চারটে সিগারেট বা বিড়ি, ৯টা সাড়ে ৯ টা নাগাদ বার হয়ে যাবে – সারাদিন ব্যস্ত থাকবে পারিবারিক ব্যবসায়। আবার বিকেলে আসবে। সারাদিন কাজে ব্যস্ত।

বাংলা পরীক্ষায় একটা প্রশ্ন এসেছিল

কর্তা কে?

উত্তর দিয়েছিল এক অবাধ্য ছাত্র (যে ব্যকরণ জানে না)

“যিনি কাজ কম্ম নিয়ে থাকেন”

এটাই হল লক্ষ্মী।

আর লক্ষ্মী কি করে লক্ষ্মী হয়েছে

তাও দেখেছি আমি নিজের চোখে

সে এক অন্য গল্প।

সে গল্প থাক পরবর্তী সময়ের জন্য।

 

লক্ষ্মীকে অনেক করে বুঝিয়ে রাজি করালাম খাবার দোকানে পয়সা দেওয়ার জন্য।

সেদিন সেই অর্থে রোদ ওঠে নি তবে বৃষ্টি কমেছে।

সকালেই শইক্ত্যাকে ফোন করলাম।

ও অবাক।

ও বুলতে ভুলেই গেইঞ্ছি

গ্যাংটকে শইক্ত্যার সাথেও কথা হয়েছিল।

আসলে শইক্ত্যাই ফোন করেছিল।

ওকে বুলেছিল্যাম

আমি আইসব্য রে।

শইক্ত্যাকে ফোন করে বুললাম

আমি এইস্যে গেছি।

 

কইলকাঁতা ত্যুই এইস্যেছিস

১৯৮৪ থেকে ১৯৯৭ ওরা আমাকে কোল

বা  কইলকাঁতা বলে ডাকত।

স্কুটার চালিয়ে চলে এল শইক্ত্যা

সেই সন্ধ্যায়।

সে এক অন্য সন্ধ্যা।

কত গল্প – কত সে কথা – কত কথকতা।

সময় পার হয়ে যায় কথা শেষ হয় না।

 

আসলে এ লেখা তো বেড়ানোর গল্প নয়

এ লেখা নিজের পুরানো ভালো বাসাকে

ভালোবাসার গল্প।

সে সন্ধ্যা ছিল আর এক সন্ধ্যা

আসলে তুলিনে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের দুজনের কাছে অনন্য।

 

লক্ষ্মীর সাথে করা পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩য় দিন সকালেই গাড়ি এসে গেল – সারথি মেঘনাদ।

 

যাত্রা হল শুরু।

প্রথম গন্তব্য খয়রাব্যেড়া বাঁধ। মানভূম এর ভাষায় (বীরভূম - বাঁকুড়া – বিষ্ণুপুর – পুরুলিয়া) বাঁধ অর্থে বড় পুকুর অথবা ঝিল। যেমন রানী বাঁধ, সাগর বাঁধ ইত্যাদি, কিন্তু এটা সত্যিই বাঁধ বা ড্যাম। অপূর্ব সুন্দর। চারিপাশে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। টলটলে জল। পথে দেখবেন বেশ কিছু ক্যানাল যা যেমন চাষের কাজে লাগছে তেমনই লাগছে মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে। একটা রিসর্ট আছে। শুনলাম সে রিসর্ট বড় বড় মানুষদের জন্য। কিছু ছবি তুললাম যদিও আকাশ সাথ দিচ্ছিল না। কিছু সময় কাটিয়ে আবার পথ চলা। এবার চড়িদা গ্রাম। বাংলার এক অনন্য শিল্প ছৌ নাচ। সেই নাচের মুখোশ তৈরি করেন এ গ্রামের মানুষরা। ক্যামেরা ক্লিক করে, কান কিছু কথা শোনে। কেমন করে তৈরি হয় সে মুখোশ জানতে চায়।

শোনে

প্রথমে কেঁচো মাটি বা নরম মাটির মুখ তৈরি হয়। তারপর তাতে পড়ে ছাইয়ের প্রলেপ। তারপর আঠা দিয়ে একটির পর একটি কাগজ সাঁটা হয়, রোদে শুকিয়ে পাতলা মাটির আস্তরণ চাপানো হয়। চোখ-মুখ ঠোঁটের ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মাটির গোলাতে ভেজানো সুতির কাপড় সেঁটে দেওয়া। শুকিয়ে গেলে টোকা মারলে খুলে যায় নিচের মাটির মুখ। এরপর মুখোশটি গাছের পাতা দিয়ে ঘসে মসৃণ করা হয়। রং করা হয়। শেষে জরি, রাংতা, চুমকি, পুঁতি পালক লাগিয়ে মুখোশটির সাজ সম্পূর্ণ হয়।

এ তো শুধু কথা। তার পর? এর মাঝে যে কল্পনা রয়েছে সে না থাকলে মুখোশ টির সাজ সম্পূর্ণ হয় কি করে? একই চরিত্রের মুখোশ এক এক শিল্পীর কল্পনায় এক এক রূপ প্রকাশ করে। আমি সেদিন অবাক হয়ে দেখেছি – আর প্রতি টি শিল্পীকে মনে মনে বলেছি এটাই তো ভারতের চিরন্তন ঐক্য (এটা কোন “গাধা” বুঝতে পারবে না)

এতক্ষণ পেটে খিদে বুঝতে পারি নি। চড়িদা গ্রাম পার হওয়ার পরই পেট খিদেয় মোচড় দিয়ে ওঠে। সারথি মেঘনাদ বাহন দাঁড় করায় একটা ছোট হোটেলের সামনে। দুঃখিত নাম ভুলে গেছি। চড়িদা গ্রাম পার হয়ে বাঁদিকে একটা গলির মধ্যে ঢুকে হোটেল টি। ভাত, ডাল, মাছের ঝোল দিয়ে সুন্দর খাবার। শেষ পাতে মিষ্টি। 

এর পর যাত্রা শুরু পাখি পাহাড় এর পথে। পাখি পাহাড় আসলে মাঠা বুরু পাহাড়ের বিপরীত দিকে মাঠা বুরু ফরেস্ট রেঞ্জ এর অন্তর্গত।

মাননীয় শিল্পী চিত্ত দে এই পাহাড়েইন-সিটু রক স্কাল্পচার’-এর কাজ করছেন। সাধারণত ভাস্কর্যশিল্পীরা বাছাই করা পাথর তুলে স্টুডিওতে নিয়ে এসে সেই পাথর কেটে মেলে ধরেন নিজের শিল্পকে। কিন্তু ক্ষেত্রে পাথরটিকে যথাস্থানে রেখেই তাতে খোদাই করা হয়েছে বিভিন্ন আকৃতির পাখি, ঠিক যেমনটা আমরা অজন্তায় দেখতে পাই। ১৯৯৭ সালে সরকারি আর্থিক অনুদানে কাজ শুরু করেন শিল্পী। সরকারি অনুদানের সঙ্গে তাঁকে অনুরোধ করা হয় কয়েকজন ভাস্কর্যশিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার জন্য। কিন্তু শিল্পী চিত্ত দে স্থানীয় আদিবাসী লোকেদের সঙ্গে কাজ করার উপর জোর দেন। প্রথম চার বছর ধরে প্রায় পঞ্চাশ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলেও অবশেষে চব্বিশ জনকে নিয়ে দলবদ্ধ ভাবে কাজ শুরু করেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় এনামেল রং ব্যবহার করে ছবিগুলো আঁকেন। রং-এর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে খোদাইয়ের গভীরতার সংকেত। ছেনি-হাতুড়ি সম্বল করে খোদাইয়ের কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে ৬৫টি ডানামেলা পাখির ভাস্কর্য খোদাই করেন। যার সব চেয়ে ছোটো ডানার দৈর্ঘ্য ৫৫ ফুট আর সব চেয়ে বড়ো ডানার দৈর্ঘ্য ১২০ ফুট।

 

লাল মাটির পথ বেয়ে আমরা পৌছাই এই পাখি পাহাড়ের নিচে। সেখানে দেখা হয় আশিস মাহাতর সাথে। ক্লাস সিক্সে পড়া এই ছেলেটি আমাদের গাইড হয়। ওরা দুই ভাই এক বোন। অত্যন্ত যত্ন নিয়ে আশিস দেখিয়ে চলে। জিজ্ঞাসা করলাম, পড়াশোনা করিস কখন? আশিস বলল আগে তো স্কুলে পড়তাম কিন্তু এখন তো এখানে নেট ওয়ার্ক নেই, তাই আমার পড়াও নেই।   

 

আশিস খুব যত্ন করে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। তার বিনিময় মূল্য কিছু হয় না আর ওদের চাহিদাও খুবই সামান্য। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে আশিস ছিল আমাদের সাথে। সত্যি কথা বলতে কি জায়গাটা এত সুন্দর যে ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছিল না। বনের মধ্যে দিয়ে ঘুরে বেরানো আর সেই বনের মাঝেই আছে খোয়াই বা পাখি পাহাড়ের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন! মঝে মাঝে মনে হচ্ছিল আমরা দুজনেই যদি আজ থেকে ২৫ বছর আগে একবার আসতে পারতাম (যখন শুরু হয়েছিল পাখি পাহাড়ের কাজ) তাহলে কি ভালোই না লাগত।

যাই হোক, পরবর্তী গন্তব্য পারডি ড্যাম(Pardi Dam ) l পুরুলিয়া-বাঘমুন্ডি রোডের উপর মাঠা ফরেস্ট রেস্ট হাউসের কিছুটা আগেথেকে রাস্তা ডান দিকে বেঁকে গেছে চিরুগুড়াপারডি(Pardi )  গ্রামের দিকে l মাথা জঙ্গল পেরিয়ে পৌঁছতে হয় চিরুগুরাপারডি l চিরুগুরা আর পারডি(Pardi )  হল পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত এলাকার জমজ গ্রাম l চিরুগুরা গ্রাম পর্যন্ত রাস্তা ভালো হলেও এর পর ড্যামের দিকে - কিলোমিটার রাস্তা সরু ঢালাই করা l অন্যদিক থেকে একটি গাড়ি এলে সাইড দেওয়া বেশ সমস্যারl এই সরু রাস্তা ধরে চলে আসুন পারডি ড্যামের(Pardi Dam )  কাছে l ।গ্রামের মাঝ দিয়ে গাড়ি চলে গড়গড়িয়ে। অবশেষে বাঁধের পারে রাস্তা শেষ। চারিদিকে পাহাড়ের মাঝে ছোট ড্যাম l টলটলে নীল্ জলের উপর সবুজ পাহাড়ের প্রতিবিম্ব দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় l কাঁঠালঝুড়ি পাহাড়ি ঝোরার জলে পুষ্ট এই জলাধার চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা স্থান টি অবশ্যই দর্শনীয়। তখন সূর্য নামে পাটে। ফলে একটু তাড়াতাড়িই উঠে পড়া গাড়িতে – পরবর্তী গন্তব্য অযোধ্যা পাহাড়ের উপরে ফরেস্ট অফিসের পাশে “পলাশ আবাসন” – সেখানেই যাত্রা বিরতি।

যাওয়ার পথে পার হয়ে গেলাম সুবর্ণ রেখা নদীর উপরে গড়ে ওঠা অযোধ্যা আপার ও লোয়ার ড্যাম।  পলাশ আবাসনে যখন পা রাখলাম তখন আন্ধার। প্রথমেই ইচ্ছা করে চা খেতে। যে কাগজের কাপে চা এল তা দেখে বলতেই হল “আমরা কলেজ জীবনে হাফ চা এর চেয়ে বড় কাপে খেয়েছি”। একটু বিশ্রাম নেওয়ার পর দুজনে বার হয়ে পড়লাম অন্ধকার পথে জঙ্গল জীবন এর সামান্য একটু স্বাদ নেওয়ার জন্য। ঘণ্টা খানেক ঘুরে এসে শ্রান্তি বিনোদন। তারপর এল খাওয়ার ডাক। ভীষণ সুন্দর বাঙালী খাওয়া মন ভরিয়ে দিল। হোটেলের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর ঘুম ডাকল – ঘুম এল চোখের পাতায় আগামী সূর্যের আলো দেখবে বলে।

 

এল সকাল। চেয়েছিলাম সকাল ৯ টার মধ্যেই বার হয়ে যাব কিন্তু মন তো ছেড়ে যেতে চায় না। তাই দেরী হল একটু। আজকের গন্তব্য

প্রথমেই সেই সুবর্ণ রেখা নদীর উপরে গড়ে ওঠা অযোধ্যা আপার ও লোয়ার ড্যাম। দেখলাম তবে খুব একটা ভালো লাগল না, বড় বেশী সাজানো  - গোছানো । তাই তা নিয়ে বেশী শব্দ অপচয় করছি না। ওখান থেকে গেলাম টুরগা ফলস্‌। পায়ের চোটের জন্য নিচে নামতে পারলাম না – মেঘনাদ নিয়ে গেল টুরগা ড্যাম এ। টুরগা ফলসে না নামার আক্ষেপ হারিয়ে গেল ( সঙ্গের ছবি গুলো তার প্রমাণ)। লোকে বলে শ্রী কৃষ্ণ সারথি (সত্যি বলছি শ্রী কৃষ্ণের মত সারথি আজকে থাকলে প্রতি সিগন্যালে কেস খেত। অর্জুন তো বোধহয় ওই জন্যই  বেশী ক্ষেপে গেছিল – মনে মনে বলেছিল “শালা পড়ার সময় জ্ঞান শুনেছি আবার কাজের সময় ও জ্ঞান শুনছি, তার চেয়ে সকলকে মেরে ফেলা ভালো) কিন্তু এ সারথি মেঘনাদ। নীরবে গাড়ি চালায় আর যখন পথ দেখায় তখন সঠিক ভাবেই তীর বিদ্ধ করে অব্যর্থ লক্ষ্যে।

 

বেশ কিছু সময় কেটে গেল টুরগা বাঁধ এ। মাথার উপর রোদ চড়েছে। খিদেও পেয়েছে। অতএব আবার অযোধ্যা আপার ও লোয়ার ড্যাম পার হয়ে ময়ূর পাহাড়  এর পথে। মাঝখানে একটু খেয়ে নেওয়া। ময়ূর পাহাড় – সেই অর্থে এমন কিছু দেখার জায়গা নয় তবে নিচের উপত্যকা দেখতে খারাপ লাগে না। ওখান থেকে পথ চলা শুরু মুরুগুমার পথে।  পথের বর্ণনা দেব এমন সাধ্য এ লেখনী তে কই? এতক্ষণ ধরে যে পথ চলে এসেছি, যে পথ চলা শুরু হয়েছিল তুলিন থেকে ঝালদা ছুঁয়ে সে পথের প্রতিটি মুহূর্ত কেই ভাষায় প্রকাশ করতে পারি এমন ভাষা আমার কলমে নেই। এ শুধু অনুভবের। ক্যামেরায় এ রাস্তা ধরা পড়ে না – ধরা পড়ে না বর্ণনায়। এ রাস্তা কে অনুভব করতে হয় নিজের চোখে।

 

এই ভাবেও চলে এলাম “সুইসাইড পয়েন্ট” এ যা কিনা মুরুগুমা বাঁধের আগে সবচেয়ে উঁচু জায়গা। একটু কষ্ট করে উপরে উঠতে হয় তবে উপরে উঠলে কষ্ট হারিয়ে যায়। ৩৬০ ডিগ্রী জুড়ে প্রকৃতি আর প্রকৃতি। কি দেখতে চান? ধান খেত? আছে তা। আছে পাহাড়, আছে বিশাল জলাশয় – তাতে চরে বেড়ায় হাঁস। ওখান থেকে একটু দুরেই - মুরুগুমা বাঁধ। মুরুগুমা বাঁধের চলচ্ছবি খুব পরিচিত, তাই এ নিয়ে বিশেষ কথা বলছি না, শুধু বলি একটা খারাপ লাগার কথা।

 

মুরুগুমা বাঁধের যেখান দিয়ে জল উপচে পড়ছে (যার ছবি / ভিডিও প্রতি পর্যটক তুলে আনেন) সেই স্রোতের মাঝে আছে এক অন্ধকার। কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে যেতে হয়। গাড়ি দাঁড় করানোর পর থেকে নিচে গিয়ে উপরে ওঠা পর্যন্ত কিছু কচি ছেলে – মেয়েদের মুখে একটি শব্দই শুনতে পেয়েছি

“বাবু ১০ টা টাকা দেনা” / “বাবু কিছু পয়সা দে না” / “বাবু ১০০ টাকা দে না – আমরা ইত জন অ্যাছি, ভাগ করে লুব”

যতখানি সময় কাটাব ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি ছিটকে পালিয়ে এলাম। আসলে আমি তো এখনও কইলকেঁতা – কলকাতার মানুষ হয়ে ভাবি যে এই সব “দুয়ারে” জাতীয় প্রকল্প গুলো মানুষকে কি বানাতে পারে। বাস্তবে দেখলাম এই সব প্রকল্প আসলে আগামী প্রজন্ম কে ভিখারি বানাতে পারে।

                                                 

এর মাঝ খানে আর একটি জায়গা বাদ পড়ে গেছিল। ইচ্ছাকৃত ভাবেই বাদ দিয়ে গেছিলাম কারণ সে জায়গাতেও একটা গল্প আছে।

জায়গার নাম “মার্বেল লেক”।

প্রথম দৃষ্টিতেই বোঝা যায় যে এটা কোন প্রাকৃতিক লেক নয়, এটা একটা শূন্য পাথর খাদান। পরে শুনলাম (লোকের কথায়) এখান থেকেই পাথর নিয়ে তৈরি হয়েছে অযোধ্যা আপার ও  লোয়ার ড্যাম। অসাধারণ লাগল । বেশ কিছু ছবি তুললাম। এবার বলি গল্পের কথা (গল্প নয় তা)

যখন নিচে নামছি তখনই খেয়াল করেছিলাম একজন মানুষ পাথরের খাঁজে বসে হাতে জলের বোতল নিয়ে কি যেন করছেন। প্রথমে ভেবেছিলাম, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বসেছেন। বেশ কিছু সময় পার হয়ে যখন ফিরে আসছি, তখনও দেখি তিনি বসে। এবার কৌতূহল জাগল। তার সাথে কথা বলে যা জানতে পারলাম তা ধরা আছে সঙ্গের ভিডিও তে। সেই ভিডিও অনেক কিছুর প্রমাণ।

 

এবার তুলিনে ফেরার পালা। ফেরার সময় ফিরতে হবে ঝালদা সত্যভামা বিদ্যাপীঠের সামনে দিয়েই। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। কেন যেন স্কুলে ঢোকার ইচ্ছা হল। মেঘনাদ গাড়ি দাঁড় করাল – দুজনে মিলে ঢুকে পড়লাম স্কুলে। সুরিতা প্রথম দেখল ঝালদা সত্যভামা বিদ্যাপীঠ কে। আমার চোখে তখন জল। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি আর চোখের জল মুছছি। আসলে এ এক অন্য আবেগ। যে স্কুল থেকে মাধ্যমিক – উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছি সে তো আমার কাছে এক তীর্থ স্থান। স্কুলের গেট পার হওয়ার আগে মাথায় মেখে নিয়েছি স্কুলের মাটি। দেখালাম টিচার্স রুম, অফিস রুম, ১০ বি সেকশন, ইলেভেন সায়েন্স এর রুম, আমাদের প্রেয়ার করার জায়গা, হেড স্যারের রুম। অবশেষে পরিচয় হল বর্তমান প্রধান শিক্ষকের সাথে। তাঁর হাত থেকে গ্রহণ করলাম আমার উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট। 

 

দিনের পালা শেষ হয়ে তখন নামছে আঁধার। যাত্রা শেষ হল সন্ন্যাসী লজে।

 

সকালবেলা তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট করে (অবশ্য তুলিনে থাকলে লক্ষ্মীর সাথে সকাল – সন্ধ্যায় একটু আড্ডা হবেই – আজ সকালেও তার ব্যতিক্রম হয় নি) পথ চলা শুরু সারথি মেঘনাদের সাথে। আজকের গন্তব্যঃ

সীতা ফলস – জোনহা ফলস – হুন্ড্রু ফলস্‌ হয়ে পাত্রাতু ভ্যালি। সেখানে রাত কাটিয়ে পরের দিন সকালে পাত্রাতু ভ্যালি দেখে – পালানি ফলস্‌ - রাজারাপ্পা হয়ে তুলিন ফেরা।

 

সবচেয়ে ভালো কথা হল আজ আকাশে মেঘের দেখা নেই। ঝকঝকে রোদ। গাড়ি এগিয়ে চলে সুবর্ণ রেখা ব্রিজ পার হয়ে প্রবেশ করে ঝাড়খণ্ডে। প্রথম গন্তব্য সীতা ফলস্‌।

সুবর্ণ রেখার এক উপনদী হল রাধু। সেই রাধু নদীর জল রাঁচি থেকে ৪০ কিমি দূরে জঙ্গলের মধ্যে ঝাঁপ দিয়েছে ৪৩.৯ মিটার (১৪৪ ফুট)। মতান্তরে সুবর্ণরেখার উপনদী কাঞ্চির উপরে সীতা ফলসের অবস্থান এবং এর উচ্চতা ৩০০ ফিট। প্রচলিত কাহিনী অনুসারে রাম বনবাসের সময় এই অঞ্চলে কিছুদিন কাটিয়েছিলেন এবং এখানে সীতার পায়ের ছাপ আছে। যুক্তি মানলে দক্ষিণ ভারতে যাওয়ার পথ এটা নয় ফলে রাম নামক কেউ থাকলে তার এই অঞ্চলে আসা গড়িয়া থেকে হাওড়া যেতে বারুইপুর ঘুরে যাওয়ার মত। তবে এটা মানতেই হবে পাহাড় – জঙ্গলে ঘেরা এ প্রপাত টির সৌন্দর্য মানুষকে মুগ্ধ করতে বাধ্য।

প্রসঙ্গত আমি যখন ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ এই অঞ্চলে ছিলাম, জোনহা ফলসে একাধিক বার (সর্ব মোট ৪/৫ বার) এলেও সীতা ফলসের নাম শুনি নি অথচ এটা জোনহা যাওয়ার রাস্তাতেই এবং জোনহা থেকে মাত্র ৪ কিমি দূরে। প্রায় ৪০০ সিঁড়ি ভাঙতে হবে নিচে যেতে হলে তবে নিচে যাওয়ার পর আপনি সব ক্লান্তি ভুলে যাবেন এটা নিশ্চিত।

 

এবার জোনহা ফলস্‌ যার আর এক নাম গৌতম ধারা ফলস্‌। কাসকেড জলপ্রপাতের এক আদর্শ উদাহরণ হল জোনহা জলপ্রপাত। জলপ্রপাত যখন খুব ছোট হয় অথবা যখন জলপ্রপাতের ছোট ছোট ধারা সিঁড়ির মত ধাপে ধাপে নিচের দিকে নেমে আসে তখন তাকে বলে কাসকেড জলপ্রপাত। গুঙ্গা নদীর ধারায় সৃষ্ট এই জলপ্রপাত এসে ঝাঁপ দিয়েছে রারু নদীতে। বর্ষার ঠিক পরে এলে এই প্রপাত কে পাওয়া যায় তার আসল রূপে। সে রূপ দেখার সৌভাগ্য এবার না হলেও আগে দু বার হয়েছিল। আগফা ক্লিক থ্রি আর ফোর ক্যামেরায় তোলা সে সময়ের সে সাদা – কালো ছবি গুলো কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে। তবে স্মৃতিতে তো আজও সেই দৃশ্য ধরা আছে ফলে প্রপাতের উপরে এসেই একটু ধাক্কা লাগল। আসলে সীতা ফলসে যাইনি কোন দিন ফলে তার কোন স্মৃতি নেই কিন্তু জোনহা তো বহু পুরানো বন্ধু। সে বন্ধুর চেহারা পালটে গেলে একটু খারাপ তো লাগেই। তবে এ বদল তার বহিরঙ্গে, অন্তরে সে এখনও তেমনই উচ্ছল।

 

আমরা যখন গিয়ে পৌঁছালাম তখন ১ টা বেজে গেছে। ফলে নামার আগে খাবারের অর্ডার দিয়েই নামতে হল। মাত্র ৭২২ টা সিঁড়ি নামতে হবে তাঁর সামনে যেতে হলে। ১৬ / ১৭ বছর বয়সে যখন গেছিলাম তখন এ রকম সান বাঁধানো সিঁড়ি ছিল না আর তাই বোধহয় ছুটে নামতাম আর দৌড়ে উঠতাম (চুপি চুপি বলে রাখি ধড়াম ও হতাম)। তবে এটা ঘটনা নামা সহজ কিন্তু ওঠা কঠিন (সে অবশ্য জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই)। নেমে কি দেখলাম তার প্রমাণ সঙ্গের ছবি গুলো। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিচে কাটিয়ে ধীরে ধীরে উপরে ওঠা। মাঝে একবার লেবুর শরবত খেয়ে একটু শক্তি সঞ্চয়। উপরে উঠে গরম ভাত আর দেশী মুর্গীর ঝোল। আহা – কি অপূর্ব স্বাদ। যারা যাবেন তাঁরা খেতে ভুললে বলব অপরাধ করেছেন। আমার যেমন এখনও মনে আছে পুরানো সেই দিনে এক পিকনিকের কথা। জোনহায় বসে যে বিরিয়ানি খেয়েছিলাম তার তুল্য বিরিয়ানি আজও খাই নি আর খাবো বলে আশাও করি না। এরপর যাওয়া হুড্রুর পথে। প্রসঙ্গত বলি, হুড্রু আমার কোনদিনও তেমন ভালো লাগে নি কারণ বাঁধ দিয়ে তার চঞ্চলতা আর বিস্তার অনেক আগে থেকেই রুদ্ধ। তাই হুড্রুর ছবিও সেভাবে তুলি নি বর্ণনা ও দিচ্ছি না।

সঙ্গের ছবি গুলো মূলত জোনহার।

 

হুড্রুর থেকে যাত্রা শুরু পাত্রাতুর পথে। সেখানেই রাত কাটবে। পথে পড়ল এক শাল বন। সেটা নাকি শুটিং স্পট। দেখলামও অন্তত দুটো জায়গায় শুটিং চলছে। গাড়ি থামিয়ে আমরাও কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। এরপর প্রায় ৭৭ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে পাত্রাতু পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টা – ৭ টা। সেদিনের থাকার ব্যবস্থা “সরোবর বিহার” হোটেলে। প্রসঙ্গত প্রপার পাত্রাতুতে এই একটিই থাকার ব্যবস্থা। বাকি গুলো কম করে ৩ – ৫ কিমি দূরে। পাত্রাতু ড্যামের গায়ে লাগানো এই হোটেল টি এক কথায় অসাধারণ। সেদিন রাত্রে আর ছবি তোলা গেল না। পরের দিন সকালে উঠে চলল ছবি তোলার পর্ব। তবে প্রথমেই মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল, খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গা সত্ত্বেও ক্লান্তির কারণে বিছানা ছাড়তে ইচ্ছা করছিল না, তাই বাঁধের উপর থেকে সূর্যোদয় মিস করলাম। তবে পরবর্তীতে বেশ কিছু ভালো ছবি পেয়ে এ আক্ষেপ অনেকটাই মিটে গেল।  “সরোবর বিহার” এ জল খাবারের পালা শেষ করে চলে গেলাম পালানি ফলস এ। সরোবর বিহার / পাত্রাতু লেক থেকে মাত্র ৩ কিমি দূরত্বে এই ছোট প্রপাত টি। যে কেউ অনায়াসে স্নান করতে পারেন (তবে পোশাক বদলানোর কোন আড়াল নেই)। চারি পাশের দৃশ্য সুন্দর। ওখান থেকে চলে যাওয়া পাত্রাতু ভ্যালি ভিউ পয়েন্টে। তবে সত্যি কথা বলতে কি ভিউ পয়েন্ট থেকে জিগ জ্যাগ রাস্তার সৌন্দর্য অতখানি ভালো বোঝা যায় না কারণ গাছ অনেকটাই আড়াল করে দিয়েছে। এই সৌন্দর্য দেখতে হলে অন্য কিছু জায়গায় গাড়ি থামিয়ে দেখতে হয়, আমি তাই করেছি। পাত্রাতু পড়ে থাকে পিছনে, সামনে “রাজরাপ্পা”। দূরত্ব সাড়ে ৫৩ কিমি।

 

“রাজরাপ্পা”র মূল আকর্ষণ (আমার কাছে) “দামোদর নদ” ও “ভেরা (ভৈরবী) নদী”র মিলনস্থল। এখানে ছিন্নমস্তার মন্দিরও আছে। এখানে একটি অনুচ্চ পাহাড় থেকে পুরো ভৈরবী নদী দামোদর নদের বুকে আছড়ে পড়ছে। ভৈরবী নদীকে নারী আর দামোদর নদকে পুরুষ মনে করলে নদ নদী অথবা নারী-পুরুষের সেই চির সঙ্গম হচ্ছে এই স্থানটিতে। টিলায় ঘেরা দামোদরকে কী অপরূপ লাগে। সেই রূপ একবার যে দেখেছে সে জন্ম জন্মান্তরেও তা ভুলবে না।

“রাজরাপ্পা” নামটির সঙ্গেও এটি সুন্দর কাহিনি জুড়ে রয়েছে। প্রাচীনকালে এখানকার এক জনপ্রিয় রাজা ছিলেনরাজা’, তাঁর স্ত্রীর নাম ছিলরুম্পা পরবর্তীকালে রাজা রুম্পার নামে জায়গার নাম হয়রাজরাপ্পা”। প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগে যায় “রাজরাপ্পা” পৌঁছাতে কারণ মূলত ট্র্যাফিক জ্যাম ও রাস্তায় খাওয়ার জন্য কিছু সময় চলে যাওয়া। গাড়ি থামতেই পুরো চমকে যাই। আমার চেনা “রাজরাপ্পা” র সাথে একে মেলাতে পারি না কিছুতেই। রামগড়ের দিক থেকে এলে (যেদিক থেকে আমরা এবার এলাম) গাড়ি চলে যেত মন্দিরের সামনেই কিন্তু ঝালদার দিক থেকে এলে “ভেরা” নদীর ওপারে “গোলা” তে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে নদী পার হয়ে আসতে হত।  এখন দেখি “ভেরা” নদীর উপরে পায়ে চলা পথ। নদীকে দেখাই যায় না। যাই হোক, মন্দির পার হয়ে দামোদরের পারে গিয়ে ভালো লাগে – দামোদরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বাঁদিকে তাকিয়ে পুরানো সেই “রাজরাপ্পা” কে খুঁজে পাই। আধ ঘণ্টা টাক কাটিয়ে কিছু ছবি তুলে ফেরার পালা শুরু।  পরের দিনের অপেক্ষায় মুহূর্ত গোনা শুরু কারণ যে কারণে এ ভাবে বেরিয়ে পরা তার পূর্ণতা প্রাপ্তির দিন হল সেই দিন। লক্ষ্মী আর শক্তি বেশ কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করেছে।

 

আমার কাছে – আমাদের কাছে এই দিনটা হল সবচেয়ে স্পেশাল। এদিনই ঝালদা ঘুরতে যাওয়ার কথা। যাব স্কুলে – আমরা যেখানে থাকতাম সেই বাড়িতে – কালী পাহাড় এবং অবশ্যই ঝালদা স্টেশন। তবে এদিন সবার আগে যাওয়া হল লক্ষ্মীর বাড়ি। ওর স্ত্রীর সাথে আলাপ – পরিচয় সেরে ঘুরে দেখলাম ওদের পারিবারিক ব্যবসা। দেখলাম লাক্ষা থেকে কি করে গালা তৈরি হয়। এর মধ্যে অচিন্ত্যের ফোন চলে এসেছে দু – বার। ওর দোকান বন্ধ করে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে। আমার জন্য নিজের ব্যবসার পরোয়া করে নি বন্ধু। অতএব এবার চলা ঝালদার পথে। একটি অটোতে করে আমি, সুরিতা আর লক্ষ্মী বেরিয়ে পরি। স্কুলের সামনে অটো দাঁড় করাতেই দেখতে পাই অচিন্ত্য কে। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরি – দুজনের চোখ ভরে ওঠে জলে। পথ চলতি মানুষ অবাক হয়ে ফিরে তাকায় আমাদের দিকে। একটু সামলে নিয়ে ঢুকে পড়ি স্কুলে – আসলে ঢুকে পড়ি সেই দিন গুলোতে। মূল গেট পার হয়ে বাঁদিকে খেলার মাঠ ছেড়ে ডানদিকে বাঁক নিই। এবার আমাদের ডান পাশে মূল স্কুল বিল্ডিং আর বাঁ পাশে আর একটি বড় মাঠ যা পার হলে হোস্টেল। বাঁ পাশের মাঠেই অফিস রুমের উল্টোদিকে আমরা প্রেয়ারের জন্য দাঁড়াতাম (শুনলাম এখনও তাই হয়)। মাঠ আর স্কুল বিল্ডিং এর মাঝের রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে গেলে ওই ঘর গুলোর পরে একটু খালি জায়গা তারপর ইংরাজি “এল” আকৃতির একটি বাড়ি। সেখানেই ইলেভেন – টুয়েল্ভ এর ক্লাস আর একই সাথে ল্যাবরেটরি। খারাপ লাগল বাড়ি গুলোতে দীর্ঘ দিন কোন রঙের পোঁচ পরে নি। মাঠ পার হয়ে গেলাম হস্টেলে – তারও ভগ্ন দশা। বন্ধুদের কথায় “আগেকার মাস্টর গুলো – ছেলে পুলা গুলান স্কুল টাকে ভাইল্যবাইসত রে, এখন ইরা চাকরী করতে আসে আর পইড়ত্যে আসেক বটে। ভাইল্যবাসা নাই।“ কথায় কথায় সময় পার হয়, আবার উঠে বসা গাড়িতে। এবার মূল শহরের দিকে যেতে যেতে আনন্দ বাজারের সামনে আসতেই মিঠুর কথা মনে হয়। অটো মূল রাস্তা ছেড়ে ঢুকে পরে গলিতে। সুমিতের বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই তিন বন্ধুর হাঁক ডাক শুরু। এঁটো হাতে বার হয়ে আসে মিঠু মানে সুমিত। “কি রে চিইন্ত্যে পারছিস?” একটু চোখ কুঁচকে দেখেই বলে “শ্রীতোষ বটে না!”, হাঁ রে আমিই বটি”। চেষ্টা করি পুরানো সেই ভাষার টান ফিরিয়ে আনতে। সুমিত এখন স্কুল টিচার – একই সাথে খেলা – ধুলা চালিয়ে যাচ্ছে ওর অর্ধেক বয়সীদের সাথে পাল্লা দিয়ে। তখন বার হতে পারল না কিন্তু কথা দিল সন্ধ্যা বেলা সন্ন্যাসী লজের আড্ডায় অবশ্যই আসবে (তবে একটা শর্তে – ওকে সাড়ে ন টার মধ্যে বার হয়ে আসতে হবে)। এরপর চলা পুরানো বাঘ মুন্ডি রোডের দিকে। ওই রাস্তায় ঢুকলেই প্রথমে বাঁদিকে পড়ে “মাদার ইন্ডিয়া” বিড়ি ফ্যাক্টরি, সেখান থেকে ৫০ মিটার খানেক এগোলেই ছিল সেন্ট্রাল এক্সাইজের ঝালদা সেক্টর অফিস কাম থাকার জায়গা। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ ওই বাড়িতেই থেকেছি। বাড়িতে প্রথম টিভি আসে ওই বাড়িতেই। একটা দোতলা ব্যারাক টাইপের বাড়ি, মোট ৬ টা ফ্ল্যাট। সামনে বেশ কিছুটা খালি জায়গা, তাতে শীত কালে ব্যাডমিন্টন খেলা হত। বাড়িটার আজ ভগ্ন দশা। প্র্যাকটিক্যালি ভেঙ্গে ফেলার কাজই চলছে। মূল দরজাও বন্ধ। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় দরজার পাশে পাঁচিলের একটা অংশ ভাঙ্গা। একটু ঝুঁকি নিয়েই নর্দমা পার হয়ে ঢুকে পড়ি বাড়ির মধ্যে। চারপাশ ঘুরে দেখি কিন্তু ঘরের মধ্যে ঢুকতে গেলে সকলেই বারণ করে, তাই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার বেরিয়ে আসি রাস্তায়। এর মধ্যে ঘটেছে আর এক ঘটনা। বাঘমুন্ডি রোডে ঢুকে অটো থেকে নেমে পড়েছিলাম আমরা ৫ জন (সুমিতের বাড়ি থেকে শক্তিও জুটেছিল আমাদের সাথে) পায়ে হেঁটেই চলছিলাম। রাস্তায় কি করে কিছু মানুষ চিনে ফেলে আমাকে – নিঃসন্দেহ হয় যখন ভাঙ্গা দেওয়াল টপকে ঢুকি ওই বাড়িতে। “ইন্সপেক্টর বাবুর বড় ছেল্যা টা বটে। কতদিন পরে দেইখল্যাম উকে”। বন্ধুরাও কিছুটা অবাক – সুরিতা তো অবাকই। এরপর মেঘনা বিড়ি পার হয়ে ঝালদা শ্মশান। মায়া বাঁধ আর  নেই কিন্তু একটা নতুন পার্ক হয়েছে। ওখানে একটু সময় কাটিয়ে জল খেয়ে চলে গেলাম কালী পাহাড়ে। একপাশে গার্লস স্কুল আর অন্যপাশে হিন্দি হাই স্কুল কে রেখে উঠে যাই কালী পাহাড়ের মাথায়। সুরিতাকে দেখাই মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় হিন্দি হাইয়ের কোন ঘরে বসেছিলাম আর কোন জানলা দিয়ে উড়ে এসেছিল টুকলি বাঁধা ইঁট। যথারীতি ছবি তোলা হয় বেশ কিছু তারপর নেমে আসি। এবার ঝালদা স্টেশন। দ্য লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট ফাইন্যাল ডেস্টিনেশন। একদিনের কথা সুরিতা কে বলি। মৌর্য এক্সপ্রেস প্রতিদিনই ঝালদায় ঢুকত লেট করে, একদিন সময়ে ঢুকেছে। আমরা অবাক। গার্ড কে জিজ্ঞাসা করতে উনি জানালেন এই ট্রেন টা আগের দিনের মানে মাত্র ২৪ ঘণ্টা লেট। স্টেশনেই দেখা হল দেবেশের সাথে। ওকেও সন্ধ্যায় আসতে বললাম, বলল চেষ্টা করবে। তবে সবচেয়ে হাইট করল রুদ্রেন্দু। শ্মশানের সামনে থেকে ওকে ফোন করা হল, ও তখন নাকি স্নান করতে যাচ্ছে। দু ঘণ্টা বাদে স্টেশনে এসে ওকে ফোন করা হল, ও তখনও স্নান করতে যাচ্ছে। দু ঘণ্টা ধরে যে বন্ধু স্নান করতে যায় তাকে শুধু বলতে হয়

“আমার বলার কিছু থাকল না – না না না”

ঘড়িতে তখন প্রায় দুটো এবার তুলিন ফেরার পালা। ও একটা কথা বলা হয় নি, স্টেশনের মুখে দাঁড়িয়ে শক্তি একটা ছোট্ট ফুচকা পার্টি দিয়ে দিল (চুপি চুপি বলি সবচেয়ে বেশী ফুচকা আমিই খেয়েছি।)সন্ধ্যা ৬ টার মধ্যে সকলের আসার কথা, অজিত ছিল রাঁচিতে। ওর আসতে একটু দেরী হল – সকলে এসে হাজির হল ৭ টা নাগাদ। সুমিত আবার আমাকে কাঁদিয়ে দিল – বলল একটু সমস্যা ছিল কিন্তু ভাইবল্যাম শ্রীতোষ এত খানি দূর থেকে আমাদের সাথ্যে দেঁখ্যা কইরত্যে আইসত্যে পাইরল্য আর আমি উর সাথে দেখ্যা কইরত্যে ৮ কিমি পথ দুর‍্যে যাইত্যে পারবক লাই।

এর পরের সে সময় ধরা আছে কিছু ভিডিও তে। সকাল বেলাতেই শক্তি কথা প্রসঙ্গে বলেছিল ওর স্কুলের অনুষ্ঠানে ও ঝুমুর গায়। শক্তির সে গান সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে থাকল।

সবচেয়ে মজার কথা, সুমিত সকালে বলেছিল ও আসবে একটাই শর্তে ওকে সাড়ে ন টার মধ্যে বার হয়ে আসতে হবে। সুমিত সহ ঝালদার সব বন্ধুরা বার হল – ঘড়িতে তখন রাত প্রায় পৌনে ১১ টা।

আমার ঝালদা ভ্রমণ সার্থক ও সম্পূর্ণ হল।

 

পুরানো সেই দিনের কথা – শেষ পর্ব।

এ পর্বে আছে দশম ফলস – নেতারহাট – লোধা (লোধ) ফলস – সুগা বাঁধ ফলস্‌ - মিরচাইয়া ফলস্‌ - বেতলা – পালামৌ  ফোরট – কেচকি সঙ্গম (আওরঙ্গা আর কোয়েল নদী র সঙ্গম)

 

এদিন সকালে লক্ষ্মীর সাথে এ বারের মত শেষ আড্ডা মেরে বার হয়ে পড়া। সুবর্ণ রেখা নদী পার হওয়ার সময় মনে মনে বলি, প্রথম বার ফিরে আসতে একটু দেরী হল কিন্তু এবার আর বেশী দেরী করব না, আবার ফিরে আসব বন্ধুদের কাছে – ফিরে আসব ঝালদা সত্যভামা বিদ্যাপীঠের সেই দিন গুলোতে – ফিরে আসব খুব তাড়াতাড়ি।

মুরিতে তেল ভরতে গিয়ে একটা ছোট্ট সমস্যা। মাওবাদীদের ডাকা বন্ধে পেট্রোল পাম্প বন্ধ। মেঘনাদ বাবা – বাছা বলে কোনও রকমে তেল ভরে নিল। প্রথম গন্তব্য দশম ফলস। তুলিন থেকে দূরত্ব ৭০ কিমি।

মুন্ডারী ভাষারদা-সংকালে কালে বদলে হয়েছে দশম। মুন্ডারী ভাষায়দাএর অর্থ জল এবংসংএর অর্থ পরিমাপ করা বা ঢালার কাজ করা। স্থানীয়দের মনে হয়েছিল ঠিক যেন কেউ জল ঢালছে উপর থেকে তাই মুন্ডারী ভাষায় নাম রাখেদা-সং। নদীর নাম কাঞ্চি (কাচিনি) আর ফলসের উচ্চতা ১৪৪ ফুট। ইচ্ছা ছিল বেশ কিছু সময় থাকব কিন্তু উপায় নেই প্রায় ১৯২ কিমি দূরে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য। সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যেতে চাই। তাই ঘণ্টা  খানেক সময় বাদেই আবার উঠে পড়া গাড়িতে। তাড়াতাড়ি করতে চাইলেও তাড়াতাড়ি হল না, বেশ কিছু জায়গায় রাস্তা ভীষণ খারাপ। ফলে নেতারহাট ঢুকলাম প্রায় সাড়ে ৬ টায়। ঝাড়খন্ড ট্যুরিজমের হোটেল “প্রভাত বিহার” বুক করা ছিল, এই হোটেলে আগেও থেকেছি তখন নাম ছিল “বিহার লজ”। হোটেলের সবচেয়ে বড় সুবিধা যে এই হোটেলটাই হল “সানরাইজ পয়েন্ট”। হোটেলের গা থেকেই শুরু হয়েছে ঘন জঙ্গল – যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। এখানে আমাদের অবস্থান দু রাতের জন্য। হোটেল থেকেই দু দিন সানরাইজ দেখলাম আর সান সেট দেখলাম “ম্যাগনেলিয়া পয়েন্ট” থেকে। ম্যাগনেলিয়া পয়েন্ট নামকরণের নেপথ্যে আছে এক ট্র্যাজিক প্রেম। ইংরেজ দুহিতা ম্যাগনেলিয়া বাবা-মায়ের অমতে স্থানীয় এক রাখাল বালকের প্রেমে পড়েন। ব্রিটিশ চক্রান্তে হঠাৎই রাখাল বালকটির আর খোঁজ মেলে না। আসল ঘটনাটা জানতে পেরে রাগে,দুঃখে প্রচণ্ড ঘোড়া ছুটিয়ে এসে পাহাড় থেকে ঘোড়া-সহ খাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন ম্যাগনোলিয়া। সে দিনের সেই করুণ প্রেমের আখ্যান আজও অমর হয়ে আছে একটি পাথরের ফলকে। লিখেছেন তৎকালীন এসপি।

 প্রসঙ্গত এই জায়গাটিকে বর্তমানে একটি কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত করা হয়েছে। সান সেটের পরে এখানে কেউ থাকে না, তা সত্ত্বেও লাগানো হয়েছে বাতিস্তম্ভ যা সামনের প্রকৃতি দর্শন ও ছবি তোলায় ভীষণ সমস্যা তৈরি করছে। একটা নির্মম বাস্তব হল এই, বিভিন্ন স্থানে পর্যটনের উন্নয়নের নামে সরকারের যেন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রকৃতি ধবংস। বিশেষ করে সব সরকারেরই টাইলস্‌ প্রীতি কে প্রশংসা না করে পারা যায়। ঘাস, মাটি, পাথর, বালি – সব সরিয়ে টাইলস লাগাও, টাইলস না লাগাতে পারলে এঁদের যেন পাইলস হয়ে যায়। মন্দার মণি থেকে মিরিক হয়ে ম্যাগনোলিয়া পয়েন্ট, অযোধ্যা পাহাড় – সব জায়গাতে একই ব্যাপার। সব জায়গায় এরা পার্ক বানাতে চায়। আরে ভাই পার্ক দেখতে গেলে কলকাতা – রাঁচি যাব বাতাসিয়া লুপ আর দশম ফলসে আমি পার্ক দেখতে চাই না।

 

নেতারহাট থেকে বার হয়ে আমরা যাব বেতলা। একটু ঘোরা রাস্তা বেছে নিলাম কারণ সে পথেই পড়বে  লোধা (লোধ) ফলস – সুগা বাঁধ ফলস্‌ - মিরচাইয়া ফলস্‌। নেতারহাট থেকে ৬১ কিমি দূরে লোধা (লোধ) ফলস বুরহা নদীর উপর অবস্থিত। ঝাড়খন্ডের সবচেয়ে উঁচু ১৪৩ মিটার (৪৬৯ ফুট) উঁচু এই প্রপাতটি সরকারী করুণা পায় নি বলেই আজও ভার্জিন আছে। এ ফলসে যেতে গেলে পাইলস (টাইলস্‌) বা মার্বেল বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে যেতে হবে না। পাথর মাটির উপর পা ফেলে (কোথাও কোথাও সিঁড়ি আছে) উঠে নেমে পৌঁছাতে হবে এর কাছে। ভালো গ্রিপের জুতো ছাড়া এ পথে চলা খুব অসুবিধা জনক। যেতে কষ্ট হবে কিন্তু গেলে মন ভরে যাবে এ নিয়ে কোন দ্বিধা নেই। সঙ্গের ছবি এবং ভিডিও গুলো তার প্রমাণ। এর পরের গন্তব্য সুগা বাঁধ ফলস।

স্থানীয় ভাষায় “সুগা” মানে টিয়া পাখি। একদিন একটি পুরুষ টিয়া তার তৃষ্ণার্তা সঙ্গিনীর জন্য জল খুঁজে বেড়াচ্ছিল। অনেক খুঁজে গভীর জঙ্গলের মধ্যে সেই একটি নদী দেখতে পায় কিন্তু তার এতই স্রোত যে সে ওখান থেকে কোন ভাবেই তার সঙ্গিনীর জন্য জল নিয়ে যেতে পারছিল না। অনেক ভেবে, সে এক বুদ্ধি বার করে। ছোট ছোট পাথর নিয়ে সে ওই জল্ধারার মধ্যে ফেলতে থাকে, এই ভাবে তৈরি হয় এক বাঁধ যা জলের স্রোত কে কিছুটা কমায়। তখন সে ওখান ত জল নিয়ে তার সঙ্গিনীর তৃষ্ণা দূর করে। আর একটি গল্প আছে। একসময় উত্তর কোয়েল নদী এখানে এসে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। তখন এক ঝাঁক সুগা (টিয়া) পাথর ফুটো করে নদীকে মুক্ত করে। উত্তর কোয়েল নদীর উপরের এই স্থানটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। মূল রাস্তা থেকে একটি কংক্রিটের রাস্তা ধরে পৌঁছাতে হয় এখানে – রাস্তাটির উপর দিয়ে একটির বেশী দুটি গাড়ি পাশাপাশি চলতে পারে না ফলে মুখোমুখি হয়ে গেলে কোন একজন কে পিছনে যেতেই হবে। রাস্তা যেখানে শেষ সেখানে একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে। আগ্রহীরা উপরে উঠে দেখতেই পারেন।

 

এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলে রাখা ভালো, এ পথে প্রায় বেশীর ভাগ অংশে বি এস এন এল ছাড়া অন্য কোন নেট ওয়ার্ক পাওয়া যায় না। ঘন পাহাড় – জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলা এ পথের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য কিছুটা ধরা আছে ভিডিও তে। সুগা থেকে পথ চলা শুরু। কোন মোবাইল নেট ওয়ার্ক নেই। ফলে জি পি এস এর সুবিধাও নেই। মেঘনাদ এ পথে কোন দিনই আসে নি। ফলে জঙ্গলের মধ্যে যেখানে রাস্তা দু ভাগ হয়ে যাচ্ছে সেখানে একটু চিন্তাই হচ্ছিল। যাই হোক, এভাবেই এসে পৌঁছে গেলাম মিরচাইয়া ফলসে। রাস্তার থেকে সামান্য দূরে উত্তর কোয়েল নদীর উপর একটি ছোট্ট মিষ্টি প্রপাত হল এই মিরচাইয়া। সঙ্গের ভিডিও তার প্রমাণ। কিছুক্ষণ ওখানে কাটিয়ে এবার বেতলা হোটেল “বন বিহার” এর  পথে। বেতলা জঙ্গল সাফারি গেট থেকে দু মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ – হোটেল বন বিহার। আগে থেকেই বুকিং ছিল। পরের দিন বিকালে জঙ্গল সাফারি হল। তার পরের দিন সকালে বের হয়ে পড়লাম রাঁচির পথে। যাওয়ার পথে দেখে নিলাম পালামৌ দুর্গ।

 

 

 

চেরো রাজা মেদিনী রায় এই পালামৌ অঞ্চলে রাজত্ব করেন। ১৬৫৮ থেকে ১৬৭৪ সাল অবধি। তখন অবশ্য এটি ছিল বিহার রাজ্য। পরে যা ভেঙে ঝাড়খণ্ড হয়। তখন দিল্লির শাসক ছিলেন মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব। বিহারের এই অংশ নিজের অধীনে আনবার জন্য বাদশা ঔরঙ্গজেব এক বিশাল সেনাবাহিনী প্রেরণ করলেন। যে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন দায়ূদ খান। দায়ূদ খানের সহযোগী ছিলেন দ্বারভাঙার ফৌজদার মির্জা খান, চৈনপুরের জাগিরদার ত্বহাউর খান, মুঙ্গেরের রাজা, কোরহার শাসক নাগবংশী প্রমুখ। ১৬৬০ সালে মুঘল বাহিনী পালামউ দুর্গ আক্রমণ করে। ঔরঙ্গজেব চেয়েছিলেন মুসলিম ধর্মে দীক্ষিত করতে চেরো বংশের হিন্দু রাজা মেদিনী রায়কে।

প্রবল যুদ্ধের পর পরাজিত রাজা মেদিনী রায় কেল্লা ছেড়ে পালিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেন। দুর্গ দখল করে দায়ূদ খানের নেতৃত্বাধীন মুঘল বাহিনী। ধংস হয় সেখানকার অধিকাংশ হিন্দু স্থাপত্য। ধ্বংস করা হয় বেশ কিছু হিন্দু মন্দির বিগ্রহ। এর পরে কমল দহ ঝিল দেখে কেচকি সঙ্গম (আওরঙ্গা আর কোয়েল নদী র সঙ্গম) ছুঁয়ে পৌঁছে যাওয়া রাঁচি স্টেশন। এখান থেকেই বিদায় নিল আমাদের এই কদিনের সারথি মেঘনাদ। রাত ১০ টার পরে ট্রেন ছাড়ল। আবার কলকাতা, সেখান থেকে ফিরে যাওয়া দিন – প্রতিদিনের জীবনে। মনের মণিকোঠায় অমর হয়ে থেকে গেল –

পুরানো এ দিনের কথা।

 

 

খয়রাব্যেড়া বাঁধ – চড়িদা গ্রাম (মুখোশ) – মাঠা বুরু পাহাড় – পাখি পাহাড় (আশিস মাহাতো ক্লাস সিক্স দুই ভাই এক বোন) পাদবি বাঁধ – অযোধ্যা আপার ও লোয়ার বাঁধ –টুরগা ফলস্‌ - টুরগা বাঁধ – ময়ূর পাহাড় - সুইসাইড পয়েন্ট - মুরুগুমা বাঁধ – সত্য ভামা বিদ্যাপীঠ

 

১৭ – ১৮

সীতা ফলস – জোনহা ফলস – হুন্ড্রু ফলস্‌ - পাত্রাতু ভ্যালি – পালানি ফলস্‌ - রাজারাপ্পা

 

১৯

ঝালদা

 

২০ – ২৪

দশম ফলস্‌ - নেতারহাট – লোধা ফলস্‌ - সুগা বাঁধ ফলস্‌ - মিরচাইয়া ফলস্‌ - বেতলা – পালামৌ  ফোরট – কেচকি সঙ্গম (আওরঙ্গা আর কোয়েল নদী র সঙ্গম)

 

 


 

 

No comments:

Post a Comment